বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

শ্রদ্ধাঞ্জলি: বিচারপতি কেএম সোবহান

  • মোহাম্মদ শাহজাহান   
  • ৩১ ডিসেম্বর, ২০২১ ১৮:১৩

বিচারপতি সোবহান খুবই সাহসী মানুষ ছিলেন। তিনি মৌলবাদ, ধর্মান্ধ ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে বলনে-কথনে ও লিখনে সব সময় সোচ্চার ছিলেন। ২০০১ সালে বেগম খালেদা জিয়া ও নিজামীর নেতৃত্বাধীন ধর্মান্ধ জোট সরকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং বিরোধী রাজনীতিকদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালায়। এ সময় ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে ওই অত্যাচার-নির্যাতন ও খুন-খারাবির বিরুদ্ধে দুই দিনব্যাপী সম্মেলন হয়। তখন ওই সম্মেলনে সভাপতিত্ব করার জন্য কেউ সাহস করে এগিয়ে আসেনি। পরে বিচারপতি সোবহান সেখানে শুধু সভাপতিত্বই করেননি, কঠোর ভাষায় জোট সরকারের নির্যাতন-নিপীড়নের প্রতিবাদও করেছিলেন।

৩১ ডিসেম্বর দেশ ও জাতির আলোকিত সন্তান বিচারপতি কে এম সোবহানের ১৪তম মৃত্যুবার্ষিকী। বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার প্রতি মনেপ্রাণে শ্রদ্ধাশীল, বাঙালি জাতির চরম দুঃসময়ে স্বাধীনতা-মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তবুদ্ধি-গণতন্ত্র ও জাতির পিতার কথা বলার জন্য দেশের সর্বোচ্চ আদালতের সিনিয়র বিচারপতি কাজী মাহবুবুস সোবহান রাজপথে নেমে এসেছিলেন। আবেগপ্রবণ এই বাংলার মানুষ সেই দুঃসময়ের কথা কখনও ভুলতে পারবে বলে মনে হয় না।

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা ও মুক্তির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিবারের সদস্যসহ হত্যার পর রাষ্ট্রক্ষমতা দখলকারী স্বাধীনতাবিরোধী খুনিচক্র ৩০ লাখ শহীদ ও দুই লাখের অধিক মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশকে ‘মিনি পাকিস্তানে’ পরিণত করে। জাতির পিতার হত্যা-ষড়যন্ত্রের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত দেশের প্রথম স্বৈরশাসক জেনারেল জিয়াউর রহমানের শাসনামলে (১৯৭৫-১৯৮১) সে সময়ের বাংলাদেশ ও পরাজিত পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য ছিল না।

যেই বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে বাংলাদেশ সৃষ্টি হতো না, তাকেই তার সৃষ্ট বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করেন জেনারেল জিয়া। স্বাধীনতার প্রত্যক্ষ বিরোধী শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী এবং রাজাকার সর্দার মওলানা মান্নান, আবদুল আলীমসহ স্বাধীনতাবিরোধী আরও অনেককে স্পিকার, মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় উপদেষ্টা বানান জিয়াউর রহমান। জাতির পিতা হত্যার ৭৯ দিনের মাথায় স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পর রাষ্ট্রের প্রায় সব পর্যায়ের বড় বড় পদে স্বাধীনতাবিরোধী পাকিস্তানের দালালদের ক্ষমতায় বসানো হয়।

জিয়া, এরশাদ ও খালেদার ২৫ বছরের শাসনামলে বঙ্গবন্ধুসহ মুক্তিযুদ্ধের নাম-ঠিকানা পর্যন্ত মুছে ফেলার আয়োজন সম্পন্ন করা হয়েছিল। স্বাধীনতা-উত্তরকালে দেশ ও জাতির সেই অন্ধকার সময়ে আলোর মশাল নিয়ে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর হিসেবে আবির্ভূত হন আরও কিছু বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতিসেবীসহ বিচারপতি কে এম সোহবান।

সামরিক স্বৈরশাসকরা দুঃশাসনের প্রতিবাদকারী, সাহসী ও দেশপ্রেমিক মানুষদের একেবারেই পছন্দ করল না। বাংলাদেশের উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের মধ্যে অনেকেই অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী শাসকদের কুকর্ম সমর্থন করেছেন এবং ক্ষমতার অংশীদার হয়ে সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন। তবে ব্যতিক্রম ছিল। ভয়ভীতির মুখেও যারা অবৈধদের পক্ষ নেননি। সেসব কীর্তিমান বিচারপতিদের মধ্যে অন্যতম হলন বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ হোসেন, বিচারপতি কে এম সোবহান, বিচারপতি খায়রুল হকসহ আরও দু-চারজন।

জিয়া-এরশাদচক্র বিচারপতি সোবহানের দেশপ্রেম ও স্বাধীনচেতা মন-মানসিকতার কথা জানত। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি থাকাকালে জেনারেল জিয়া ১৯৮০ সালে বিচারপতি সোবহানকে বিচার বিভাগ থেকে সরিয়ে রাষ্ট্রদূত বানিয়ে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেন। আর স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদ ১৯৮২ সালের ১ জুন তাকে দেশে ডেকে এনে দুই সপ্তাহের মধ্যে আপিল বিভাগ থেকে অপসারণ করেন।

চাকরির বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে এসে ১৯৮২ সাল থেকেই রাজপথ-মানববন্ধন ও সভা-সমাবেশে উপস্থিত হয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং জাতির পিতা ও জাতীয় চার নেতা হত্যার তদন্ত ও বিচার দাবি করতে শুরু করেন। জাহানারা ইমাম, আবদুর রাজ্জাক, শাহরিয়ার কবির, মুনতাসীর মামুনসহ আরও অনেকের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বিচারপতি সোবহান একাত্তরের ঘাতক দালালদের বিচারের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলেন।

জিয়া ও খুনিচক্রের বানানো পূর্ব পাকিস্তানেই ১৯৮১-এর ১৭ মে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। স্বদেশে ফিরে শেখ হাসিনা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও পিতা হত্যার বিচারের দাবিতে আন্দোলন-সংগ্রাম শুরু করেন।

ওই সময়ে বিচারপতি সোবহানসহ কতিপয় বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিমনা ব্যক্তিরা বঙ্গবন্ধুকন্যার প্রতিবাদী আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে রাজপথে থেকে আন্দোলন করতে থাকেন। বঙ্গবন্ধু এবং তার কন্যার প্রতি শ্রদ্ধাশীল বিচারপতি সোবহান জাতির পিতার কোনো বিরূপ সমালোচনা সহ্য করতে পারতেন না।

তিনি সব সময় বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছি। এই দেশ-জাতি ও জনগণের জন্য বঙ্গবন্ধু এত বেশি অবদান রেখেছেন, এত বেশি কষ্ট ভোগ ও ত্যাগ স্বীকার করেছেন যে এর তুলনায় জাতির পিতার দু-একটা ছোটখাটো ভুল যদি হয়েও থাকে, তা তেমন কিছু নয়।

খুবই সাহসী মানুষ ছিলেন বিচারপতি সোবহান। তিনি মৌলবাদ, ধর্মান্ধ ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে বলনে-কথনে ও লিখনে সব সময় সোচ্চার ছিলেন। ২০০১ সালে বেগম খালেদা জিয়া ও নিজামীর নেতৃত্বাধীন ধর্মান্ধ জোট সরকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং বিরোধী রাজনীতিকদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালায়।

এ সময় ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে ওই অত্যাচার-নির্যাতন ও খুন-খারাবির বিরুদ্ধে দুই দিনব্যাপী সম্মেলন হয়। তখন ওই সম্মেলনে সভাপতিত্ব করার জন্য কেউ সাহস করে এগিয়ে আসেনি। পরে বিচারপতি সোবহান সেখানে শুধু সভাপতিত্বই করেননি, কঠোর ভাষায় জোট সরকারের নির্যাতন-নিপীড়নের প্রতিবাদও করেছিলেন।

বৃদ্ধ বয়সেও কর্মচঞ্চল মানুষ ছিলেন বিচারপতি সোবহান। শুধু ঢাকা নয়, বঙ্গবন্ধু-মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তবুদ্ধি ও স্বাধীনতা বিষয়ে আর ধর্মান্ধ অপশক্তির বিরুদ্ধে রাজধানীর বাইরেও অনেক সভা-সেমিনারে তিনি যোগদান করেছেন।

মুক্তবুদ্ধির চর্চা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও সামরিক স্বৈরশাসন ও সামাজিক অনাচারবিরোধী আন্দোলনে তিনি সব সময় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। বাংলাদেশে নিরীহ আহমদিয়া সম্প্রদায়ের ওপর জামায়াতে ইসলামী ও তাদের মৌলবাদী দোসরদের ধারাবাহিক হামলা-নির্যাতন এবং হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে তিনি সব সময় সোচ্চার ছিলেন।

হামলাকারীদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ-সমাবেশ ও রাজপথের মিছিলে তিনি সামনের সারিতে থেকেছেন। যেকোনো অপরাধের প্রতিবাদ করতে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও যখন-তখন ছুটে গেছেন। অসহায়-নিরপরাধ ও আক্রান্ত মানুষের ভরসা আর সাহসের প্রতীক ছিলেন এই মানবতাবাদী পুরুষ। ২০০৭-এর ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসে অসুস্থ বিচারপতি সোবহান জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে বঙ্গবন্ধু ভবনে গিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। কারাবন্দি বঙ্গবন্ধুকন্যার জন্মদিনে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানাতে সাব-জেলের গেটেও ছুটে গেছেন তিনি।

আরেকবার ক’বছর আগে ঢাকায় সংখ্যালঘু নির্যাতন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে প্রচণ্ড রোদের মধ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে মানববন্ধন কর্মসূচি পালনের সময় রাস্তায় ঢলে পড়েন। ধরাধরি করে তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়। হাসপাতালে গিয়ে জ্ঞান ফিরে পাওয়ার পর পাশের লোকদের বললেন- ‘খবরদার, আমার বাসার কাউকে জানাবেন না। তাহলে মিছিলে আসা আমার বন্ধ হয়ে যাবে।’ হাসপাতাল থেকে বাসায় গিয়ে আবার প্রতিবাদ সভা ও মিছিলে হাজির হয়েছেন। মাঝেমধ্যে খোঁজখবর নেয়ার জন্য বাসায় ফোন করলে তার সহধর্মিণী কিছুটা ক্ষোভের সঙ্গে বলতেন- ‘আপনাদের স্যার কারও কথা শুনেন না। অসুস্থতা ওনার কাছে কোনো বিষয় নয়। সভা-সমাবেশের ডাক আসলে তিনি কাউকে কিছু না বলে ঘর থেকে বের হয়ে যান।’

এভাবে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ক্লান্তিহীনভাবে সব অন্যায়-অত্যাচার ও অবিচার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে আর মানবতার সপক্ষে তিনি কাজ করে গেছেন। তিনি বাংলাদেশ-রাশিয়া মৈত্রী সমিতির সভাপতি থাকাকালে এ দেশের বহু ছেলেমেয়ে রাশিয়ার বৃত্তিতে সে দেশে পড়েছে। তিনি ছিলেন সমগ্র জাতির একজন অভিভাবক। তার মৃত্যু দেশ ও জাতির জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। দেশের ক্রান্তিকালে যখন তার প্রয়োজন ছিল বেশি, ঠিক তখনই আট বছর আগে ২০০৭-এর ৩১ ডিসেম্বর তিনি সবাইকে ছেড়ে গেছেন।

লেখক: মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক, সিনিয়র সাংবাদিক।

এ বিভাগের আরো খবর