দুর্নীতি এমন একটি শব্দ, যার পক্ষে নীতিগতভাবে পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত কোনো মানুষ দাঁড়িয়েছে বলে আমার জানা নেই। মানবসভ্যতার সমবয়সি দুর্নীতি মনুষ্যজীবনের সব নেতিবাচক কর্মের চালিকাশক্তি। আকণ্ঠ দুর্নীতিতে নিমগ্ন ব্যক্তিও বলেন- ‘আমি দুর্নীতিকে ঘৃণা করি’। আসলে দুর্নীতির পক্ষে কোনো যুক্তি নেই- নৈতিক অবস্থান নেই। পৃথিবীতে এমন কোনো রাষ্ট্র-সমাজ, গোত্র-পেশা নেই- যেখানে দুর্নীতি নেই।
মানবসভ্যতার বিকাশের নানা পর্যায়ে দাসপ্রথা, সামন্ত সমাজ পুঁজিবাদের উত্থান, সমাজতান্ত্রিক সমাজ, কল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা- কত কিছুইতো মানুষকে স্বপ্ন দেখিয়েছিল। কিন্তু দুর্নীতিমুক্ত থাকতে পেরেছে কি? গণতন্ত্র-সামরিক শাসন, একনায়কত্ব-ধর্মীয় শাসন, রাজা-বাদশাদের খেয়াল-মর্জির শাসন- কতই বাকচাতুর্যে মানুষকে বোকা বানাতে চেয়েছে।
শুধু দুর্নীতির ভয়াবহ অভিযোগে পৃথিবীর দেশে দেশে কত শাসকের পতন হয়েছে- তা ইতিহাসের ছাত্রমাত্রই জানার কথা। অমাদের এ ভূখণ্ডেও দুর্নীতির বিস্তৃতি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। আমরা পরস্পরকে দোষারোপ করছি বটে- কিন্তু নিজে কি ‘ধোয়া তুলসী পাতা’? আসলে দুর্নীতি কী? এর স্বরূপ কি আমাদের কাছে স্পষ্ট? অনৈতিক এবং বেআইনি পথে আর্থিক সুযোগ-সুবিধা দেয়া-নেয়াই কি শুধু দুর্নীতি? নাকি সামজে যা কিছু অনৈতিক, বেআইনি এবং মানুষের কল্যাণবিরোধী- তার মূলে রয়েছে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সুবিধা আদায়।
আমি মনে করি, এই সুবিধা আদায়ের আয়োজন, প্রচেষ্টা এবং মাধ্যমই হলো দুর্নীতি। অর্থ লেনদেন দুর্নীতির অন্যতম মাধ্যম হলেও একমাত্র মাধ্যম নয়। চাকরিতে নিয়োগ, প্রমোশন, রাজনীতিতে পদায়ন, উপহার, ব্যবসা-বাণিজ্যে সুযোগ-সুবিধা, ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বেআইনি ঋণদান, পাঁচতারকা হোটেল বড় বড় ক্লাবের টেবিলে সম্পাদিত সমঝোতা সমাজে অনিয়ম ও দুর্নীতি প্রসারে বড় ভূমিকা রাখছে। আমরা এসব দেখেও না দেখার ভান করছি।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকায় এক সমাবেশে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ঘৃণার সংস্কৃতি গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন। তার এ বক্তব্যের দুটো দিক আছে। প্রথমটি হলো- তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণার পরও এর মূলোৎপাটন করতে পারছেন না। কারণ, এরা রাষ্ট্র ও সমাজে প্রতিপত্তিশালী। আর সে কারণে তিনি মনে করছেন- সামাজিকভাবে যদি প্রতিরোধ গড়ে তোলা না যায়, মানুষ যদি এদের ঘৃণা করতে না শেখে- তবে এই অপশক্তির দৌরাত্ম্য কখনোই স্বাভাবিক মাত্রায় আনা যাবে না। আইন ক্ষমতার চাইতেও জনগণের ঘৃণার শক্তি ব্যাপক, বিস্তৃত এবং সুদূরপ্রসারী। এই ঘৃণার শক্তিকে সমাজের সর্বস্তরে জাগিয়ে তুলতে হলে অপ্রিয় কিছু সত্য উচ্চারণে ভয়কে জয় করতে হবে।
ক. আমার বিবেচনায় সমকালীন বিশ্বে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করাই হলো দুর্নীতি প্রসারের প্রধান হাতিয়ার। আমাদের দেশের দিকেও যদি তাকাই, এর যথার্থতা খুঁজে পেতে জ্ঞানী হওয়ার দরকার নেই। অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী নিজেদের অবস্থানকে মজবুত করার জন্য সমাজের বিভিন্ন অংশ থেকে প্রতিপত্তি এবং নীতিহীন মানুষদের নানা লোভ দেখিয়ে ক্ষমতার অংশীদারত্ব প্রদান করেন।
ক্ষমতায় থেকে রাজনৈতিক দল গঠন করার জন্য অর্থ-বিত্ত, ব্যবসা-বাণিজ্য, পদপদবি দিয়ে সমাজে পরিচিত এবং আদর্শহীন রাজনীতিবিদ, সমাজপতি এবং পেশাজীবীদের ক্রয় করা হয়। রাজনীতিকে কলুষিত করার জন্য এটা হলো সবচাইতে বড় দুর্নীতি। এই ধারার দুর্নীতি রাষ্ট্র এবং সরকারকাঠামোকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে। দেশের তরুণদের সামনে নীতি-নৈতিকতা এবং সামাজিক মূল্যবোধের স্খলন জাতির ভবিষ্যতকে ধোঁয়াটে করে দেয়।
খ. রাজনৈতিক দলের উদ্দেশ্য জনকল্যাণে দেশশাসন করা। যদিও প্রত্যেক দলেরই স্বতন্ত্র রাজনৈতিক মতাদর্শ এবং রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি রয়েছে। সেসব নীতিতে জনমত, জনস্বার্থ এবং জনকল্যাণের বাইরে কোনো কথা লিপিবদ্ধ থাকে না। রাজনীতি হলো মহৎ কাজ। দেশ এবং জনগণের স্বার্থে নিজেকে নিবেদন করা। আমাদের দেশ শুধু নয়, ভারতবর্ষের গত দুশ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা এর সত্যতা খুঁজে পাই। আমাদের দেশের বড় রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি দৃষ্টিনিবদ্ধ করলে ইদানীং ভিন্ন চিত্র খুঁজে পাওয়া যায়। কিছু নীতিহীন, সুবিধাবাদী লোক বিভিন্ন পর্যায়ে পদ দখল করছেন এবং অনেকে স্থানীয় সরকার ও জাতীয় নির্বাচনেও মনোনয়ন পাচ্ছেন। আমাদের সমাজে এটি মনোনয়ন বাণিজ্য নামে পরিচিত। রাজনৈতিক দলে এ প্রবণতা আদর্শহীনতা এবং দুর্নীতি ছাড়া আর কিছু নয়।
গ. দেশে ভালো এবং মন্দ দুধরনের লোকই রয়েছে। রাষ্ট্রের উন্নয়ন পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বড় বড় সরকারি, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে প্রকল্প ও প্রাক্কলন তৈরি এবং তা বাস্তবায়নে যে দুর্নীতি সংঘটিত হয়, তা কি কারো অজানা? অনৈতিক সমঝোতায় বিলম্ব ও দায়িত্বহীনতার কারণে প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা ও অতিরিক্ত ব্যয়ের দায় কে গ্রহণ করবে?
ঘ. বিস্তৃত, গ্যাস ও পানির বিলে সিস্টেম লসের অজুহাতে যে ব্যাপক দুর্নীতি সংঘটিত হয়, তা রোধ করা কি একেবারেই অসম্ভব? অতিরিক্ত বিল, ভুয়া বিল এবং সমঝোতার বিলের বিষয়ে অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে অনৈতিক কিছু মানুষ যুক্ত থাকে- তাদেরও শাস্তির আওতায় আনা বাঞ্ছনীয়।
ঙ. সাধারণ মানুষ আয়কর দিতে চায়। কিন্তু এর পদ্ধতিগত জটিলতা ও ভীতি দূর করা গেলে এ খাতে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ বাড়বে। কিন্তু কালোটাকার মালিক, বড় অসৎ ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি, অসৎ কর্মকর্তাদের সঙ্গে অনৈতিক সমঝোতা গড়ে এ খাতে ব্যাপক দুর্নীতির আশ্রয় নেয়। যার ফলে রাষ্ট্র বিপুল পরিমাণ কর আদায় থেকে বঞ্চিত হয়। আমদানি-রপ্তানি খাতেও এ দুষ্টুচক্র সক্রিয় রয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর জেটিতে বেওয়ারিশ লাশের মতো স্তূপীকৃত দাবিদারহীন বিপুলসংখ্যক আমদানিপণ্য এর প্রমাণ।
চ. আমাদের বিচারব্যবস্থার বিভিন্ন পর্যায়ে স্বচ্ছতার প্রশ্নে নানা অভিযোগ রয়েছে। অর্থ-বিত্ত-ক্ষমতার প্রভাব এবং ভয়ভীতির কারণেরও বিচারপ্রক্রিয়া প্রভাবিত হওয়ার অভিযোগ পুরোনো। মামলার ক্ষেত্রে পুলিশি তদন্ত, ডাক্তারি পরীক্ষা, ও ময়নাতদন্তে দুর্নীতির প্রভাব রয়েছে। নিম্ন আদালতে বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি ব্যাপক। দেশের প্রধান বিচারপতি অভিযুক্ত হওয়ার পর আদালতের নিরপেক্ষতা ও ন্যায়বিচার প্রশ্নের সম্মুখীন।
ছ. শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রেও অনৈতিক আচরণ এবং দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। শ্রেণিকক্ষে যথাযথ পাঠদান না করে শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়তে বাধ্য করাও একধরনের দুর্নীতি। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পছন্দের শিক্ষার্থীকে বেশি নম্বর বা উচ্চশ্রেণি দেয়া এবং শিক্ষক নিয়োগে নিরপেক্ষ ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন না করা দুর্নীতির বহিঃপ্রকাশ মাত্র। শিক্ষাব্যবস্থায় পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণ ও দুর্নীতি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেবে।
জ. সাংবাদিকতা একটি মহৎ পেশা, গণতন্ত্রের ভিত্তি এবং জনগণের কণ্ঠস্বর। কিন্তু কিছু সাংবাদিকের জন্য আজ এ পেশাও বিতর্কিত। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে অন্যায়ভাবে সুযোগ-সুবিধা নিয়ে ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধার, সন্ত্রাসী ও মাদকব্যবসায়ী এবং কালো টাকার সিন্ডিকেটদের রক্ষায় কৌশলি ভূমিকা পালন এ পেশায় কালিমালেপন করে। আদর্শবান সাংবাদিক মানুষের বন্ধু আর হলুদ সাংবাদিকরা অপকর্মের সহযোগী।
ঝ. থানা-পুলিশ এবং স্থানীয় সরকার-ব্যবস্থায় নির্বাচিত প্রতিনিধি, বিশেষ করে উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, মেম্বার, মেয়রের স্বচ্ছতা নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে। গ্রামীণ অবকাঠামো নির্মাণ এবং সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা-বেষ্টনীর আওতায় দরিদ্র, কর্মহীন, বয়স্ক, বিধবা, আশ্রয়হীন এবং দুর্যোগ ও আপৎকালীন সরকারি অর্থ ও খাদ্যসামগ্রী বিতরণে দুর্নীতির নানা অভিযোগ গণমাধ্যমে নিয়মিত প্রকাশিত হয়। গ্রামাঞ্চলে সালিশি-ব্যবস্থার প্রতি একসময় মানুষের বেশ আস্থা ছিল। বর্তমানে মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং সমাজের দুষ্ট প্রকৃতির লোকজন এই সালিশি প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় প্রকৃত ভুক্তভোগীরা অনেকক্ষেত্রে ন্যায়বিচার প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়। সালিশে জামানত রাখার নামে শোষণের এক নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে।
ঞ. আমাদের দেশে বেশ কিছু বেসরকারি সংস্থা রয়েছে। এই সংগঠনগুলো প্রধানত, বিদেশি সাহায্যে পরিচালিত হয়। জনকল্যাণ, মানবাধিকার, পিছিয়ে পড়া শ্রেণির আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য তারা নানামুমী কর্মতৎপরতা পরিচালনা করে থাকে। সাধারণ্যে এ ধারণা রয়েছে যে, এই সংগঠনগুলো বিদেশ থেকে প্রচুর পরিমাণ অর্থ আনলেও গরিব মানুষের উন্নয়নের জন্য তার সামান্যই ব্যয় হয়। প্রাতিষ্ঠানিক এবং পরিচালনা ব্যয়ের নামে এর সিংহভাগই অধিকাংশ এনজিও উদ্যোক্তারা আত্মসাৎ করেন। এসব সংগঠনের নেতৃত্ব নির্বাচন-প্রক্রিয়া এবং আয়-ব্যয়ের হিসাব জনসমক্ষে প্রকাশিত নয়। আবার অনেক সংগঠনের গোপন রাজনৈতিক এজেন্ডা আছে বলেও বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। তবে ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়।
চ. সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনেও যে দুর্নীতি ঢুকে পড়েনি, তা নয়। সরকারি-বেসরকারি আর্থিক সুবিধা নেয়ার জন্য প্যাড-সর্বস্ব সংগঠনও প্রত্যক্ষ করা যায়। আবার ক্ষমতাধর ও প্রশাসনের দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিদের যোগসাজশে অশিল্পীদের সুবিধা আদায় এবং বেসরকারি সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি দলের নামে বিদেশে আদম পাচারের ঘটনার সংবাদও বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
দেশের গুরুত্বপূর্ণ কিছু খাতের অনৈতিক ও দুর্নীতির বিষয়ে এ নিবন্ধে কিছুটা আলোচনার চেষ্টা করা হলো। বাস্তবে সমাজের এমন কোনো অংশ নেই, যেখানে দুর্নীতির হাত প্রসারিত নয়। তবে সমাজের সব পেশার ক্ষেত্রেই ভালো-মন্দ আছে। নীতি-আদর্শবান লোকের সংখ্যাই বেশি
কিন্তু দুষ্টলোকের ক্ষমতা বেশি। তারাই সমাজকে দাবিয়ে রাখতে চায়। রাজনীতির ক্ষেত্রেও আদর্শবান এবং ত্যাগীরা থাকে অবহেলিত। আত্মসম্মান এবং অভিমান তাদের বড় সম্পদ। দুর্নীতির এই দুষ্ট ক্ষত থেকে রাষ্ট্র এবং সমাজকে রক্ষা করতে হলে আমাদেরকে প্রথমত নিরপেক্ষভাবে আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতেই হবে।
সব রাজনৈতিক দলকে দুর্নীতিবাজদের প্রশ্রয় না দেয়ার ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করতে হবে। রাজনীতিবিদ, আমলাসহ সমাজের সব অংশের দায়িত্বপ্রাপ্তদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। সমাজের সর্বস্তরে দুর্নীতির আগ্রাসন থেকে রক্ষা পেতে হলে এর বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচারণা ও সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। দুর্নীতিবাজদের ঘৃণা এবং সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। দুর্নীতিবাজের কোনো দল নেই। সে দেশের শত্রু, সমাজের শত্রু, মানবতার শত্রু। দেশ-কালভেদে এরা রং পাল্টায়, দল পাল্টায় কিন্তু চরিত্র পাল্টায় না। অতএব সাধু সাবধান!
লেখক: গবেষক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব