প্রায় দুই বছর বন্ধ থাকার পর গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানির ব্যাপারে দুই দেশের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরিত হয়েছে। বাংলাদেশের পক্ষে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী এমরান আহমদ এবং মালয়েশিয়ার পক্ষে সে দেশের মানবসম্পদমন্ত্রী এম সারাভানান সমঝোতা স্মারকটি স্বাক্ষর করেন। এর আগে ১০ ডিসেম্বর মালয়েশিয়ার মন্ত্রিসভা আগের জারি করা স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগের জন্য একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়।
এ চুক্তি অনুযায়ী ‘গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট’ (জিটুজি) ব্যবস্থাপনায় মালয়েশিয়ার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো জনশক্তি আমদানি করবে। ফলে অভিবাসনেচ্ছু শ্রমিকের অভিবাসন ব্যয় ১ লাখ টাকার নিচে চলে আসবে বলে দাবি করেছেন বাংলাদেশ সরকারের জনশক্তি রপ্তানি ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী এমরান আহমদ। নিয়োগের শর্তানুসারে, ঢাকা থেকে বিমান ভাড়াসহ মালয়েশিয়া পৌঁছানোর পর সব খরচ মালয়েশিয়ার নিয়োগকর্তারা বহন করবে। তবে একজন কর্মীকে পাসপোর্ট ফি, বিএমইটি ফি, কল্যাণ বোর্ডের সদস্য ফি ও চিকিৎসা ফি বহন করা ছাড়াও রিক্রুটিং এজেন্সির সার্ভিস চার্জ পরিশোধ করতে হবে।
বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে মালয়েশিয়ার সরকারের এ ধরনের চুক্তি আগেও হয়েছিল। তবে তখন মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি অভিবাসী পাঠানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের দুঃখজনক ব্যর্থতার নেপথ্যে দুই দেশের আদম বেপারিদের সংঘবদ্ধ অপতৎপরতা ছিল। জিটুজি প্লাসের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে কর্মী যেতে প্রথমে ৩৭ হাজার ৫০০ টাকা অভিবাসন ব্যয় নির্ধারণ করা হলেও পরে তা ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা করা হয়।
সিন্ডিকেটের কারণে প্রায় সব কর্মীই মালয়েশিয়া যেতে ৩ থেকে সাড়ে ৪ লাখ টাকা দিতে বাধ্য হয়েছিল। যার ভাগ তখন মালয়েশিয়ার চাকরিদাতা, এজেন্ট, লবিস্ট ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে বাংলাদেশের রিক্রুটিং এজেন্সি, এজেন্সির শহুরে দালাল এবং গ্রামীণ দালাল সবাই পেয়েছে।
এমনকি মালয়েশিয়া সরকার চাকরিদাতা ফার্ম থেকে বিদেশি শ্রমিক নিয়োগের জন্য যে লেভি আদায় করছে, তা-ও চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল এ দেশের শ্রমিকের ওপর।
এর মাধ্যমে দুই দেশের এজেন্টরা প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি হাতিয়ে নিয়েছে বলে মালয়েশিয়া সরকার তখন অভিযোগ করে। জিটুজি প্লাসে কর্মী পাঠানোর কাজ পেয়েছিল ১০টি রিক্রুটিং এজেন্সি। যারা সিন্ডিকেট হিসেবে চিহ্নিত হয়। এ অবস্থায় মালয়েশিয়া কর্মী নিয়োগের বিশেষ পদ্ধতি থেকে বাংলাদেশকে বাদ দেয়। ফলে শুরুতেই এবার সমঝোতা স্মারকে বিএমইটির ডাটাবেজ থেকে কর্মী সংগ্রহ করার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। নিঃসন্দেহে এটি একটি প্রশংসনীয় কাজ। এর ফলে কর্মী শোষণের বিদ্যমান ফাঁকফোকর অনেকাংশে বন্ধ করা সম্ভব হবে।
অন্যদিকে গতবারের মতো মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানোর প্রক্রিয়াকে এবারও কুক্ষিগত করতে চাইছে একটি সিন্ডিকেট চক্র। তাদের কতটুকু থামানো যাবে, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। কারণ গণমাধ্যমে খবর এসেছে, এবার বাংলাদেশের পরিবর্তে কৌশল পাল্টে সেই ‘সিন্ডিকেট’ হতে পারে মালয়েশিয়া থেকে।
অন্যদিকে অভিযোগ রয়েছে, গতবারের যে সিন্ডিকেট মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার নিয়ন্ত্রণ করেছিল, এবার সেই ১০ জনের তালিকা থেকে ছয়জনকে বাদ দেয়া হলেও বাকি চারজন রয়েছে ভিন্ন নামে। এ ছাড়া একই চক্র গতবারের ১০টি কোম্পানির পরিবর্তে এবার ২৫টি কোম্পানির মাধ্যমে কর্মী পাঠানোর অপকৌশলে নেমেছে।
মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে বাড়িঘর-আত্মীয়স্বজন ও ভাষা-সংস্কৃতি ছেড়ে যাওয়া প্রবাসী শ্রমিকরা এমনিতেই কষ্টে থাকে। বিশেষ করে করোনাভাইরাসের সংক্রমণে অভিবাসী শ্রমিক গ্রহণকারী প্রায় প্রতিটি দেশের অর্থনীতি কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ফলে যারা দেশের বাইরে গিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার জোগান দেয়, তাদের জীবনেও এক ধরনের অনিশ্চয়তার মেঘ দেখা দিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশের করোনা-উত্তরকালের নতুন নিয়মকানুনের কারণেও প্রবাসীরা চাকরিচ্যুত হওয়ার পাশাপাশি নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে।
এই পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়ে উঠেছিল গুরুত্বপূর্ণ শ্রমবাজার মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইনে দীর্ঘদিন ধরে কর্মী নিয়োগ বন্ধ থাকায়। দীর্ঘ চেষ্টার পর মালয়েশিয়ায় শ্রমবাজার নিয়ে যখন সুখবর মিলেছে তাই গতবারের মতো এবার যেন একই অবস্থা সৃষ্টি না হয়, সেদিকে শুরু থেকেই লক্ষ রাখা জরুরি।
পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, সরকারের চেষ্টা সত্ত্বেও আমাদের এখানে অভিবাসন প্রক্রিয়া এখনও পুরোপুরি নিরাপদ করা যায়নি। এখনও অবসান হয়নি হয়রানি-দুর্ভোগ ও বঞ্চনার। জাতিসংঘের মানবাধিকারসংশ্লিষ্ট ৯টি মূল সনদের একটি হলো- অভিবাসী শ্রমিক ও তাদের পরিবারের সদস্যদের রক্ষাসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সনদ।
সনদটি ১৯৯০ সালে গৃহীত হয় এবং ২০০৩ সালে কার্যকর হয়। অবাক করা বিষয় হলো, এ সনদের পক্ষভুক্ত ৫৫টি রাষ্ট্রের প্রায় সব কটিই অভিবাসী শ্রমিক প্রেরণকারী রাষ্ট্র। অর্থাৎ অভিবাসী শ্রমিক গ্রহণকারী বা নিয়োগকারী কোনো রাষ্ট্রই এ সনদে পক্ষভুক্ত হয়নি। যে কারণে সনদে বর্ণিত কোনো দায়-দায়িত্ব পালনেও তাদের ওপর বাধ্যবাধকতা আরোপ করা যায়নি।
বাংলাদেশ মূলত অভিবাসী শ্রমিক প্রেরণকারী দেশ। সনদের পক্ষভুক্ত একটি রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ দায়-দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট হলেও শ্রমিক গ্রহণকারী রাষ্ট্রগুলো তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন না করার ফলে এই শ্রমিকদের অধিকার পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না।
আরেকটি সমস্যা হচ্ছে অশিক্ষা ও অদক্ষতা। বেশির ভাগ অভিবাসী শ্রমিকই এখনও নিজেদের ন্যায্য প্রাপ্য ও অধিকার সম্পর্কে জানে না। চাকরিস্থল বা কাজের ধরন সম্পর্কে প্রকৃত তথ্যও জানতে পারে না অনেকে। এমনও হয়, তাদের অনেকে অনেক ক্ষেত্রে চুক্তির কাগজটিও হাতে পায় না। এ রকম অনিশ্চয়তার মধ্যে বিদেশ-বিভুঁইয়ে গিয়ে অনেকেই পড়ে চরম বিপদে।
প্রয়োজন তো বিধিনিষেধ মানে না। তাই ছুটছে মানুষ। জায়গা-জমি বিক্রি করে, সর্বস্বান্ত হয়ে। এমনকি ধারকর্জ করেও বিদেশে যাওয়ার জন্য দালালচক্রের খপ্পরে পড়ে প্রতারিত হচ্ছে অসংখ্য মানুষ। জনশক্তি-কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) হিসাবে, প্রতারণার শিকার ৫১ শতাংশের মধ্যে ১৯ শতাংশ মানুষ টাকা দেয়ার পরও বিদেশে যেতে ব্যর্থ হয়েছে। বাকি ৩২ শতাংশ প্রতারণার শিকার হয়েছে বিদেশে যাওয়ার পর।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের তথ্যমতে, গত বছরের এপ্রিল থেকে এক বছরে চাকরি হারানোসহ নানা কারণে দেশে ফিরেছে প্রায় পাঁচ লাখ প্রবাসী শ্রমিক। বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিদেশফেরত এসব শ্রমিকের ৫৩ শতাংশই দিনমজুরিসহ ছোট কোনো কাজে যুক্ত হয়ে জীবিকা উপার্জনের চেষ্টা করছে। বাকি ৪৭ শতাংশের আয়ের কোনো পথ নেই।
সংকটময় এই সময়ে প্রবাসীদের পাশে রাষ্ট্রসহ সবার থাকা জরুরি। কারণ যারা ফিরে এসেছে তাদের আর্থিক ক্ষতির কোনো শেষ নেই। এদের অনেকেই কমপক্ষে ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা লোন নিয়ে গিয়েছিল। সেই টাকা শোধ না হতেই ফিরে আসতে হয়েছে। অনেকেই আবার ফ্রি ভিসায় গিয়েছিল। ফলে তাদের কোনো নিয়োগকর্তাও নেই।
কাজ হারিয়ে ফেরা বিশাল এই প্রবাসী জনবলের দক্ষতা ও যোগ্যতা অনুসারে কর্মসংস্থান তৈরি করাও নিঃসন্দেহে অনেক কঠিন কাজ। গত বছর ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আরও কয়েকটি সংস্থার সহায়তায় এবং ব্র্যাকের উদ্যোগে বিদেশফেরত ৭ হাজার ২৫০ কর্মীকে নগদ অর্থ দেয়া হয়েছিল। প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় সরকারও ২০০ কোটি টাকা ঋণ হিসেবে দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল।
৪ শতাংশ সুদে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের মাধ্যমে ওই ঋণের অর্থ বিতরণের কথা বলা হয়েছিল, কিন্তু কাগজপত্রসংক্রান্ত জটিলতা ও নানা শর্তের বেড়াজালে তা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা যায়নি। তবে এবার রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে এককালীন আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি অন্য সমর্থনমূলক উদ্যোগও নেয়া হচ্ছে।
কিছু দিন আগে প্রধানমন্ত্রী এক সভায় বলেছেন- ‘প্রবাসীরা এত দিন অর্থ পাঠিয়ে দেশকে অনেক দিয়েছে, এবার তাদের দেবে দেশ। তাদের প্রয়োজনে যথাসম্ভব সবই করা হবে।’ প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় এর জন্য একটি প্রকল্পও গৃহীত হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় প্রয়োজনীয় পরামর্শ ছাড়াও প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের নতুন ব্যবসা শুরু করার জন্য স্বল্পসুদে ঋণ দেয়া হবে।
মনে রাখতে হবে, মানুষ খুব একটা দায়ে না পড়লে বাড়িঘর-আত্মীয়স্বজন ও ভাষা-সংস্কৃতি ছেড়ে অন্য দেশে পাড়ি জমায় না। যারা যায়, তারা নিতান্ত দায়ে পড়েই যায় কিন্তু অভিবাসী কর্মজীবীদের অভিজ্ঞতা মোটেও সুখকর নয়। ঘাম ও অশ্রু মেশানো রেমিট্যান্স সরবরাহ করে দেশের অর্থনীতিকে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করাতে বছরের পর বছর ধরে তারা ভূমিকা রাখছে। মহামারি করোনাভাইরাসের প্রকোপে তাদের অনেকেই বর্তমানে তীব্র আর্থিক ও মানবিক সংকটে।
করোনাকালে মানবিক সংকটে ভোগা এই অভিবাসী শ্রমিকদের প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী যেটা উপলব্ধি করেছেন, সেটা অনেকেরই মনের কথা। তবে সরকারের একার পক্ষে সবটুকু করা সম্ভব নয়। বেসরকারিভাবেও এ ক্ষেত্রে উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। তারা দেশকে অনেক দিয়েছে। এখন তাদের জীবনকে নিরাপদ ও স্বস্তিকর করে তুলতে কাজ করা উচিত সবার।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক