বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ইউপি নির্বাচনে দলীয় প্রতীক: ‘এতক্ষণে অরিন্দম কহিলা’… 

  •    
  • ১৫ ডিসেম্বর, ২০২১ ১৪:৩৩

এখন সরকারি দলের অনেক নেতাই বলছেন যে, তারা ইউপি নির্বাচনকে দলীয় প্রতীকমুক্ত করার বিষয়ে চিন্তাভাবনা করছেন। তার মানে যে আইনটি সংশোধন করে দলীয় প্রতীকের ব্যবস্থা করা হয়েছিল, সেই বিধানটি আবারও সংশোধন করে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নেয়া হবে। দেরিতে হলেও নীতি-নির্ধারকদের এই বোধোদয় মন্দ নয়। কিন্তু তারা যদি মনে করেন যে, তাদের দলের প্রার্থীরা হেরে যাচ্ছেন বলে দলীয় প্রতীক বাতিল করবেন— তাহলে সেটি আরেকটি ভুল চিন্তা হবে।

চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে অব্যাহত সহিংসতা, বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয়পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যে বিরোধের জেরে বেশ কয়েকজন সংসদ সদস্য নিজের এলাকায় সহিংসতা ও বিভেদ এড়াতে দলীয় প্রতীক ছাড়া নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অর্থাৎ ২০১৬ সালে ইউনিয়ন পরিষদ আইন সংশোধনের আগে যেরকম নির্দলীয় পদ্ধতিতে অর্থাৎ দলীয় প্রতীক ছাড়া যেভাবে নির্বাচন হতো, সেভাবে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

রাষ্ট্রপতির এলাকা কিশোরগঞ্জের তিন উপজেলায় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীক না রাখার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন তার ছেলে, কিশোরগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক। পঞ্চম ধাপে আগামী ৫ জানুয়ারি কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলার সাত ইউনিয়নে এবং অষ্টগ্রাম উপজেলার আট ইউনিয়নে ভোট হবে বলে ঘোষিত হয়েছে। আর ইটনা উপজেলার ৯ ইউনিয়নে নির্বাচন হবে পরের ধাপে। এই তিন উপজেলার ২৪টি ইউনিয়নে চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসেবে কাউকেই আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন না দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। অর্থাৎ সবাই স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেবেন।

এই সিদ্ধান্তের পেছনে স্থানীয় সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগে অনেক যোগ্য মনোনয়ন প্রত্যাশী নেতা রয়েছেন বলে জানালেও বাস্তবতা হলো সহিংসতা এবং তৃণমূলে বিরোধ এড়ানো।

একই সিদ্ধান্ত হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর এলাকা গোপালগঞ্জেও। সদ‌রের ২১‌টির ম‌ধ্যে ১৫‌টি ইউ‌নিয়‌নের নির্বাচন আগামী ২৬ ডি‌সেম্বর। সেখানেও দলীয় প্রতীক থাকবে না বলে জানা গেছে। এর আগে কা‌শিয়ানী উপ‌জেলার ৭‌টি ইউনিয়নে দলীয় প্রতীক ছাড়া নির্বাচন হ‌য়ে‌ছে।

এর আগে ইউপি নির্বাচনে নিজ সংসদীয় এলাকা আখাউড়া-কসবায় সহিংসতা এড়াতে নৌকা প্রতীক না দেয়ার কথা জানান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। সে অনুযায়ী নৌকা প্রতীক ছাড়াই এই দুই উপজেলার ইউনিয়নে ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন চেয়ারম্যান প্রার্থীরা। শুধু তাই নয়, ইউপি নির্বাচনে স্বতন্ত্র মনোনয়নের সুযোগ চেয়ে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ডের কাছে চিঠি লিখেছেন নোয়াখালী-৪ (সদর ও সুবর্ণচর) আসনের সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরী। চিঠিতে তিনি বলেন, দেশে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং দলীয় নেতাকর্মীদের রক্তক্ষয়ী সংঘাত থেকে মুক্তির প্রত্যাশায় উন্মুক্তভাবে (স্বতন্ত্র) নির্বাচন অনুষ্ঠানের সুযোগ রাখার আবেদন করছি। নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সংসদ সদস্য সেলিম ওসমানও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক না রাখার দাবি জানিয়েছেন।

বাস্তবতা হলো, চলমান ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রতীকে বিএনপি মাঠে থাকলেও অধিকাংশ জায়গায় দল মনোনীত একক প্রার্থী দিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। যেহেতু একটানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় রয়েছে আওয়ামী লীগ এবং নানারকম ‍সুযোগ-সুবিধার লোভে ক্ষমতাসীন দলে নেতাকর্মীর সংখ্যাও বেশি থাকে। ফলে প্রতিটি এলাকাতেই একটি নৌকা প্রতীকের বিপরীতে প্রার্থী একাধিক। কিন্তু একটি ইউপিতে চেয়ারম্যান পদে একজনের বেশি মনোনয়ন দেয়ার সুযোগ নেই।

ফলে মনোনয়ন না পেয়ে অধিকাংশ স্থানেই আওয়ামী লীগের নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। নির্বাচনি মাঠ দখলে জড়াচ্ছেন সংঘাত-সহিংসতায়। প্রথম ধাপের ইউপি নির্বাচনে ছয়জনের প্রাণহানি হয়। এরপর দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপেও প্রায় ৩০ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে।

উল্লেখ্য, ২০১৬ সালে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আইন সংশোধনের মাধ্যমে ইউপি নির্বাচনসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার করার বিধান করা হয়। যদিও সরকারের বাইরে থাকা একাধিক রাজনৈতিক দলই তখন দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের বিরোধিতা করেছিল।

শুরু থেকেই এই শঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছিল যে, তৃণমূলের এই নির্বাচনেও দলীয় প্রতীক বরাদ্দ করা হলে হানাহানি বাড়বে। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে বিরোধ-কোন্দল ও সহিংসতা বাড়বে। পক্ষান্তরে নির্দলীয় ভালো মানুষেরা নির্বাচনের মাঠ থেকে ছিটকে পড়বেন। তা-ই হয়েছে। তাছাড়া নানা কারণেই মানুষ আগের চেয়ে অনেক বেশি রাজনীতিসম্পৃক্ত। রাজনীতির বাইরে থাকলে তাদের যেহেতু নানারকম সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকতে হয়, আবার অনেকে পিঠ বাঁচাতেও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত হন। ফলে যখনই দলীয় প্রতীকে কোথাও ভোট হয়, সেখানে সাধারণ মানুষও নির্দলীয় প্রার্থীকে ভোট দেন না বা দিতে পারেন না। তাকে কোনো না কোনো পক্ষাবলম্বন করতে হয়। কিন্তু যে প্রার্থীর জেতার সম্ভাবনা কম, তিনি নির্বাচনের প্রতিটি ধাপেই জালিয়াতি করতে চান। তাতে তিনি সরকারি দলের প্রার্থী হোন কিংবা বিরোধী দলের।

অনেক সময় সরকারি দলের প্রার্থীর চেয়ে বিরোধী তথা সরকারের বাইরে থাকা দলের কোনো প্রার্থীও স্থানীয়ভাবে বেশি ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালী হতে পারেন এবং তিনি যদি জানেন যে, সুষ্ঠু ভোটে তার জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা কম, তখন তিনি হয় ভোটে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেন, নয়তো তিনি চান কোনো না কোনোভাবে ভোট ব্যবস্থাটি বিতর্কিত হোক।

এখন এ কথা সরকারের নীতি-নির্ধারকরাও স্বীকার করেন যে, যে উদ্দেশ্য নিয়ে ইউপিসহ সব স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় প্রতীকে করার ব্যবস্থা করেছিল, তা সফল হয়নি। বরং দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের কারণে তৃণমূলপর্যায়ে সংঘাত-সহিংসতা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। সেইসঙ্গে দলীয় প্রতীকে ইউপি নির্বাচন হওয়ায় অনেক সময় সবচেয়ে যোগ্য প্রার্থী বিজয়ী না হয়ে অপেক্ষাকৃত দুর্বল প্রার্থী চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে যান। এর ফলে তৃণমূলপর্যায়ের মানুষ সঠিক জনপ্রতিনিধি না পাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হন।

প্রশ্ন হলো, কিশোরগঞ্জ, গোপালগঞ্জ বা ব্রাহ্মণবাড়িয়া নিশ্চয়ই বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো দ্বীপ নয় কিংবা এই এলাকাগুলোর জন্য নিশ্চয়ই আলাদা সংবিধান ও আইন নেই যে, দেশের অধিকাংশ জেলায় এক নিয়মে ভোট হবে, অথচ কয়েকটি জেলায় হবে অন্য নিয়মে। অধিকাংশ জেলায় দলীয় প্রতীকে ভোট হলে এই কয়েকটি জেলায় কেন দলীয় প্রতীক ছাড়া হবে? আবার কয়েকটি জেলায় দলীয় প্রতীক ছাড়া ভোট হতে পারলে বাকি জেলাগুলোয় কেন নয়? এগুলো সরকারের স্ববিরোধী আচরণ কি না—সে প্রশ্নও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। কারণ ৬০টি জেলায় ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা নিজেদের মধ্যে মারামারি করবেন, অথচ এই বাকি চারটি জেলায় ‘শান্তিপূর্ণ’ ভোট হবে— এটি সামগ্রিক নির্বাচনি ব্যবস্থাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে।

বিশেষ কোনো এলাকায় দলীয় প্রতীক ছাড়া ভোট হওয়ার মানেই হলো সরকারও বুঝতে পারছে যে দলীয় প্রতীকে ইউপি নির্বাচন করার যন্ত্রণা অনেক। যদি এটা যন্ত্রণাই মনে হয়ে থাকে, তাহলে আগে যে আইন ছিল যে, ইউপি নির্বাচন হবে নির্দলীয়, সেই আইনে ফিরে গেলেই তো হয়। এটা তো সরকার চাইলেই পারে। শুধু সংসদে একটা বিল পাস করতে হবে। তাতে বরং ইউপি নির্বাচনে বিভিন্ন স্থানে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা যেভাবে গণহারে হেরে যাচ্ছেন এবং তাদের বিরোধী শিবির থেকে এই ঘটনায় সরকারের জনপ্রিয়তায় ধস নেমেছে বলে যে দাবি করা হচ্ছে, সেই পরিস্থিতির মুখোমুখি তো সরকারকে হতে হতো না।

বিভিন্ন ইউপিতে দলীয় প্রতীক ছাড়াই নির্বাচনের যে সিদ্ধান্ত হলো, তার মানে দলীয় প্রতীকের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট এলাকার এমপি বা শীর্ষ রাজনীতিকরাই ‘বিরক্ত’ অথবা তারা এর কুফলগুলো দেখছেন বলেই ইউপি আইন সংশোধনের পূর্ববর্তী তরিকায় মানে নির্দলীয় ভোটের সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। প্রশ্ন হলো, স্থানীয় সরকারের সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে বেশি মানুষের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন দলীয় প্রতীকে করলে যে তার সুবিধার চেয়ে অসুবিধাই বেশি, এটি বুঝতে নীতি-নির্ধারকদের এত সময় লাগল? কেনইবা তারা ইউপি নির্বাচনকেও দলীয় মোড়কে নিয়ে স্থানীয়পর্যায়ের নির্দলীয়, সৎ ও ভালো মানুষকে নির্বাচনের মাঠ থেকে বিতাড়িত করে দিলেন? কেন রাষ্ট্রের তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত দলবাজিকে উসকে দিলেন এবং ইউনিয়ন পরিষদের মতো একটি প্রতিষ্ঠানকেও মাস্তান-ক্যাডার-অবৈধ পয়সার মালিকদের ক্লাবে পরিণত করার সুযোগ সৃষ্টি করে দিলেন?

এখন সরকারি দলের অনেক নেতাই বলছেন যে, তারা ইউপি নির্বাচনকে দলীয় প্রতীকমুক্ত করার বিষয়ে চিন্তাভাবনা করছেন। তার মানে যে আইনটি সংশোধন করে দলীয় প্রতীকের ব্যবস্থা করা হয়েছিল, সেই বিধানটি আবারও সংশোধন করে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নেয়া হবে।

দেরিতে হলেও নীতি-নির্ধারকদের এই বোধোদয় মন্দ নয়। কিন্তু তারা যদি মনে করেন যে, তাদের দলের প্রার্থীরা হেরে যাচ্ছেন বলে দলীয় প্রতীক বাতিল করবেন— তাহলে সেটি আরেকটি ভুল চিন্তা হবে। বরং চিন্তাটা হওয়া উচিত এমন যে, ইউনিয়ন পরিষদের মতো প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ও মেম্বার পদে কমিউনিটির সবচেয়ে ভালো, যোগ্য ও জনবান্ধব মানুষগুলো যেন বিজয়ী হয়ে আসেন। যেন তারা অবৈধ ও কালো টাকা এবং পেশিশক্তির কাছে হেরে না যান।

একটা সময় যেমন কমিউনিটির সবচেয়ে সম্মানিত মানুষটি যেমন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, ধর্মীয় নেতা, সমাজকর্মী, স্বেচ্ছাসেবক, অনুকরণীয় ব্যক্তিত্বরা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতেন, সেই অবস্থাটা যেন ফিরে আসে। সরকারের উচিত হবে এমন একটি সিস্টেম গড়ে তোলা যাতে শুধু নির্দলীয় ব্যবস্থাতেই নয়, বরং ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে তৃণমূলের সবচেয়ে যোগ্য এবং ভালো মানুষই নির্বাচিত হয়ে আসতে পারেন। অন্তত এই জায়গাটি দলীয় প্রভাবমুক্ত রাখা গেলে সমাজের প্রান্তিক মানুষেরা তাদের প্রতিদিনকার নাগরিকসেবা পেতে গিয়ে কোনো ধরনের হয়রানি বা ভোগান্তির শিকার হবেন না।

উপরন্তু নেতৃত্ব গড়ে ওঠার ক্ষেত্রেও এটা বড় ভূমিকা রাখবে। কিন্তু যখনই দলীয় প্রতীকে ভোট হবে, তখনই সেখানে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী ‘বাই ডিফল্ট’ কিছু অতিরিক্ত সুবিধা পেয়ে যান এবং তার বিরুদ্ধে সমাজের নির্দলীয় কিন্তু সৎ ও ভালো মানুষ দাঁড়াতে চান না। কারণ দলীয় প্রতীক, পয়সা ও মাস্তানির বিপরীতে দাঁড়িয়ে শুধু ব্যক্তিত্ব দিয়ে নির্বাচনে জয়ী হয়ে আসা বেশ কঠিন। ফলে, সেই কঠিন পরিস্থিতিতে সহজ করাই রাষ্ট্রের দায়িত্ব।

লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

এ বিভাগের আরো খবর