বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

সিপিবির রাজনৈতিক দলিল বনাম ভিন্ন বাস্তবতা

  •    
  • ৩০ ডিসেম্বর, ২০২১ ১৯:০৬

সিপিবি ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ‘সৎ ও দক্ষ’ সরকার গঠনের দাবি জানিয়েছিল। তবে সেই সৎ ও দক্ষ ব্যক্তি কোথায় পাওয়া যাবে তার কোনো নির্দেশনা তাদের ছিল না। আবার বঙ্গবন্ধুও আওয়ামী লীগের দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়া নেতাকর্মীদের ব্যাপারে কঠোর হতে পারেননি। কারণ, তিনি মনে করতেন, বিপদের সময় ওই নেতাকর্মীরাই তার সঙ্গে ছিলেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গণতন্ত্র এবং সমতার নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। পাকিস্তানি শাসকদের অগণতান্ত্রিক ও বৈষম্যমূলক শাসনের বিরুদ্ধে বছরের পর বছর লড়াই-সংগ্রাম করেছেন, জেল-জুলুম সহ্য করেছেন। জীবনের একটি বড় সময় কেটেছে তার কারাগারে। নিজের পরিবার, স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদের কথা না ভেবে, তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা না করে তিনি ভেবেছেন দেশের সব মানুষের কথা, তাদের অধিকারের কথা, সুখ ও নিরাপদ জীবনের কথা।

সেজন্যই তিনি বঙ্গবন্ধু হয়েছেন, হয়েছেন জাতির পিতা। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিন বছর যেতে না যেতেই তিনি কেন বহুদলীয় গণতন্ত্রের পথ থেকে একদলীয় শাসনের দিকে আগ্রহী হয়ে উঠলেন, সেটা কি শুধু শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য, নাকি এর পেছনে আরও কোনো ‘রাজনীতি’ ছিল?

বাকশাল কি একটি সাময়িক ব্যবস্থা ছিল, নাকি ক্ষমতা কুক্ষিগত করার স্থায়ী পদক্ষেপ? এসব প্রশ্নের আসল উত্তর জানা সম্ভব হবে না কোনোদিন। কারণ এ নিয়ে বঙ্গবন্ধুর নিজের কোনো বয়ান নেই।

তবে ১৯৭৫ সালে যে বঙ্গবন্ধু এক দল করলেন তা নিয়ে নানা বিভ্রান্তিকর প্রচারণা আছে। তার একটি হলো কমিউনিস্ট পার্টির প্ররোচনায় তিনি বাকশাল গঠন করেছিলেন। আসলে কি তাই? বঙ্গবন্ধু তো কারো কথায় প্রভাবিত হয়ে কোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেননি। তিনি অনেকের কথা শুনতেন, কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতেন নিজেই। বাকশাল করার সিদ্ধান্ত তিনি নিজের বুঝ-বিবেচনা থেকেই নিয়েছিলেন, সেটা হওয়াই স্বাভাবিক।

সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বছর দুয়েক আগে বলেছিলেন: “১৯৭৫ সালে সিপিবি ‘একদলীয় ব্যবস্থা’ তথা ‘বাকশাল’ গঠন না করার জন্য বঙ্গবন্ধুকে আনুষ্ঠানিকভাবে পরামর্শ দিয়েছিল। তিনি পার্টির পরামর্শ গ্রহণ করেননি। এমতাবস্থায়, ‘বাকশাল’ গঠিত হয়ে যাওয়ার পরে পার্টিকে প্রকাশ্যে ‘বিলুপ্তির’ ঘোষণা দিতে হলেও আসলে পার্টি বিলুপ্ত করা হয়নি।

খুবই গোপনে, অনেকটা সংকুচিত আকারে, পার্টির অস্তিত্ব ও তার কাঠামো বহাল এবং সক্রিয় রাখা হয়েছিল। কিন্তু স্বাভাবিক কারণেই সে কথা প্রকাশ করা হয়নি। এমনকি অনেক পার্টি সদস্যকেও সে বিষয়টি অবগত করে ওঠা সম্ভব হয়নি। গোপনীয়তার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ধীরে-ধীরে পার্টি কাঠামো সম্প্রসারিত করা হচ্ছিল। এরকম একটা ‘হার্ড কোর’ আগাগোড়া গোপনে সংগঠিত ছিল বলেই ১৫ আগস্টের পর সব পার্টি সদস্যদেরকে তাই দ্রুত পার্টি কাঠামোতে সংগঠিত করা সম্ভব হয়েছিল।”

আমার জানা মতে, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ভুল তথ্য দেননি। তবে এতদিন পরে এসে এ সত্য প্রকাশ কেন জরুরি মনে হয়েছে কমরেড সেলিমের, প্রশ্ন সেটাই। বাকশাল সম্পর্কে আমাদের দেশে অনেকের মধ্যেই বিরূপতা আছে। সেটা ‘ক্যাশ’ করার জন্যই কি এই সত্য প্রকাশ? কিন্তু এই বক্তব্য প্রচারের পর রাজনীতিসচেতন অনেকের প্রতিক্রয়া দেখে বোঝা গিয়েছিল, কমরেড সেলিম সত্য প্রকাশ করতে গিয়ে ভুল বার্তা দিয়েছেন মানুষের কাছে। এটাও সিপিবি রাজনীতির এক ট্র্যাজেডি যে, দলটি যা বলতে চায়, মানুষ সেটা না বুঝে বোঝে উল্টোটা।

বাকশাল প্রশ্নে সিপিবির ভেতর এবং বাইরের অবস্থান সবার জানার কথা নয়। সিপিবি বঙ্গবন্ধুকে বাকশাল না করার পরামর্শ দিলে তা দিয়েছিল গোপনে, আর বাকশালের পক্ষে অবস্থান ছিল প্রকাশ্য। এমনকি তখনও এমন প্রচার ছিল যে, সিপিবির পরামর্শেই বঙ্গবন্ধু একদলীয় ব্যবস্থায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তখন এই প্রচারণার বিরোধিতা সিপিবি করেনি, বরং এক ধরনের অহংকার তাদের ছিল যে, বঙ্গবন্ধুর মতো নেতাও তাদের ‘পরামর্শ’ শুনে ‘সিদ্ধান্ত’ নেন।

এ ব্যাপারে আমার একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা না বললেই নয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার বছর দেড়েক পর একটি ঘরোয়া বৈঠকে আওয়ামী লীগের নেত্রী সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মোহাম্মদ ফরহাদকে বলেছিলেন, সিপিবির পরামর্শ শুনে বাকশাল করেই বঙ্গবন্ধুকে জীবন দিতে হলো।

মোহাম্মদ ফরহাদ জবাবে বলেছিলেন, এমন কথা দয়া করে বলবেন না। কারণ তাতে বঙ্গবন্ধুকে ছোট করা হয়। এতে মানুষের মনে হতে পারে যে, বঙ্গবন্ধু নিজের বুদ্ধিতে নয়, অন্যের বুদ্ধিতে চলতেন। সাজেদা চৌধুরী আর কিছু না বলে চুপ করেছিলেন।

এটা ঠিক যে, বাকশাল গঠনের সময় কমিউনিস্ট পার্টি প্রকাশ্যে বিলুপ্ত করা হয়েছিল, আবার একটি গোপন কাঠামোও রাখা হয়। এটা দেশে দেশে অবস্থা বিবেচনায় কমিউনিস্ট পার্টির একটি কৌশল। গোপন এবং প্রকাশ্য- দুই ধারায় কাজে তারা অভ্যস্ত। আবার এই কৌশলের কথা পার্টির সবাই জানেন না, জানেন নীতিনির্ধারক কয়েকজন।

কমিউনিস্টরা অন্য দলে ঢুকেও কাজ করে, পরিস্থিতি নিজেদের অনুকূলে না থাকলে। সময়মতো আবার আত্মপ্রকাশের সুযোগ হাতে রাখে। বাকশালের ক্ষেত্রে হয়তো তেমন হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে সমাজতন্ত্রের পথে যেতে চেয়েছিল সিপিবি। সিপিবির ত্যাগ-দেশপ্রেম নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সংশয় ছিল না। কিন্তু তাদের জটিল তত্ত্ব ও প্রায়োগিক কৌশল নিয়ে বঙ্গবন্ধুর মনে প্রশ্ন ছিল। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তেও তার সরাসরি উল্লেখ আছে। সিপিবির কথা শুনলে বাংলাদেশ স্বাধীন করা কঠিন হতো- মনে করতেন বঙ্গবন্ধু।

সিপিবি মুক্তিযুদ্ধের সময় দলিল রচনা করেছিল যে, ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হইবে'। ওই দলিল ছাপাখানায় থাকতেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যায়। কাজেই সিপিবির দলিলে কি লিপিবদ্ধ আছে সেদিকে দৃষ্টি না দিয়ে বাস্তবে কী ঘটেছে সেটাই দেখা উচিত। প্রসঙ্গত বলে রাখা দরকার যে, সিপিবি মুক্তিযুদ্ধের সময় দলের নাম লিখত ‘পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশের) কমিউনিস্ট পার্টি। পার্টির নাম এমন রাখা নিয়েও কম বিভ্রান্তি (হাসাহাসি) হয়নি।

স্বাধীন বাংলাদেশে সিপিবি বঙ্গবন্ধুর সরকারের প্রতি ‘ঐক্য ও সংগ্রামের’ নীতি গ্রহণ করেছিল। ভালো কাজে সমর্থন, খারাপ কাজের বিরোধিতা। কিন্তু মানুষ সামনে দৃশ্যমান হয়েছে ঐক্যটাই, সংগ্রামটা সেভাবে দেখা যায়নি। অর্থাৎ মানুষ সমর্থনটাই দেখেছে, বিরোধিতা চোখে পড়েনি। তাই সংগ্রামের জায়গাটি দ্রুত দখল করে নেয় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল বা জাসদ– বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্লোগান দিয়ে আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে যাওয়া একদল বিভ্রান্ত মানুষ।

সদ্য স্বাধীন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটাকে উগ্র সরকারবিরোধী রাজনীতির নামে ক্রমশ গভীর খাদের কিনারে নিয়ে যেতে বড় ভূমিকা পালন করেছে জাসদের হঠকারী রাজনীতি।

সিপিবি ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ‘সৎ ও দক্ষ’ সরকার গঠনের দাবি জানিয়েছিল। তবে সেই সৎ ও দক্ষ ব্যক্তি কোথায় পাওয়া যাবে তার কোনো নির্দেশনা তাদের ছিল না। আবার বঙ্গবন্ধুও আওয়ামী লীগের দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়া নেতাকর্মীদের ব্যাপারে কঠোর হতে পারেননি। কারণ, তিনি মনে করতেন, বিপদের সময় ওই নেতাকর্মীরাই তার সঙ্গে ছিলেন। আওয়ামী লীগ থেকে তিনি নিজেকে আলাদা করলে আওয়ামী লীগ দুর্বল হবে কিন্তু তিনি শক্তিশালী হবেন না।

একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু বাকশাল গঠন করেছিলেন। কিন্তু বাস্তবে বাকশাল ছিল আওয়ামী লীগেরই সম্প্রসারিত রূপ। অথচ বাকশাল নিয়ে সিপিবির উচ্ছ্বাস ছিল চোখে পড়ার মতো। আমি সিপিবির প্রধান নীতিনির্ধারণী নেতা কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুবাদে অনেক তথ্য জানি, যা থেকে আমার ধারণা হয়েছিল, সিপিবির নির্ভরতা ছিল বঙ্গবন্ধুর ওপর, তার দল আওয়ামী লীগের ওপর নয়।

বঙ্গবন্ধু নিহত না হলে, বাকশাল টিকে গেলে সিপিবি নিঃসন্দেহে ‘ক্রেডিট’ দাবি করত, কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর যে রাজনৈতিক সংকট তৈরি হয় তাতে সিপিবি কিছুটা দিশাহারা হয়েছিল তাতে সন্দেহ নেই। কারণ এমন ঘটনা প্রত্যাশিত ছিল না। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর বাকশাল ব্যাপকভাবে সমালোচিত হওয়ায় সিপিবি গা থেকে বাকশালের গন্ধ মুছতে তাড়াহুড়া করতে গিয়ে কিছু ‘উল্টাপাল্টা’ কাজ করে বসে।

তারা জিয়াকে ‘সীমিত অর্থে জাতীয়তাবাদী’ বলে তকমা দিয়ে তার ‘খালকাটা’ কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছে। কিন্তু তাতে লাভ হয়নি। জিয়া সিপিবির বিরুদ্ধে তোপ দাগতে ভুল করেননি। নেতাদের গ্রেপ্তার করে পার্টির কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছিলেন মিলিটারি শাসক জিয়া। পার্টির সভাপতি, প্রবীণ কমিউনিস্ট নেতা মণি সিংহ এবং সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ফরহাদসহ অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। মোহাম্মদ ফরহাদের বিরুদ্ধে দেয়া হয়েছিল রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা। জিয়ার মৃত্যুর পর সে মামলা প্রত্যাহার করা হয়।

সিপিবি একসময় আওয়ামী লীগের ‘বি-টিম’ বলে পরিচিতি পেয়েছিল। তারপরও তখন দলটির স্ফীতি ও বিস্তার ঘটছিল। তারপর মোহাম্মদ ফরহাদের অকাল মৃত্যু, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ইত্যাদি ঘটনা সিপিবির জন্য কঠিন এক দুঃসময় নিয়ে আসে। একপর্যায়ে সিপিবি ভেঙে যায়। সিপিবি ছেড়ে কেউ কেউ আওয়ামী লীগ, গণফোরাম এমনকি বিএনপিতে যোগদান করেন। সিপিবি নামে যারা থাকেন তারাও পার্টির রাজনৈতিক নীতি-কৌশলের পরিবর্তন আনেন।

এখন সিপিবি স্বাধীন অবস্থানের নামে আওয়ামী লীগ থেকে দূরত্ব রেখে চলছে। আর আমাদের দেশের রাজনীতির একটি স্বাভাবিক প্রবণতা হলো আওয়ামী লীগ থেকে দূরে মানে প্রতিক্রিয়াশীলতার কাছে। সিপিবি এখন সে জায়াগায় আছে বলেই কমরেড সেলিম আকস্মিকভাবে ‘বাকশাল’ বিতর্ক সামনে এনে সুফল পেতে চেয়েছিলেন বলে কারো কারো মনে হয়েছে। কিন্তু তা হয়নি। উল্টো অনেকেই সিপিবিকে ভুল বুঝেছে। সিপিবির নেতারা আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে আপদ ও বিপদ বলে উল্লেখ করেন। কিন্তু মুসিবত হলো মানুষ সিপিবিকে তাদের আস্থায় নিচ্ছে না।

সমাজতন্ত্র বা বামধারার রাজনীতির পালে হাওয়া লাগার বাস্তবতা বাংলাদেশে আর কখনও আসবে বলে আশাবাদ প্রকাশ করতেও এখন অনেকে ভরসা পান না। তাই সিপিবির লালঝান্ডা আকাশে উড্ডীন হবে, মানুষ দলে দলে সিপিবির পক্ষে মিছিলে শামিল হবে সেটা এখন অনেকটাই কষ্টকল্পনা। তাহলে বৈষম্যমুক্ত সমতার সমাজ প্রতিষ্ঠার লড়াই কি আর অগ্রসর হবে না? এ প্রশ্নের এক কথায় উত্তর দেয়ার যোগ্য নেতৃত্ব কি সামনে দেখা যাচ্ছে?

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক।

এ বিভাগের আরো খবর