জীবন নাকি জীবিকা? প্রশ্নটি গত দেড় বছরে যতবার উচ্চারিত হয়েছে, তার আগের ১০ বছরেও বোধ হয় এতবার উচ্চারিত হয়নি। কারণ জীবন ও জীবিকার মধ্যে যে সম্পর্ক— সেখানে এক বিশাল ডায়্যালেকটিক (দ্বন্দ্ব) তৈরি করেছে অতিমারি করোনাভাইরাস।
জীবন ছাড়া জীবিকার যেমন মূল্য নেই, তেমনি জীবিকার নিশ্চয়তা ছাড়া জীবন দুর্বিষহ। যে কারণে জীবন ও জীবিকা শব্দ দুটি পাশাপাশি ব্যবহৃত হয়। কিন্তু অতিমারি করোনা শুধু জীবনই কেড়ে নিচ্ছে না, জীবিকায়ও বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছে।
কয়েকটি সংবাদ শিরোনামে চোখ বোলানো যাক।
১. কোভিডে বেকার হয়েছে ২৬ লাখের বেশি মানুষ (বণিকবার্তা, ০৪ জুলাই, ২০২১)।
২. দুই কোটি ২০ লাখ কর্মসংস্থান হারিয়ে গেছে করোনায় (প্রথম আলো, ০৮ জুলাই ২০২১)।
৩. করোনায় চাকরি হারিয়েছেন প্রতি তিনজনে একজন (কালের কণ্ঠ, ৪ মে, ২০২১)।
৪. করোনায় কাজ হারিয়েছে ১০০ কোটির বেশি মানুষ (বাংলানিউজ টোয়েন্টিফোর, ২৩ জুলাই ২০২১)।
৫. দেশে চাকরি হারানোর তালিকায় দেড় কোটি মানুষ (সময় টিভি, ২০ এপ্রিল ২০২০)।
৬. করোনায় ১৩ ভাগ চাকরিজীবী বেকার হয়েছেন: বিআইডিএস (ডয়েচেভেলে, ২০ জুন ২০২০)।
এরকম আরও অসংখ্য সংবাদ পাওয়া যাবে।
করোনায় কাজহারানো মানুষদের নিয়ে অনুসন্ধান চালিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের ১৯ সদস্যের একটি গবেষক দল। বিভিন্ন উপাত্ত বিশ্লেষণের ভিত্তিতে তারা জানিয়েছে, মহামারির কারণে দেশে ২০২০ সালে কর্মসংস্থান হারিয়েছে ২৬ লাখের বেশি মানুষ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০ সালের এপ্রিল-মে মাসে শিল্প-কারখানা ও পরিবহন বন্ধ ছিল। অফিস-আদালত বন্ধের পাশাপাশি জনসমাগমেও ছিল নিষেধাজ্ঞা। সার্বিকভাবে অভ্যন্তরীণ শ্রমবাজারে এর বিরূপ প্রভাব দেখা গিয়েছে। কোভিডের প্রভাব সবচেয়ে বেশি দেখা গিয়েছে শিল্প খাতে।
আবার করোনার ধাক্কা কাটিয়ে উঠে দেশের পরিস্থিতি যখন স্বাভাবিক হতে শুরু করল তখন চাকরি বা কর্মহীন মানুষদের অনেকে কাজে ফিরতে পারলেও অনেকেরই পেশা বা কাজ বদলে গেছে। অনেকের আয় কমে গেছে। অসংখ্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে কর্মী যেমন ছাঁটাই করা হয়েছে, তেমনি অনেকের বেতন অর্ধেক বা এক তৃতীয়াংশে নেমে গেছে। অনেকে আয়-ব্যয়ের সঙ্গে সংগতি রাখতে ব্যর্থ হয়ে রাজধানী এবং বড় শহর ছেড়ে ছোট শহর বা গ্রামে ফিরে গেছেন। অনেকে সেখানে গিয়ে নানারকম বিকল্প উপায়ে জীবিকার সংস্থান করার চেষ্টা করছেন। সবাই যে সফল হচ্ছেন, তাও নয়।
এই যখন পরিস্থিতি তখন নতুন করে ভাবাচ্ছে ওমিক্রন এবং করনোর নতুন ধাক্কা। আগামী মার্চ-এপ্রিলে আবারও সংক্রমণ বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। গত ৩ জানুয়ারি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে হেলথ রিপোর্টার্স ফোরামের একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে মতবিনিময়ে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলম বলেন, এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসের সংক্রমণ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে এসেছে। তবে মার্চ-এপ্রিলে সংক্রমণ আবার বাড়তে পারে। সেই আশঙ্কা মাথায় রেখে আমরা জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোকে প্রস্তুত করতে কাজ করছি। জানুয়ারির মধ্যেই হাসপাতালগুলোকে প্রস্তুত করার লক্ষ রয়েছে।
এদিন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, টিকাকার্ড ছাড়া রেস্টুরেন্টে খাওয়া যাবে না। গণপরিবহনে যাত্রী চলাচলের ক্ষেত্রে নির্ধারিত আসনের চেয়ে কম যাত্রী পরিবহন করতে হবে এবং টিকা নেয়া থাকলেও মাস্ক পরে বাইরে বের হতে হবে।
করোনাভাইরাস ও এর সাম্প্রতিক ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রমন নিয়ে নতুন এসব উদ্বেগের পরিপ্রেক্ষিতে সবচেয়ে বড় যে প্রশ্নটি সামনে আসছে তা হলো- আবারও কি লকডাউন দেয়া হবে? প্রশ্নটি কোটি কোটি মানুষের মনে। কারণ তারা জানে, লকডাউনের মানে কী? জীবন সুরক্ষায় লকডাউন দেয়া হলেও তাতে জীবিকায় যে ভয়াবহ সংকট নেমে আসে, তখন দ্বন্দ্ব তৈরি করে ক্ষুধা ও স্বাস্থ্য।
করোনায় সংক্রমিত হলে মৃত্যুর শঙ্কা যা, বা করোনায় দেশে এ পর্যন্ত যত লোকের মৃত্যু হয়েছে; তার চেয়ে অনেক বেশি মৃত্যুর শঙ্কা যদি মানুষের জীবিকা অনিশ্চিত হয়। যদি খাদ্য কেনার পয়সা না থাকে কিংবা যদি সরকারি-বেসরকারি নানা মাধ্যমে খাদ্য সরবরাহের নিশ্চয়তা না থাকে।
মনে রাখা দরকার, প্রত্যেক মানুষেরই আত্মসম্মানবোধ আছে। ভিখারি ছাড়া কেউই অন্যের দয়ায় বাঁচতে চায় না। প্রত্যেকেই কাজ করে নিজের জীবিকা অর্জন করতে চায়। লকডাউনে কাজ বন্ধ থাকলে সরকারি ত্রাণ সহায়তায় ঘরের উনুন জ্বলবে— এমন প্রত্যাশা খুব বেশি মানুষ করে না। বরং অধিকাংশ মানুষই চায় কাজ করে খেতে। কিন্তু দীর্ঘ লকডাউন এবং করোনার সংক্রমণ বেড়ে গিয়ে কল-কারখানা এবং কাজের সুযোগ বন্ধ হয়ে গেলে যে কোটি মানুষের জীবনে অন্ধকার নেমে আসে, তা গত দেড় বছরে দেশের মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে।
সুতরাং, এই বিপুলসংখ্যক মানুষ আর লকডাউন চায় না। কিন্তু করোনা পরিস্থিতি যদি খুব খারাপ হয়ে যায় তখন কী হবে? সরকারের তরফে বলা হচ্ছে, এখনও কলকডাউনের পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। কিন্তু লকডাউনের পর্যায় পর্যন্ত যাতে না যেতে হয়, সে জন্য যে ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করা দরকার, তা কোথাও দৃশ্যমান নয়।
দুটি টিকা নেয়ার পরেই মানুষের মনে এই ধারণা বদ্ধমূল হয়েছে যে, করোনা তাদের স্পর্শ করবে না। যদিও চিকিৎসকরা বলছিলেন, টিকা নিলেও করোনা নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত মাস্ক পরাসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। কিন্তু এই বিধি এখন খুব সামান্য সংখ্যক মানুষই মেনে চলেন।
কয়েক দিন আগে কক্সবাজারে যে লাখ লাখ মানুষের সমাগম হলো, সেখানে কোনো স্বাস্থ্যবিধির বালাই ছিল না। খেয়াল করলে দেখা যাবে, এরকম বৃহৎ জনসমাগম এবং উৎসবের পরেই করোনার সংক্রমণ বেড়ে যায়। কিন্তু মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মানানো খুব কঠিন।
কেন গণমাধ্যমে এত প্রচারের পরও মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মানানো যায় না বা মানুষ কেন এত বেপরোয়া কিংবা উদাসীন, তার অনেক ব্যাখ্যা থাকতে পারে। তবে এর পেছনে একটা বড় কারণ বোধ হয় এই যে, বাংলাদেশের মানুষের শারীরিক সক্ষমতা তথা রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা তুলনামূলকভাবে বেশি। যে কারণে চিকিৎসার অপ্রতুলতা এবং নাগরিক উদাসিনতার পরও করোনায় যেরকম শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিল, সেরকম মৃত্যু হয়নি। বিশেষ করে সমাজের প্রান্তিক তথা শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে মৃত্যুহার কম বলে এরকম একটি ধারণা বা বিশ্বাস তৈরি হয়ে গেছে যে, গরিব মানুষের করোনা হয় না।
যে ধারণা ও বিশ্বাস তৈরি হোক না কেন, সমাজের কোনো স্তরের মানুষই আর লকডাউন চায় বলে মনে হয় না। কারণ লকডাউন সবাইকে ভোগায়। যার চাকরি বা কাজ হারানোর শঙ্কা নেই, কাজ না করলেও মাস শেষে যার অ্যাকাউন্টে বেতন চলে যাবে— তিনিও লকডাউন চান না। কারণ লকডাউন হলে দেশ প্রায় স্থবির হয়ে যায়। কেউই স্থবিরতা চায় না। কিন্তু করোনা যদি সত্যি সত্যিই আবার আরেকটা বড় ধরনের ধাক্কা দেয়, তাহলে হয়তো শেষ পর্যন্ত লকডাউনে যেতে হবে— যা কাঙ্ক্ষিত নয়। সুতরাং, লকডাউন ঘোষণার মতো পরিস্থিতি এড়াতে তথা সবকিছু খোলা রেখে স্বাভাবিক জীবন-যাপন নিশ্চিত করতে ন্যূনতম স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা জরুরি।
সরকারের তরফে বলা হচ্ছে, রেস্টুরেন্টে খেতে হলে টিকাকার্ড লাগবে। প্রশ্ন হলো, এটা কে নিশ্চিত করবে? হোটেল মালিক? তিনি তার ব্যবসার স্বার্থে এটা নিশ্চিত করবেন না। আবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষেও সারা দেশের সব হোটেল রেস্টুরেন্টে গিয়ে এটা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।
তার মানে এখানে মূল মেসেজ হচ্ছে সচেতনতা। নাগরিকরা যদি খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া রেস্টুরেন্ট এড়িয়ে চলেন এবং সামাজিক অনুষ্ঠানগুলো আপাতত সীমিত রাখেন; বাইরে ও গণপরিবহনে নিয়ম মেনে মাস্ক পরে থাকেন এবং হাত ধোয়া ও স্যানিটাইজ করার মতো সহজ বিধিগুলো মেনে চলেন— তাহলে হয়তো লকডাউন ঘোষণার মতো পরিস্থিতি এড়ানো যাবে।
বেপরোয়া মানসিকতা পরিহার এবং অপরের সুরক্ষার কথাও মাথায় রাখা দরকার। মনে রাখা দরকার, করোনা শুধু একজন ব্যক্তির সমস্যা নয়। এটা দ্রুতবিস্তারী এবং সর্বব্যাপী সমস্যা। অতএব, সমাজের প্রত্যেক মানুষের দায়িত্ব একে মোকাবিলায় দৃঢ় থাকা। আমরা কোনোভাবেই আর লকডাউন চাই না।
প্রত্যাশা এই যে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে সবকিছু চালু থাকবে। এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও পুরোদমে খোলা দরকার। সেজন্য সকল শিক্ষার্থীর টিকা এবং টিকা নেয়ার পরও স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করা জরুরি। অর্থাৎ লকডাউনের পরিস্থিতি যাতে তৈরি না হয়, সে বিষয়ে সচেতন থাকা দরকার। কারণ সময়ের কাজ সময়ে না করলে পরবর্তী সময়ে আহা উহু করে কোনো লাভ নেই।
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।