বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

দাম্পত্য ও বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে কিছু কথা

  • জেসমিন সুলতানা   
  • ২৮ ডিসেম্বর, ২০২১ ১৮:৫৬

বিভিন্ন কোর্ট থেকে বাবা-মা ১৫ দিনের জন্য যখন ছোট সন্তানকে তাদের নিজ হেফাজতে নিয়ে যায়, তখন শিশুদের করুণ মানসিক অবস্থা অনেকেই অনুভব করতে পারবে না। তারা দুজনকেই ভালোবেসে যেতে চায়, একসঙ্গে জীবন কাটাতে চায়। বাবা-মা অধিকাংশ ক্ষেত্রে নতুনভাবে সংসার গড়ে নেয়। অপরদিকে অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকে সন্তান।

বিবাহ একটি বৈধ চুক্তি, যার মাধ্যমে দুজন নর-নারী দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপন করে। কখনও পারিবারিক সম্মতিতে আবার কখনও নিজেদের পছন্দে। দেশ-কাল-পাত্র ও ধর্ম-বর্ণভেদে বিবাহের আনুষ্ঠানিকতা এবং আনুষাঙ্গিকতা অনেকটা ভিন্ন হয়।

সবচেয়ে সহজ পদ্ধতিতে বিবাহ হয় ইসলাম ধর্মে, যা অনেকটা এমন- ‘উঠ ছুড়ি, তোর বিবাহ লেগেছে, বরকনে পছন্দ হলো, কাজি ডাকো, নাম ঠিকানা বলো, কেউ একজন জিজ্ঞেস করো রাজি? বলো কবুল! হলো বিবাহ। পরে কাজি অফিসে গিয়ে বিবাহ রেজিস্ট্রেশন, যা বাধ্যতামূলক। আবার তালাকের বেলায় সিটি করপোরেশনে নোটিশ, ৯০ দিন অপেক্ষা, তালাক কার্যকর। তালাক রেজিস্ট্রেশনও বাধ্যতামূলক।

হিন্দু ধর্মে স্থান, প্রথা ও আচারগত ভিন্নতা আছে। ছাদনাতলায় সাতপাকে বাঁধা, অগ্নিসাক্ষী, মন্ত্রপাঠ করে বিবাহ। বিচ্ছেদ নেই। তবে ভারতে কারণ দেখিয়ে অনুমতি নিয়ে বিচ্ছেদ হচ্ছে।

বৌদ্ধ ধর্মে এলাকা ও রীতিনীতিতে ভিন্নতা থাকলেও বিবাহ মন্দিরে কিংবা অন্যকোথাও বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মাধ্যমে মন্ত্রপাঠ করে বিবাহ হওয়ার প্রথা চালু আছে। বিচ্ছেদের বেলায় বিবাহের কারণ দেখিয়ে কোর্ট থেকে তালাক হয়।

সবচেয়ে সুন্দর রীতি খ্রিস্টান ধর্মীয় বিবাহের অনুষ্ঠানে। তাদের বিবাহ সাধারণত চার্চে অনুষ্ঠিত হয়। আগে থেকেই বরকন্যার ঠিকানা জানিয়ে নোটিশ দেয়া হয়। কারো কোনো মন্তব্য বা আপত্তি থাকলে জানাতে বলা হয়। পরে চার্চে বিবাহর আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়। দুজনের কল্যাণে বিবাহ রেজিস্ট্রেশন করা বাধ্যতামূলক। আর বিবাহবিচ্ছেদ করা যায় আদালতে ডিক্রির মাধ্যমে।

বিবাহ জীবনের জন্য নানাভাবেই গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে নারী-পুরুষ একত্রে বৈধভাবে স্বামী-স্ত্রী বন্ধনে আবদ্ধ হয়। গড়ে তোলে পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন। সবাই চায় বিবাহিত জীবন সুখের হোক, দুজন মিলে স্বাচ্ছ্যন্দে জীবন কাটাতে সফল হোক।

বিধিবাম হলে বিবাহের পর নারী-পুরুষ যেমন সংসার শুরু করে, তেমনি অনেক সময় দেখা যায় বিচ্ছেদের ঘণ্টাধ্বনি বেজে গেছে। কেন বিচ্ছেদ, কেনইবা সংসার করা সম্ভব হয়ে ওঠে না? আইনজীবী হিসেবে দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে গিয়ে আমার দেখা কিছু কারণ তুলে ধরছি অভিজ্ঞতার আলোকে।

শারীরিক অক্ষমতা

শারীরিক অক্ষমতা, যৌনব্যাধি আর যৌনবিকারগ্রস্ত সঙ্গী বিবাহবিচ্ছেদের একটি অন্যতম কারণ। এটি লজ্জা কিংবা গোপন করার বিষয় নয়। বিবাহ-বন্ধনের অন্যতম বিষয় হলো- স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য মিলন। প্রকারান্তরে সন্তান গ্রহণ। সমাজে প্রায়ই দেখা যায় শিক্ষিত কিংবা অশিক্ষিত বাবা-মা তাদের সন্তান যৌন সম্পর্ক স্থাপনে অক্ষম জানা সত্ত্বেও সন্তানকে বিবাহের আসরে বসিয়ে দেন। বাসর রাতেই অক্ষম স্বামীর হিংস্রতার শিকার হয় মেয়েটি। কখনও পরিবারকে এই লজ্জাজনক কথাটি জানাতে বাধ্য হয়, কখনওবা গোপনে চিকিৎসা চালিয়ে ব্যর্থ চেষ্টা করে বিচ্ছেদের পথ বেছে নেয়।

যৌতুক

যৌতুক একটি ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধি। যৌতুক নিরোধ আইন ২০১৮ অনুসারে বর বা কনে যেকোনো পক্ষের কাছে যৌতুক দাবি অপরাধ হিসেবে গণ্য। যৌতুকের জন্য স্বামী ও তার পরিবারের সদস্যদের অত্যাচার-নিপীড়ন ও নির্যাতনের শিকার হয় নারী। কখনও যৌতুকের বলি হয়ে মৃত্যুবরণও করার দৃষ্টান্ত সমাজে কম নয়। যৌতুক দাবি কিংবা নির্যাতনের কোনো বয়স বা সময় নেই। ৩৫ বছরের সংসারও ছেড়ে আসতে দেখা যায় নারীকে বিবাহবিচ্ছেদের মাধ্যমে।

বাল্যবিবাহ

বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭ অনুসারে মেয়েদের ক্ষেত্রে ১৮ ও ছেলেদের ২১ বছরের কম বয়সের বিবাহকে বাল্যবিবাহ হিসেবে গণ্য করা হয়। সম্প্রতি করোনাকালে বাল্যবিবাহ বেড়েছে ভয়াবহ হারে। স্কুল বন্ধ, বাবা-মা ১৮ বছরের কম বয়সি মেয়েকে বিবাহ দিয়েছে অনেকটা ঝঞ্ঝামুক্ত হওয়ার জন্য। ছোট ছেলেমেয়েরা অনেকে নিজে পছন্দ করে পালিয়ে গিয়েও বিবাহ করে ফেলে। নাবালিকা কন্যা বিবাহের পর তার লালিত স্বপ্ন আর বাস্তবতার মাঝে যখন মিল খুঁজে পায় না, যখন তার স্বপ্ন ও প্রত্যাশা ভেঙে যায়; তখনই বেছে নেয় বিবাহবিচ্ছেদের মতো সিদ্ধান্ত।

বহুবিবাহ

একজন নারী তার স্বামীকে একা পেতে চায়। স্বামীর ভাগ কোনোভাবেই কাউকে দিতে চায় না। অনেক সময় দেখা যায় স্বামী গোপনে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ। সংসারের প্রতি স্বামীর দায়িত্বহীনতা আর উদাসীনতা নারীটিকে কাঁদায়। সংসার-সন্তান থাকা সত্ত্বেও অনেক সময় স্বামীর বহুবিবাহ মেনে নেয়া অনেক স্ত্রীর পক্ষে সম্ভব হয় না। ফলে নেয় বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত।

পরকীয়া

বর্তমানে যুগের একটি খারাপ দিক হলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সম্পর্ক-স্থাপন। ফেসবুক-ম্যাসেঞ্জার, ভাইবার-হোয়াটসঅ্যাপ ও ইমো ইত্যাদি সহজলভ্য হওয়ায় সবাই অতি সহজেই পেয়ে যাচ্ছে নতুন সঙ্গী। ফলে পরকীয়ায় জড়িয়ে যাচ্ছে অনেক নারী-পুরুষ। গড়ে তুলছে এক্সট্রা-ম্যারিটাল সম্পর্ক। নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই এটি প্রযোজ্য। অন্যপুরুষ বা নারীতে আসক্ত পরিবারে অশান্তি-অবিশ্বাস ও নির্যাতন নিত্যদিনের ঘটনা৷ একসময় উভয়পক্ষ বিবাহবিচ্ছেদের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়।

মাদকাসক্তি

যার স্বামী-সন্তান, স্ত্রী বা পরিজন মাদকাসক্ত সে জানে মাদকের ভয়াবহতা। বিবাহবিচ্ছেদের জন্য আসা অধিকাংশের কাছ থেকে জানা যায়, মাদকাসক্ত কোনো ব্যক্তি আর মানুষ থাকে না। অমানুষে পরিণত হয়। নারী বা পুরুষ হয়ে যায় হিংস্র। শারীরিক-মানসিক নির্যাতনে প্রকট হয়ে ওঠে দাম্পত্য জীবনে।

দেশের প্রচলিত আইনে শারীরিক নির্যাতন অপরাধ। এর শাস্তির বিধান আছে কিন্তু মানসিক নির্যাতনের কোনো শাস্তি নেই। সহ্যক্ষমতার বাইরে চলে গেলে বিচ্ছেদের পথ বেছে নেয় ক্ষতিগ্রস্ত নারী। এছাড়া স্বনির্ভর ও আত্মসচেতন নারীরা এখন আর বাইরে কাজ করে এসে পারিবারিক নির্যাতন বা সহিংসতা মেনে নেয় না। ফলে বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেয়।

বিপথগামী স্বামী-স্ত্রী ও বহুগামিতা

স্বামী-স্ত্রী দুজন দুজনকে সন্দেহ করা একটি মানসিক ব্যাধি। সন্দেহ যখন বাস্তবতায় রূপ নেয়, তখন অসুস্থ আবহাওয়ায় না থেকে বিবাহবিচ্ছেদের মতো সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়। বহুগামী নারী-পুরুষ আর মানুষের চরিত্র ধারণ করতে পারে না। সুতরাং পঙ্কিলতা থেকে বেরিয়ে বিবাহবিচ্ছেদকে সঠিক পথ ভেবে বিচ্ছেদ বেছে নেয় ভুক্তভোগী।

অনধিকারচর্চার প্রবেশ

অনেক পরিবারে দেখা যায় বিবাহের পর পরিবারের অনেকে দম্পতির ব্যাপারে অনধিকারচর্চা করে। আত্মীয়স্বজন বা মুরব্বিদের কেউ কেউ নিজেদের মতো দম্পতির সংসার নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। এতে একসময় তিক্ততা চলে আসে, যা বিবাহবিচ্ছেদের পথ খুলে দিতে পারে।

ধৈর্যহীনতা

আধুনিক যুগের ছেলেমেয়েরা একেবারেই ধৈর্যহীন। সামান্য বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দিলে তারা সংসার নির্বাহ করতে চায় না। হুট করে বিবাহবিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। সব কিছুতে থোড়াই কেয়ার। সহ্য করার ক্ষমতা নেই বলে সামান্য কারণে ছেলেমেয়েরা বিচ্ছেদের পথ বেছে নেয়। বিবেক, সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধের তোয়াক্কা করে না।

বিবাহবিচ্ছেদ রোধের উপায়

বিবাহ থেকেই বিচ্ছেদের উৎপত্তি। সব ধর্ম-বর্ণের লোকের কাছে বিবাহবিচ্ছেদ নেতিবাচক। বাবা-মায়ের বিচ্ছেদের পর সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সন্তান। তাদের নীরব কান্না শোনার বা দেখার সময় কারো থাকে না। বাবা-মায়ের বিচ্ছেদে অনেক সময় সন্তান মানসিকভাবেও ভারসাম্যহীন হয়ে যায়। মানসিক বিষণ্নতা ও অবসাদ তাদের আচ্ছন্ন করে রাখে।

বনিবনা হবে না জেনেও কেন সন্তান ধারণ করা? সন্তান তার বৃদ্ধির জন্য বাবা-মা দুজনকেই চায়। দুজনের নির্মল স্নেহ-ভালোবাসা পেতে তাদের হৃদয় উন্মুখ থাকে। ব্রোকেন ফ্যামিলির সন্তানদের দুঃখ-বেদনা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ জানে না। সুন্দর-স্বাভাবিক জীবনে বড় হতে পারে না বলে পরবর্তী জীবনেও এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। বিভিন্ন কোর্ট থেকে বাবা-মা ১৫ দিনের জন্য যখন ছোট সন্তানকে তাদের নিজ হেফাজতে নিয়ে যায়, তখন শিশুদের করুণ মানসিক অবস্থা অনেকেই অনুভব করতে পারবে না।

তারা দুজনকেই ভালোবেসে যেতে চায়, একসঙ্গে জীবন কাটাতে চায়। বাবা-মা অধিকাংশ ক্ষেত্রে নতুনভাবে সংসার গড়ে নেয়। অপরদিকে অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকে সন্তান।

বিবাহবিচ্ছেদের যেমন কারণ থাকে, সংসার সুখের করতেও তেমনি কিছু বিষয় মেনে চলা প্রয়োজন। সমস্যার পাশাপাশি উত্তরণেরও অনেক উপায় আছে। দাম্পত্যকলহের উদ্ভব হলে প্রথমেই দুজনের উচিত একসঙ্গে উদ্ভবের কারণ চিহ্নিত করে সমাধানের চেষ্টা করা। ব্যক্তি সচেতনতা-সহনশীলতা ও সমঝোতা করে বিশ্বাসের ভিত শক্ত করা। শান্তি-সুখ ও ভালবাসার নীড় সাজানোর জন্য উভয়কেই ছাড় দিতে হয়। পরস্পরের প্রতি সহনশীলতা, বিশ্বস্ততা ও শ্রদ্ধাবোধ থাকা জরুরি।

করোনা পরিস্থিতি মানুষের দূরত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে ঠিক। সমাজের কথা, সামাজিকতার কথা এবং পরিবার তথা সন্তানের কথা ভেবে ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হয়। বর্তমানে সিটি করপোরেশন ও ইউনিয়ন পরিষদগুলোতে বিবাহবিচ্ছেদ বেড়েই চলেছে।

প্রতিদিনই বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন পড়ে। এ সংবাদ পরিবার-সমাজ তথা দেশের মানুষের জন্য সুখকর হতে পারে না।

অনেকেই আইনবিধি ও নিয়মকানুনের ধারেকাছে না গিয়ে নোটিশ গোপন করে ৯০ দিন পর বিচ্ছেদের ঘোষণা দিচ্ছে। স্বামী বা স্ত্রী বিদেশে অবস্থান করছে; বিদেশে তালাক ঘটানো ব্যয়বহুল তাই দেখা যায়, এক ফাঁকে দেশে এসে গোপনে তালাক দিয়ে একজন আরেকজনকে প্রতারিত করছে। অনেকে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে এমনকি নোটারি পাবলিকের কার্যালয়ে বে-আইনি ও নিয়মবহির্ভূতভাবে তালাক প্রদান করছে।

বর্তমানে বাংলাদেশে বিবাহ ও তালাক দুটোরই ডিজিটালাইজেশন জরুরি। বিবাহ হলে অনলাইন যেমন জানতে পারবে, বিচ্ছেদ হলেও অনলাইনে বিষয়টি অবহিত করা প্রয়োজন। বাংলাদেশের প্রতিটি সিটি করপোরেশন ও ইউনিয়ন পরিষদে বিবাহ রেজিস্ট্রেশন আর তালাক রেজিস্ট্রেশন অনলাইন হওয়া সময়ের দাবি। এতে করে প্রতারিত হওয়ার মাত্রা কমে যাবে। যা নারী-পুরুষ দুপক্ষের জন্যই মঙ্গলজনক ও কল্যাণকর।

লেখক: অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।

এ বিভাগের আরো খবর