বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

মুক্তিযোদ্ধা তালিকা: ৫০ বছরেও কেন স্পষ্ট নয়

  • দীপংকর গৌতম   
  • ২৪ ডিসেম্বর, ২০২১ ১৫:০৩

যেসব বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম এমআইএসে যুক্ত হয়েছে, তাদের কোনো তথ্যে ভুল থাকলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে তা সংশোধন করার সুযোগ দিয়েছে। এ ছাড়া কোনো ভুলের কারণে ভাতা থেকে কোনো বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম বাদ পড়লে তা সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে আবেদন করতে বলেছে মন্ত্রণালয়। কিন্তু এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ও আবেগজড়িত বিষয় কি ছেলেখেলা? কারা এদের মুক্তিযোদ্ধা বানাল? কারাইবা নাম কাটছে? সেটা আমরা জানি না। কিন্তু ঘটনাটি যে গর্হিত তা ভেবে দেখার সময় এসেছে।

চলছে বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। দেশ মাতৃকার জন্য মরণপণ লড়াই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে এসেছিল আমাদের স্বাধীনতা। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্ণ হলেও যে রূপ দেখছি তা রীতিমতো হতাশাজনক।মুক্তিযোদ্ধাদের বয়স সম্পর্কে মুক্তিযুদ্ধ-বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ২০১৮ সালের পরিপত্র অনুযায়ী, ১৯৭১ সালের ৩০ নভেম্বর যেসব বীর মুক্তিযোদ্ধার ( গেজেটভুক্ত) বয়স ন্যূনতম ১২ বছর ৬ মাস ছিল, তাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বিবেচনা করা হবে। সে হিসাবে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার ন্যূনতম বয়স হবে সাড়ে ৬১ বছর। কিন্তু সম্প্রতি শীর্ষস্থানীয় একটি দৈনিকে প্রকাশ হয়েছে- জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য অনুযায়ী, তাদের কারো জন্ম ১৯৮২ সালে, কারো আবার ১৯৯১ সালে।

এরপরও তাদের নাম রয়েছে ভাতাপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায়। এমন প্রায় দুই হাজারের তথ্য পেয়েছে মুক্তিযুদ্ধ-বিষয়ক মন্ত্রণালয়, যাদের জন্ম (পরিচয়পত্রের তথ্যে) মুক্তিযুদ্ধের পরে। ভুলে এমনটি হয়েছে, নাকি অনিয়ম–জালিয়াতি করে কারো কারো নাম বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় ঢুকেছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। মন্ত্রণালয় বলছে, প্রায় দুই হাজার জনের বয়স ৫০ বছরের কম হওয়ার কারণ কী, তা তদন্ত করে দেখা হবে। তবে এতজনের বয়সের তথ্য ভুল হওয়ার বিষয়টি মানতে নারাজ নির্বাচন কমিশন।

নির্বাচন কমিশনের জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ সাইদুল ইসলামের বক্তব্যের বরাত দিয়ে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে যে, বিষয়টি যতটা সাদামাটা ভাবা হচ্ছে, ততটা নয়। দু-একজনের ভুল হতে পারে।

জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের কর্মকর্তাদের জানার কথা নয় কার বয়স কত। জন্মসনদ, নাগরিকত্ব সনদসহ যেসব কাগজপত্র দেয়া হয়, তার ভিত্তিতেই জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি হয়। অনেকেই চাহিদা অনুযায়ী বয়স কমান, বাড়ান। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষেত্রে একজনের কাগজ আরেকজন ব্যবহার করে জালিয়াতি করতে পারেন (?)। যদি মন্ত্রণালয় তালিকা পাঠায়, তাহলে বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হবে।

জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য এবং সরকার অনুমোদিত বীর মুক্তিযোদ্ধার তালিকা যাচাই করেই ভাতাপ্রাপ্ত সব বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম গত অক্টোবরে সরকার ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) নামের একটি সফটওয়্যারে যুক্ত করে। নাম অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেয়া হয় লাল মুক্তিবার্তা, ‘ভারতীয় তালিকা’ এবং ‘গেজেট’। এতে দেখা গেছে, ১ লাখ ৯২ হাজার বীর মুক্তিযোদ্ধাকে ভাতা পাঠানো হতো। কিন্তু এমআইএসে তাদের নামসহ অন্যান্য তথ্য অন্তর্ভুক্ত করার পর সংখ্যাটি ১ লাখ ৭১ হাজার হয়ে যায়। এখন এই ১ লাখ ৭১ হাজারের মধ্যে প্রায় দুই হাজার বীর মুক্তিযোদ্ধার বয়সে গড়মিল পেয়েছে মন্ত্রণালয়।

পরিচয়পত্র অনুযায়ী, যাদের বয়স ৫০ বছরের নিচে। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা এখন মাসিক ১২ হাজার টাকা ভাতা (২০১৯ সালের জুলাই থেকে) পাচ্ছেন। এর আগে ছিল ১০ হাজার টাকা। এর মধ্যে দুই ঈদে ১০ হাজার টাকা করে ২০ হাজার টাকা, ৫ হাজার টাকা বিজয় দিবসের ভাতা এবং ২ হাজার টাকা বাংলা নববর্ষ ভাতা পান বীর মুক্তিযোদ্ধারা। বছরে একজন সব মিলিয়ে ভাতা পান ১ লাখ ৭১ হাজার টাকা।

যেসব বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম এমআইএসে যুক্ত হয়েছে, তাদের কোনো তথ্যে ভুল থাকলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে তা সংশোধন করার সুযোগ দিয়েছে। এ ছাড়া কোনো ভুলের কারণে ভাতা থেকে কোনো বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম বাদ পড়লে তা সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে আবেদন করতে বলেছে মন্ত্রণালয়। কিন্তু এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ও আবেগজড়িত বিষয় কি ছেলেখেলা? কারা এদের মুক্তিযোদ্ধা বানাল? কারাইবা নাম কাটছে? সেটা আমরা জানি না। কিন্তু ঘটনাটি যে গর্হিত তা ভেবে দেখার সময় এসেছে। বর্তমান সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা চালু করার সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায়ও বিশাল পরিবর্তন এসেছে। এটা যে কেউ জানে না তা নয়। কারো অজান্তে এত বড় ঘটনা ঘটে না। আমাদের দেশে ঘটেছে বলেই আজ এত কথা বলতে হচ্ছে। অথচ এমনও আছে যে, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা আজও অবহেলিত।

দুই.

দেশকে স্বাধীন করতে জীবন বাজি রেখে যারা যুদ্ধ করেছিলেন তাদেরকে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান (মুক্তিযোদ্ধা) হিসেবে মূল্যায়ন করা হওয়াটাই প্রত্যাশিত। স্বাধীনতার ৫০ বছরেও মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি ও সম্মান না পাওয়া একজন মুক্তিযোদ্ধার নাম মোঃ মহুবর রহমান (৬৫)। উত্তরের জনপদ নীলফামারী জেলা ডিমলা উপজেলার ২নং বালাপাড়া ইউনিয়নের (ভাসানী পাড়া) গ্রামের মৃত মফিজ উদ্দিন সরকারের ছেলে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ৬ নভেম্বর যুদ্ধে অংশ নিতে ৬ নম্বর সেক্টর কোম্পানি কমান্ডার আছির উদ্দিনের মাধ্যমে দেওয়ানগঞ্জ ক্যাম্পে প্রশিক্ষণে যান মোঃ মহুবর রহমান।

পরে আব্দুল খালেকের মাধ্যমে ভারত ইয়ুথ ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন তিনি। সেখান থেকে ফিরে এসে বুড়িমারী হেডকোয়ার্টার ধরলা নদীর বিশাল মাঠে সর্বশেষ প্রশিক্ষণ নিয়ে রাইফেল হাতে নিয়ে দেশকে হানাদারমুক্ত করার জন্য যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। একাধিক যুদ্ধে তিনি বীরত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। বুড়িমারীতে যুদ্ধকালে মহুবর রহমানের তিন সহযোদ্ধা ছিলেন। তারা হলেন মোঃ আমিরুল ইসলাম, মোঃ আশরাফ আলী, মোঃ হাফিজুর রহমান। তারা তিনজনই গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু স্বাধীনতার অর্ধ শতাব্দী পর দীর্ঘদিন অনেক চেষ্টা তদবির করেও মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় তার নাম লিপিবদ্ধ হয়নি। তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তি না হওয়ায় তিনি বঞ্চিত রয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা ভাতাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা থেকে। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচয় দিতে পারছেন না তিনি। নিজগ্রামের মানুষসহ উপজেলার অন্য বীর মুক্তিযোদ্ধারা মহুবর রহমানকে মুক্তিযোদ্ধা বলে ডাকলেও কাগজে-কলমে তার স্বীকৃতি মিলেনি স্বাধীনতার ৫০ বছরেও। ৬৫ বছর বয়সী মহুবর রহমান অলস সময়ে ঝাপসা চোখে এখন শুধু মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রোমন্থন করেন।মহুবর রহমানের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত ১৪ অক্টোবর ২০১৩ সালে ডিজি নং ১১০১০৯৫-এর মাধ্যমে তিনি আবেদন করেন । তার বার্তা নং ০৩১৫০২০১৮০।

তিনি যাবতীয় কাগজপত্রও জমা দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট দপ্তরে। কিন্তু স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসের সুবর্ণজয়ন্তীতেও তার মুক্তিযোদ্ধা সনদের কোনো সুরাহা হয়নি। তার সঙ্গে যারা প্রশিক্ষণ নিয়েছে তারা মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি পেলেও মহুবুর রহমানের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি মিলেনি স্বাধীনতার ৫০ বছরেও। মৃত্যুর আগে কি মহুবুর রহমান মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাবেন না? তার সবুজ মুক্তিবার্তা নং ০৩১৫০২০১৮০। তার যে প্রমাণাদি রয়েছে, এতে তিনি একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা এতে কোনো সন্দেহ নেই। স্বাধীনতার ৫০ বছরে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাওয়া এখন তার অধিকার। কিন্তু দ্বারে দ্বারে ঘুরতে ঘুরতে তিনি ক্লান্ত। একাত্তরের টগবগে সেই যোদ্ধা এখন বয়সের ভারে খুব একা চলতে পারেন না। কিন্তু তার জীবনের এই দায়ভার কে নেবে? এলাকাবাসী তাকে মুক্তিসেনা হিসেবে জানলেও আজ অবধি তার স্বীকৃতি মেলেনি। এ লজ্জা কার?

তিন.

একটা কথা আজ মনে পড়ছে। আমাদের এলাকা গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার বীরমুক্তিযোদ্ধা মরহুম মুজিবুল তার জীবদ্দশায় কোটালীপাড়ার একটি রাজাকার তালিকা করে বিপাকে ও ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন। তাপরপরও তিনি তালিকা করেছিলেন। স্বাধীনতাবিরোধীরা গত পঞ্চাশ বছরে যেভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ও পরিকল্পিতভাবে যেভাবে আত্মীয়স্বজন তৈরি করেছে তাতে তাদের বিরুদ্ধে এখন কথা বলা বিপদ। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রের কি কোনো ভূমিকা নেই?

নতুবা কোটালীপাড়ার মুজিবুল হক কেন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছিলেন আর নীলফামারীর মহুবর রহমানের মতো একজন বীরযোদ্ধা যাকে এলাকার জনপ্রতিনিধিরাও চেনেন বীরমুক্তিযোদ্ধা হিসেবে। কাগজ তৈরির জন্য তিনি কেন দ্বারে দ্বারে ঘুরবেন? জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্ব তার কাগজ তার কাছে নিয়ে আসা। কারণ এই স্বাধীন দেশ, স্বাধীন মানচিত্রে তার অবদান মিশে আছে।

এই বীর মুক্তিযোদ্ধারা যখন যুদ্ধে গিয়েছিলেন তখন ফিরবেন এমন আশা করে যুদ্ধে যাননি। দেশমাতৃকাকে হানাদারদের হাত থেকে রক্ষা করতে এরা মরণপণ যুদ্ধে শামিল হয়েছিলেন। আজ তাদের এই দুর্দশা দেখা সত্ত্বেও কেউ ব্যবস্থা নেবে না- এটা হতে পারে না। মুক্তিযোদ্ধাদের শ্রদ্ধার চোখে দেখে অমুক্তিযোদ্ধদের তালিকা থেকে বাদ না দিলে জনগণ মুক্তিযোদ্ধদের আগের মতো সমীহ করবে বলে মনে হয় না। রাষ্ট্র চেষ্টা করলে কী না হয়? সব হয়। তাই মহুবর রহমানের কথাটা শুধু একবার ভাবুন। মৃত্যুর আগে সে তার সনদ পাক এ দাবি সবার।

লেখক: গবেষক, প্রবন্ধকার ও সাংবাদিক।

এ বিভাগের আরো খবর