সম্প্রতি বঙ্গবন্ধুর জীবনচিত্র নিয়ে একটি গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি রচনা শেষ করেছি। সংশ্লিষ্ট ছবি সংগ্রহ করছিলাম বইটির জন্য। হঠাৎ মনে হলো বঙ্গবন্ধুর জন্ম এবং পূর্বপুরুষের কথা বলার সময় টুঙ্গিপাড়ার প্রাচীন বাড়িটির একটি ছবি দিতে পারলে খুব প্রাসঙ্গিক হতো। বছর কয়েক আগে বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আমন্ত্রণে আমি টুঙ্গিপাড়ায় গিয়েছিলাম। বলা হলো বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে শতাধিক বছরের পুরোনো ইমারত আছে।
অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে সংস্কার করতে গিয়ে নাকি এর ঐতিহ্যিক শৈলী নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। দেখে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ক্ষুব্ধতা প্রকাশ করেছেন। তাই সরকারের প্রধান স্থপতিসহ তিন চারজনের একটি টিম করা হয়েছে। আমরা দেখব বাড়িটিকে সঠিক রূপে ফিরিয়ে এনে সংস্কার করা যায় কি না। সে যাত্রায় আমি এই বাড়িটির কয়েকটি ছবি তুলেছিলাম। কিন্তু এখন এই প্রয়োজনের সময় এগুলো খুঁজে পাচ্ছি না।
অগত্যা গুগলের শরণাপন্ন হলাম। গুগলের এমন সাহায্য নেয়ায় সংকট আছে। একই শিরোনামে উল্টা পাল্টা ছবি দেয়ার ঘটনা ঘটে প্রায়ই। রক্ষা আমি স্বচক্ষে দেখে এসেছিলাম। এখন যতই টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর বাড়ি লিখে সার্চ করি ততই বঙ্গবন্ধুর সমাধি সৌধ আর তার পাশে ঝা-চকচকে একটি আধুনিক বাড়ির ছবি স্ক্রিনে ভাসছিল। এত সুন্দর আধুনিক বাড়িটি বেমানান লাগছিল সেখানে। আনেক খুঁজে লালচে রঙের সেই পুরোনো বাড়িটি পেলাম। ঐতিহ্যের গ্রন্থনা একে বলে। এই ইমারতটিই বঙ্গবন্ধুর পারিবারিক ঐতিহ্যকে ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে। ঐতিহ্যের শক্তি এমন প্রতীকেই আশ্রয় করে টিকে থাকে।
বেশ কয়েক বছর আগে পত্রিকায় লেখালেখি হচ্ছিল, নারিন্দার ঐতিহ্যবাহী কথিত ‘বিনত বিবির মসজিদ’ ভেঙে ফেলে বহুতল মসজিদ বানানো হচ্ছে। আমি আমার এক স্নেহভাজন স্থপতিকে নিয়ে ছুটে গেলাম। দেখি দুপাশের বর্ধিত অংশ ইতোমধ্যে ভেঙে ফেলেছে। মূল ঘরটি ভাঙার অপেক্ষায়। আমি মসজিদ কমিটির মুরব্বিদের সঙ্গে বসলাম। বললাম এই বখত বিনতের (শিলালিপি অনুয়ায়ী এটিই শুদ্ধ) মসজিদটি ঢাকায় টিকে থাকা একমাত্র সুলতানি যুগের মসজিদ। প্রায় ছয় শ বছর আগে নির্মিত হয়েছিল।
কমিটির সভাপতি বললেন, বাবা আমরা ঐতিহ্য বুঝি না। আমাদের বড় মসজিদ লাগবে। সুতরাং এই পুরাতনটি ভাঙতে হবে। আমি তাকে বিনয়ের সঙ্গে বললাম, এই মসজিদটি থাকলে আপনারা বলতে পারবেন, ঢাকা নগরে সবার আগে আপনাদের মহল্লায় মুসলিম বসতি হয়েছিল। যারা বলেন, মোগলরা ঢাকায় রাজধানী করার পর শহর হয়েছে আর মুসলমান বসতি গড়ে উঠেছে সে কথা ভুল প্রমাণ হবে। আমি মসজিদের গায়ে সাঁটা ফার্সি ভাষায় লেখা শিলালিপিটি পড়ে শোনালাম।
বললাম, এখন দেখুন এই মসজিদটি যতদিন দাঁড়িয়ে থাকবে, ততদিন বলতে পারবেন ঢাকায় সবার আগে মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে এখানে। এমন গর্ব আর কেউ করতে পারবে না। আর আমার এই আর্কিটেক্ট বন্ধু দেখিয়ে দিচ্ছেন কীভাবে মসজিদটি রেখেও পেছনে বহুতল মসজিদ বানানো যায়। এবার সত্তরোর্ধ সভাপতি মহোদয় ঐতিহ্যের গুরুত্ব বুঝলেন এবং তাৎক্ষণিক আদেশ দিলেন মসজিদটি যাতে না ভাঙা হয়।
গত সপ্তাহে আমার বাসায় এসেছিল স্নেহভাজন এক আর্কিটেক্ট দম্পতি। কথা প্রসঙ্গে মেয়েটি দুঃখ করে বলছিল স্যার, অনেক ক্লায়েন্ট বুঝতে চান না স্থাপত্য একটি শিল্প। কেউ কেউ বোম্বের শাহরুখ খান বা সিঙ্গাপুরের আধুনিক কোনো বাড়ির একটি ছবি তুলে নিয়ে আসেন। বলেন টাকা নিয়ে সমস্যা নেই- এমন একটি বাড়ি বানিয়ে দেবেন। শুনে আমি দুঃখ পাই। এদেশের ভৌগোলিক অবস্থা, পরিবেশ আর ঐতিহ্য ধারণ করে আমরা আমাদের শৈল্পিক চিন্তা সহযোগে বাড়ির নকশা তৈরি করি। কিন্তু এসব ধনীর ঐতিহ্য বোঝানো কঠিন। এরই কাছাকাছি আরেকটি কথা শুনলাম গত সপ্তাহে। গিয়েছিলাম বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে।
প্রাচীন গ্রিস ও রোমের ওপর একটি বক্তৃতা দেয়ার জন্য। অংশ নিতে আসা একটি মেয়ে দুঃখ করে বলল, তাদের গ্রামে একটি পুরোনো জমিদার বাড়ি ছিল। বিস্তর জায়গা পরে থাকলেও জঞ্জাল মনে করে বাড়ির এখনকার অর্থশালী মালিক ঐতিহ্যিক বাড়িটি ভেঙে আধুনিক ইমারত তৈরি করছে।
প্যারিসে গিয়ে তো আমি রোজ রোজ রাস্তা ভুল করতাম। সব রাস্তা একই রকম প্রশস্ত। হাইরাইজ আধুনিক ইমারত খুব কম চোখে পড়ে। একই রং ও নির্মাণশৈলীর বাড়িঘর। যেন ঐতিহ্যকে আঁকড়ে ধরে আছে প্যারিস শহরের বিশেষ অঞ্চলগুলো। পর্তুগাল, স্পেন, রোম সর্বত্রই দেখেছি কতটা যত্নে আগলে রেখেছে ঐতিহ্য।
এক ছাত্র বলল, স্যার ইংরেজ ঔপনিবেশিক যুগ তো শোষণের যুগ। সম্প্রতি ঢাকার খামার বাড়ির ঐতিহ্যিক লাল দালানটি ভেঙে ফেলার পর ঐতিহ্যমূর্খ কে নাকি বলেছে বা পত্রিকায় লিখেছে- এদেশে ব্রিটিশ ইমারত রাখার কোনা প্রয়োজন নেই। আমি ওকে বললাম, ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে তুমি কী মনে কর? বলল, না স্যার, আপনিই তো বলেছেন পরবর্তী প্রজন্মের কাছে কোনো বিশেষ পর্বের সমাজ-সংস্কৃতি, অর্থনীতি স্পষ্ট করতে সেসময়ে প্রত্নঐতিহ্য অতি যত্নে টিকিয়ে রাখতে হয়।
সেটি বন্ধুপর্ব বা শত্রুপর্ব যা-ই হোক। আর হীরক রাজার মতো ব্রিটিশ আমল শোষণের প্রতীক মনে করে সেসময়ের ইমারত ভেঙে নিশ্চিহ্ন করা কি কোনো সভ্য দেশের সভ্য মানুষের কাজ? তাহলে তো অনুপম স্থাপত্যশৈলী কার্জন হল ভেঙে ফেলতে হয়। ইংরেজরা কি শুধু শোষণই করেছে? তারা কি আধুনিক ইউরোপের সঙ্গে ভারত ও বাংলাকে যুক্ত করেনি? এযুগেই তো আমরা আধুনিক শিক্ষার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেছি। আর এভাবেই মধ্যযুগ থেকে উত্তোরণ ঘটিয়ে আধুনিক যুগে প্রবেশ করেছি।
ইতিহাসের এই গুরুত্বপূর্ণ জায়গাটিকে প্রজন্মের সামনে স্পষ্ট করার জন্যই ঔপনিবেশিক যুগের স্থাপত্য অনেক যত্নে টিকিয়ে রাখতে হয়। কলোনিয়াল স্থাপত্য বলে আমাদের একটি বিষয় পাঠদান করতে হয়। মোগল শৈলীর সঙ্গে ইউরোপীয় শৈলীর কেমন অনুপম মিশ্রণ ঘটেছে তা শিল্প ইতিহাস ও স্থাপত্যকলার শিক্ষার্থীরা মূল্যায়ন করে। ইংরেজ শাসনযুগের কী প্রভাব আমাদের শিল্প সংস্কৃতিতে পড়েছে তা বোঝার জন্যই এসব স্থাপত্য সযত্নে সংরক্ষণ করতে হয়। এখন যদি বলা হয় পাকিস্তানি শাসকরা আমাদের শোষণ করেছে, অত্যাচার করেছে তাই পাকিস্তানি যুগে নির্মিত আজকের সংসদ ভবন, কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন এসব ভেঙে ফেলব। তাহলে বিষয়টি কেমন হবে!
বাগদাদের বিখ্যাত মুসলিম দার্শনিক-বিজ্ঞানী, গণিতবিদ আল ফারাবি বলেছেন, ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার পর জ্ঞান মূর্খতায় রূপান্তরিত হয়। চারপাশ দেখে মনে হয় আমরা বোধ হয় মূর্খতার দিকেই ধাবিত হচ্ছি। না হলে দীর্ঘদিন চর্চা করে বিশেষ বিষয়ে যারা বিশেষজ্ঞ হিসেবে বিবেচিত হন তাদের সুচিন্তিত বিবেচনা বা সিদ্ধান্তকে থোড়াইকেয়ার করে ক্ষমতাবানরা সবজান্তা হয়ে যাচ্ছেন। ঐতিহ্য ধ্বংসের অগ্রনায়ক হচ্ছেন।
দুর্বল পাইলিংয়ের মধ্যে দাঁড়ানো ঝলমলে আকাশচুম্বী ইমারত বানিয়েছেন বাবা। বহিরাঙ্গ দেখে হয়তো সবাই প্রশংসা করছে। বাবা গত হয়েছেন। এখন ছেলের আমল। ভিত্তির দুর্বলতায় আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না ইমারতটি। মুখথুবড়ে পড়ে গেল। আমাদের সার্বিক উন্নয়নের জন্য ঐতিহ্যের প্রেরণা যে কত শক্তিশালী উন্নয়ন টেকসই করতে হলে তা আগে বুঝতে হবে।
প্রায় একযুগ আগের কথা। এদেশের অন্যতম প্রধান এক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য পড়াই। তখন অনেক প্রবাসীর ছেলেমেয়েরা গ্রাজুয়েশন করার জন্য দেশে আসত; অপেক্ষাকৃত সস্তায় এখানে পড়তে পারত বলে। ক্রেডিট ট্রান্সফার করে আবার ফিরে যেত। সেমিস্টারের শেষ ক্লাসটার নাম দিয়েছিলাম ‘ফিডব্যাক’। ওদের মতামত-মূল্যায়ন জানতে চাই। এমনি এক ক্লাসে এক ছাত্র ওর প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করল। পরে অনেক ছেলেমেয়েই এধারার প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছে।
ছেলেটি জানাল ওর জন্ম ইংল্যান্ডে। বাবা মা ওখানেই স্থায়ী হয়েছেন। গ্রাজুয়েশন করার জন্য এখানে এসেছে সে। আর একটি সেমিস্টার পর ওর এখানকার পড়া শেষ হবে। ফিরে যাবে ইংল্যান্ডে। অসংকোচে বললো ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সে অনেক ঐতিহ্যিক স্থাপনা দেখেছে, প্রত্ন ঐতিহ্য দেখেছে। আর নিজদেশ সম্পর্কে যে ধারণা পেয়েছে তাতে বিমর্ষ হয়েছে। ও মনে করেছে দারিদ্র্য ও অরাজকতায় নিষ্প্রভ বাংলাদেশ। এসবের কারণে দেশের প্রতি তেমন ভালোবাসা তৈরি হয়নি।
এই কোর্সটি শেষ করে ওর ভুল ভেঙে গেছে। দেখেছে শিক্ষা, সংস্কৃতি আর অর্থনীতির দিক থেকে ইউরোপীয়দের চেয়ে অনেক আগেই আমরা সভ্য হয়েছিলাম। ইউরোপীয়রা বরঞ্চ বার বার ছুটে এসেছে এদেশে। ক্লাস থেকে উদ্দীপ্ত হয়ে সে পাহাড়পুর, ময়নামতিতে গিয়ে বৌদ্ধ স্থাপত্য দেখে বিস্মিত হয়েছে। বাগেরহাটে গিয়ে সুলতানি মসজিদ স্থাপত্য দেখে অবাক হয়েছে। লালবাগ দুর্গ দেখেছে, দেখেছে কান্তজীর মন্দিরের অনুপম পোড়ামাটির অলংকরণ। আহসান মঞ্জিল, কার্জন হল ওকে মুগ্ধ করেছে। এবার সে তার কথার উপসংহার টানল। বলল স্যার, দেশকে আমি নতুন করে আবিষ্কার করলাম। বাবা মা অপেক্ষা করছে। আমাকে তো ফিরে যেতে হবে ইংল্যান্ডে। তবু আমি কথা দিচ্ছি শেষপর্যন্ত বাংলাদেশেই ফিরে আসব। এই দেশের জন্য আমারও কিছু করার আছে।
পাঠক, ভাববেন আজকের লেখা এতসব খণ্ডচিত্র দিয়ে ভরলাম কেন! আমার আসল বক্তব্যটি কী? বক্তব্য নয়- একটি আশঙ্কা থেকেই আমাকে লিখতে হলো। যেখানে আমরা প্রতিনিয়ত প্রত্যাশা করি হাজার বছরের উজ্জ্বল ঐতিহ্য ধারণ করে আছে এদেশ। এসব দেখেই প্রজন্ম প্রণোদিত হবে। দেশকে এগিয়ে নেয়ার সারথি হবে। কিন্তু আশঙ্কা এড়াতে পারি না। প্রতিদিন অজ্ঞতায়, লোভে ও দম্ভে আমরা ধ্বংস করছি আমাদের ঐতিহ্যের স্মারক প্রত্ন ইমারতগুলো। এসব রক্ষার প্রধান দায়িত্ব যাদের, তারাই যেন এসব রক্ষার গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারছেন না। বরং ধ্বংসের যুক্তি উপস্থাপন করছেন।
বছর দুই আগে ঢাকার একটি ঐতিহ্যিক ভবন ভেঙে বহুতল ভবন নির্মাণের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করতে গিয়ে সরকারের উচ্চতম মহল থেকে করা যে মন্তব্য টেলিভিশনে শুনেছিলাম এতে আতঙ্ক বোধ না করে উপায় ছিল না। এসব কারণেই নিবন্ধটি লিখতে হলো- যদি শক্তিমানরা নতুনভাবে ভাবার অবকাশ পান। অন্তত নতুন বছরকে সামনে রেখে আমরা চাই সংশ্লিষ্ট জনেরা শপথ নিন দেশের ঐতিহ্য সুরক্ষা করার।
লেখক: গবেষক। অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।