১৯৭১ সালের ৭ এপ্রিল। বেলা ১১টা। একটা জিপ আর একটা লরি এসে থামল চট্টগ্রামের এনায়েত বাজারের ‘মুশতারী লজ’ নামের চারতলা বাড়ির সামনে। টপাটপ ৪০-৫০ জন পাকিস্তানি সৈন্য লাফিয়ে নেমে এল গাড়ি থেকে। বাড়ির ভিতর ঢুকে পড়ল সৈন্যরা। তারপর ধরে নিয়ে গেল ডা. আবদুল্লাহ শফীকে। সার্কিট হাউসে নিয়ে কিছুটা জেরা করে আবার ছেড়ে দিল। তবে ছেড়ে দেয়ার মূল কারণ ছিল, পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার বেগ ছিল ডা. শফীর রোগী।
এলাকায় দাঁতের ডাক্তার হিসেবে বেশ সুনাম ছিল তার। এরপর ঘরে ফিরে দুপুরের খাবার খাওয়ার সময় আবারও পাকিস্তানি সৈন্যরা হানা দিল বাড়িটিতে। তারপর পুরো বাড়ি তল্লাশি চালিয়ে খুঁজে পেল অনেক অস্ত্রশস্ত্র।
২৭ মার্চ পাকিস্তানি সৈন্যদের কাছ থেকে অস্ত্রগুলো লুঠ করার পর রাখা হয়েছিল ‘মুশতারী লজ’-এ। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে অস্ত্রগুলো সরবরাহ করার সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন গৃহকত্রী মুশতারী শফী। কিন্তু তার প্রতিবেশী বিহারি এটা দেখে ফেলে। আর সেটা জানিয়ে দেয় পাকিস্তানি সৈন্যদের। তার বাড়ির তিনতলায় সেই অস্ত্রের সন্ধান পেয়ে যায় পাকিস্তানি সৈন্যরা। শুধু তাই নয়, তাদের বিরুদ্ধে এগারোটা অভিযোগ দাখিল করে।
এই অভিযোগগুলো ধরে তাকে জেরার পর জেরা করতে থাকল এক পাকিস্তানি মেজর। সত্য মিথ্যা মিলিয়ে সেই অভিযোগ থেকে নিজেদের বাঁচাতে যুক্তিতর্ক করেছিলেন মুশতারী শফী। বেগম মুশতারী শফী তার বইতে লিখেছেন-
‘‘মেজর খান আবার আমাকে চিবিয়ে চিবিয়ে বললো, আর মিসেস শফী, তুমি বলছো আওয়ামী লীগ করো না। অথচ পাবলিক মিটিং, মিছিল এসব করলে কেন?’ বিস্ময়ের পর বিস্ময় আমাদেরকে হতবাক করে দিচ্ছে। এসব এরা জানল কী করে? ‘বলো, চুপ করে কেন? তুমি সরকারের বিরুদ্ধে মিছিল করোনি?’ বললাম, ‘না।’
‘তব্ ইয়ে কৌন হ্যায়, জারা গওরসে দেখো তো?’ একটা ছোট্ট চামড়ার ব্যাগ থেকে ফটো বের করে ওরা আমার চোখের সামনে ধরল। আর কথা নেই। বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে দেখছি মেজর খানের হাতে ধরা ছবিতে মহিলা পরিষদের ব্যানার। ব্যানারের একদিকে ছাত্র ইউনিয়নের মেয়ে সীমা চক্রবর্তী, অন্যদিকে দিল আফরোজ ধরে আছে। মাঝখানে কবি সুফিয়া কামাল, উমরাতুল ফজল, মালেকা বেগম, হান্নানা আর আমাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। পিছনে অগণিত মহিলা। তাদের মুষ্টিবদ্ধ হাত উপরে তোলা।”
এরপর যতই যুক্তি দেখান, কিন্তু লাভ হলো না। ডা. শফীকে গাড়িতে করে তুলে নিয়ে গেল। সঙ্গে নিয়ে গেল মুশতারী শফীর ছোটভাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সের ছাত্র খন্দকার এহসানুল হক আনসারীকে।
পাকিস্তানি সৈন্যদের অভিযোগ ছিল তাদের তিনজনের বিরুদ্ধে। স্বামী ও ভাইয়ের সঙ্গে তিনিও একজন অভিযুক্ত। তাই তাকেও ধরে নিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু তার সাত সন্তান তখন ভীষণ কান্নাকাটি করছিল বলে তাকে আর ধরে নিয়ে যায়নি। তবে তাকে হুমকি দিয়েছিল এভাবে-
‘‘হ্যাঁ, তুমি এখন ঘরে থাকো। যদি প্রয়োজন মনে করি পরে এসে নিয়ে যাবো। আর হ্যাঁ, কোথাও পালাতে চেষ্টা করবে না। যদি পালাও, তাহলে এই যে তোমার ভাই আর স্বামী- এদেরকে তো মেরে ফেলবোই, তোমার বাড়িটাও ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া হবে।”
মুক্তিযুদ্ধে ‘মুশতারী লজ’ নামের এ বাড়ির রয়েছে বিশেষ ভূমিকা। ২৬ মার্চ ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠার প্রথম পরিকল্পনা গড়ে ওঠে ওই বাড়িতে। বেতার কেন্দ্রের উদ্যোক্তা ও প্রধান প্রতিষ্ঠাতা বেলাল মোহাম্মদসহ আবদুল্লাহ-আল ফারুক, আবুল কাশেম সন্দ্বীপ, কাজী হাবিবুর রহমান ও রেজাউল করিমসহ অনেকেই ওই বাড়িতে আশ্রয় নেন।
৩০ মার্চ কালুর ঘাট বেতার কেন্দ্রে পাকিস্তানি বিমানহামলা পর্যন্ত তারা গোপনে সেই বিপ্লবী বেতারের কার্যক্রম চালিয়ে যান। শুধু তাই নয়, ভয়েস অব আমেরিকা, বিবিসি, আকাশবাণী ও অন্যান্য দেশের বাংলা অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত সংবাদ ও মতামত এবং পর্যালোচনা শুনে ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রে’ প্রচারের জন্য নিউজ ও বুলেটিন তৈরির কাজে স্বামী ও ছেলের সঙ্গে অংশও নিয়েছিলেন বেগম মুশতারী শফী।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে আশপাশের অনেক অসহায় মানুষকে তিনি নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলেন। ৭ এপ্রিল যেদিন তার স্বামী ও ভাইকে পাকিস্তানি সৈন্যরা তুলে নিয়ে যায়, সেদিনও তার বাড়িতে প্রায় চল্লিশজন মানুষ অবস্থান করছিলেন। এদের মধ্যে নানান ধর্মের, নানান পেশার মানুষ ছিলেন।
যদিও বেশ আগে তাদের পালিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তিনি পালাননি। তার যুক্তি ছিল, সবাই যদি পালিয়ে যায়, তাহলে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়বে কারা?
৮ এপ্রিল সাত সন্তান নিয়ে তিনি বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন। পায়ে হেঁটে ভারতের আগরতলায় আশ্রয় নেন। ফার্স্ট এইড ট্রেনিং নিয়ে হাসপাতালে আহত যোদ্ধাদের সেবা, মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিং ক্যাম্প ও শরণার্থী শিবিরে উদ্দীপকমূলক বক্তৃতা করে শরণার্থীদের সেবায় অংশ নেন।
এরপর আগস্টে কলকাতায় যান মুশতারী শফী। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক ও নাট্যশিল্পী হিসেবে যোগ দেন উম্মে কুলসুম নামে। বেতারে নিয়মিত উর্দু নাটক, আবৃত্তি ও অনুষ্ঠান উপস্থাপনাসহ প্রতি সপ্তাহে ‘বাংলার রণাঙ্গনে নারী’, ‘জানেন ওদের মতলব কী?’ শীর্ষক স্বরচিত কথিকা পাঠ করতেন, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছোটগল্প প্রচার করতেন।
অসম্ভব রকমের এক বিপ্লবী নারী মুশতারী শফী। স্বামী আর ভাইকে পাকিস্তানিরা ধরে নিয়ে যাওয়ার পরও তিনি থেমে থাকেননি। দেশের স্বাধীনতার জন্য কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। আজীবনের এই সংগ্রামী মানুষটার জন্ম ১৯৩৮ সালের ১৫ জানুয়ারি। মুশতারী শফীর দাদা কাজী আজিজুল হক ছিলেন বাঙালি উদ্ভাবক ও ব্রিটিশ ভারতীয় পুলিশের কর্মকর্তা। অপরাধী শনাক্ত করার জন্য তার দাদা হাতের ছাপ উদ্ভাবন করেন। এই গুণী বাঙালির নাতনি মুশতারী শফী মাত্র দশ বছর বয়সে মাকে হারান।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত সময়ে তার বয়স ছিল মাত্র ১৪ বছর। তিনি তখন ঢাকা কামরুন্নেসা গার্লস হাই স্কুলের ছাত্রী। প্রত্যক্ষ করেছেন ভাষা আন্দোলনের দিনগুলো। আর ভাষা সংগ্রামের পথ ধরে এগিয়ে চলা বাঙালি জাতীয়তাবাদের সঙ্গে নিজেকে জড়িত করেছেন।
এ সময় তিনি যা দেখতেন এবং সেই দেখা থেকে নিজের আবেগকে তিনি ধরে রাখতেন স্কুলের খাতার পাতায়। লুকিয়ে ডায়েরির মতো করে নিজের সুখ-দুঃখ ও উপলব্ধির কথাগুলো অজস্র ভুল বানানে লিখে রাখতেন। নারীমুক্তি আন্দোলনের লক্ষ্যে নিজ উদ্যোগে বান্ধবী সংঘ নামে চট্টগ্রামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এখানে নারীদের হস্তশিল্প, সেলাই, উলের মেশিনে গরম কাপড় তৈরির বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। সংগীত, যন্ত্রসংগীতের প্রশিক্ষণও দেয়া হতো নিয়মিতভাবে।
আর সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চা তো ছিলই। এই সংগঠনের মাধ্যমে ১৯৬৪ সাল থেকে ‘বান্ধবী’ নামে একটি মহিলা মাসিক পত্রিকাও প্রকাশ করেছিলেন। টানা ১১ বছর পত্রিকাটি সম্পাদনা করেন তিনি। শুধু তাই নয়, সংঘের মুখপাত্র হিসেবে ১৯৬৮ সালে সম্পূর্ণ মহিলাদের দ্বারা পরিচালিত ‘মেয়েদের প্রেস’ নামের একটি ছাপাখানাও গড়ে তোলেন, যেটা ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়। আর্থিক অসংগতির কারণে মুক্তিযুদ্ধের পর আর ওই দুটো প্রতিষ্ঠান চালু করা সম্ভব হয়নি।
১৯৬৫ সালে মুসলিম হল ইনস্টিটিউটে শ্রী বিধায়ক ভট্টাচার্য রচিত প্রথম নাটক ‘মেঘমুক্তি’ মঞ্চস্থ করেন শুধু মহিলাদের দিয়ে। নাটকটি দুরাত মঞ্চস্থ হয় এবং চট্টগ্রামের রক্ষণশীল সমাজ ব্যবস্থায় ব্যাপক আলোড়ন তোলে।
১৯৬৮ সালে মঞ্চস্থ করেন ‘সেই তিমিরে’ নাটক। ১৯৭০ সালে ‘বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ’ চট্টগ্রাম শাখার প্রথম আহ্বায়ক নির্বাচিত হন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধের পর দেশে ফিরে বাংলাদেশ বেতার চট্টগ্রাম কেন্দ্রের ‘নিজস্ব লেখক শিল্পী’ পদে চাকরিতে যোগ দেন এবং ১৯৯৫ সালে চিফ স্ক্রিপ্ট রাইটার হিসেবে অবসর নেন। পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ড তো চলতেই থাকে। এসময় তার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সঙ্গে কাজ করা।
তিনি ছিলেন নির্মূল কমিটির চট্টগ্রাম জেলার আহ্বায়ক। শহীদ জননী জাহানার ইমামের সঙ্গে তিনি রাজাকারদের বিচারের দাবিতে, বিশেষ করে রাজাকার শিরোমণি গোলাম আযমের ফাঁসির দাবিতে সোচ্চার ছিলেন। জাহানারা ইমামের মৃত্যুর পর কেন্দ্রের আহ্বায়ক হিসেবে আন্দোলনকে আরও বেগবান করেন মুশতারী শফী। আর এই আন্দোলনে প্রবাসীদের সম্পৃক্ত করার জন্য যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানি সফর করেন।
মুশতারী শফী সুলেখক। তার লেখা ২২টি গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- স্বাধীনতা আমার রক্তঝরা দিন, দুটি নারী ও একটি মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের গল্প, নারী বলো- আমরাও মানুষ, একুশের গল্প, একদিন এবং অনেকগুলো দিন, মুক্তার মুক্তি, বিপর্যস্ত জীবন, মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামের নারী, আমি সূদুরের পিয়াসি, অকাল বোধন, চিঠি জাহানার ইমামকে।
১৯৭১ সালের ৭ এপ্রিল স্বামী ও ভাইকে শেষবারের মতো দেখেছিলেন মুশতারী শফী। এরপর আর তাদের কারো কোনো খোঁজ পাননি। নারী প্রগতি, দারিদ্র্য বিমোচন ও নারীশিক্ষার জন্য যে সংগ্রাম তিনি করেছিলেন, সেখানে প্রতি পদে পদে বাধা ছিল। কিন্তু তার এতসব কাজের উৎসাহ দিতেন স্বামী।
সেই স্বামীকে হারিয়েও তিনি নিরাশ হয়ে বসে থাকেননি। এগিয়ে এসেছেন দেশের জন্য, সমাজের জন্য, মুক্তমত প্রতিষ্ঠার জন্য। তার কীর্তির জন্য পেয়েছেন সম্মাননা। অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার, বাংলা একাডেমি ফেলো ও বেগম রোকেয়া পদক পাওয়া এই গুণী নারী ও মুক্তিযোদ্ধা ২০ ডিসেম্বর ২০২১ চিরবিদায় নিয়েছেন। বিজয়ের মাসে চিরবিদায় নেয়া সৌভাগ্যের বটে! রেখে গিয়েছেন তার সংগ্রামী ও অনুপ্রেরণার এক জীবন- যার কখনও মৃত্যু নেই।
সহায়ক:
স্বাধীনতা আমার রক্তঝরা দিন- বেগম মুশতারী শফী
মুশতারী শফী: হার না মানা আলোকবর্তিকা- দৈনিক সমকাল, ০১ ডিসেম্বর ২০১৯।
লেখক: শিশুসাহিত্যিক ও প্রবন্ধকার।