রাজধানী ঢাকার কিছু এলাকার নাম পরিবর্তন করা হয় ১৯৭১-এর জুনে। পাকিস্তানি হানাদারবাহিনীর দৃষ্টিতে ওই নামগুলো ছিল হিন্দুয়ানি! আর তাই এসব নাম বাদ দিয়ে ‘ইসলামি’ ভাবধারার নতুন নামকরণ করা হয়। যেমন- শাঁখারীবাজারের নাম হয় টিক্কা খান রোড, মাদারটেকের নতুন নাম মাজারটেক, এলিফ্যান্ট রোডের নাম হয় আল-আরবিয়া রোড, বেইলি রোড পরিবর্তিত হয় বু’ আলী রোডে আর রায়েরবাজারের নাম হয় সুলতানগঞ্জ। (সংবাদপত্রে ঢাকার মুক্তিযুদ্ধ, পৃষ্ঠা: ২৮৩)
১৯৭১-এ ঢাকা নগরীর উপকণ্ঠে অবস্থিত রায়েরবাজার বা সুলতানগঞ্জ নামের এলাকাটি ছিল বেশ নির্জন। নদীর তীরবর্তী নিচু জলাভূমি। শুষ্ক মৌসুমে এই এলাকাতে একাধিক ইটভাটা চালু ছিল। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে এরকম একটি পরিত্যক্ত ইটভাটার অগভীর পুকুরের মতো গোলাকার গর্তে আবিষ্কৃত হয়েছিল বাঙালির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের মরদেহ।
পিছমোড়া করে হাতবাঁধা, আঙুলের নখ ওপড়ানো, গুলিতে ঝাঁঝরা বুক, বেয়নেটে ক্ষত-বিক্ষত শরীর। অর্ধগলিত এই মরদেহগুলো ছিল স্বাধীনতাকামী বাঙালি অধ্যাপক-চিকিৎসক, আইনজীবী ও সাংবাদিকসহ অন্যান্য পেশার আলোকিতজনের। যারা অবরুদ্ধ পাকিস্তানে থেকেও বাঙালির মুক্তি-সংগ্রামকে সহযোগিতা করেছিলেন।
বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তে জানা যায়, মোহাম্মদপুরের শারীরিক শিক্ষা কলেজ ও অন্য একটি আস্তানাতে আটকে রেখে বর্বর নির্যাতনের পর বিজয়ের ঊষালগ্নে তাদের হত্যা করা হয়। এই হত্যার মাধ্যমে পরাজয়ের আগ মুহূর্তে আলবদর সদস্যরা (ইসলামী ছাত্রসংঘের ঘাতক শাখা) বাঙালি জাতির প্রতি প্রকাশ করেছিল তাদের চরম জিঘাংসা।
এই হত্যাকাণ্ডকে দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া আখ্যায়িত করেছিল ‘মাই লাই’ হত্যাযজ্ঞ হিসেবে। উল্লেখ্য, ১৯৬৮-এর ১৬ মার্চ দক্ষিণ ভিয়েতনামের মাই লাই গ্রামে মার্কিন সেনারা নির্বিচারে অন্তত চার শতাধিক নিরস্ত্র গ্রামবাসীকে হত্যা করেছিল। যা ইতিহাসে মাই লাই ম্যাসাকার নামে পরিচিত। (বাংলাদেশ ডুকুমেন্টস, পৃষ্ঠা: ৫৭২)
রায়েরবাজারের ওই জলাভূমিতে এই মরদেহগুলোর খোঁজ পাওয়া যায় ১৯৭১-এর ১৭ ডিসেম্বর। ঢাকার বাতাসে তখন সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ বিজয়ের আনন্দরেণু। যাদের স্বজন কদিন ধরেই নিখোঁজ সেসব পরিবারের সদস্যরা ছুটে যান প্রিয়জনের মরদেহ শনাক্ত করতে। নির্যাতনে ক্ষত-বিক্ষত, অর্ধগলিত এই মরদেহগুলো শনাক্ত করতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। তবে একটি মরদেহ সহজেই শনাক্ত করা যায়। সেটি ছিল সাংবাদিক সেলিনা পারভীনের।
পরনে সাদা শাড়ি, পায়ে সাদা জুতা-মোজা দেখে সহজেই তাকে সেলিনা পারভীন বলে শনাক্ত করা যায়। উল্লেখ করা যেতে পারে, রায়েরবাজার বধ্যভূমি থেকে উদ্ধার হওয়া একমাত্র নারী মরদেহটি ছিল সেলিনা পারভীনের।
সাহিত্যপত্রিকা ‘শিলালিপি’র সম্পাদক ছিলেন শহীদ সেলিনা পারভীন। তবে সাহিত্য-সংস্কৃতি ও সাংবাদিকতায় তিনি অনেক আগে থেকেই যুক্ত ছিলেন। এছাড়াও ছিলেন রাজনীতি-সচেতন নাগরিক। বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বাঙালির অধিকারের প্রশ্নে তার ছিল আপসহীন অবস্থান। শিলালিপির আগে সেলিনা পারভীন যুক্ত ছিলেন সাহিত্য ও সংস্কৃতি-বিষয়ক সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘ললনা’র সঙ্গে। নারী-বিষয়ক এই সাপ্তাহিকের সম্পাদক ছিলেন মুহম্মদ আখতার।
সেলিনা পারভীন এই পত্রিকার প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করতেন। একইসঙ্গে পত্রিকাটির বণিজ্যিক তথা বিজ্ঞাপন বিভাগের দেখভালের দায়িত্বও ছিল তার উপর। ১৯৭১-এ ললনা পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় সেলিনা পারভীন ব্যস্ত হয়ে পড়েন তার নিজের পত্রিকা শিলালিপি নিয়ে। পাশাপাশি অবরুদ্ধ ঢাকায় থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা শুরু করেন। ঢাকার গেরিলা ও অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের তিনি অর্থ, ওষুধপথ্য ও শীতবস্ত্র ইত্যাদির ব্যবস্থা করে দেন।
বাঙালি জাতির মুক্তির প্রশ্নে তিনি ছিলেন আপসহীন। এটি অনেকটা প্রকাশ্যই ছিল। যে কারণে বিপদে পড়তে হয় তাকে। আপসহীনতার মূল্য চোকাতে হয় প্রাণ দিয়ে। সেলিনা পারভীন বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী ঘাতক রাও ফরমান আলীর নজরে পড়েছিলেন। ১৯৭১-এ যেকোনো ধরনের প্রকাশনার জন্য পাকিস্তানি বাহিনীর অনুমোদন প্রয়োজন হতো। শিলালিপির জন্য এই অনুমোদন আনতে গিয়ে তিনি পাকিস্তানি সেনা কর্তৃপক্ষের নজরে পড়েন।
শিলালিপি পত্রিকার প্রচ্ছদ ও অন্যান্য কাজে গ্রামীণ বাংলার অলংকার ব্যবহার করা হতো। যা পছন্দ ছিল না রাও ফরমান আলীর। সে বাঙালিয়ানা বাদ দিয়ে পাকিস্তানি ভাবধারায় পত্রিকাটি প্রকাশের পরামর্শ দিয়েছিল। তবে সেলিনা পারভীন তা মানেননি। নিজের মতো পত্রিকা প্রকাশের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। শিলালিপির শেষ সংখ্যায় প্রস্তাবিত প্রচ্ছদ ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা।
স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা দিয়ে পরিকল্পিত শিলালিপির সে সংখ্যাটি আর প্রকাশ করা হয়নি সেলিনা পারভীনের। এর আগেই ঘাতকরা হত্যা করে তাকে। পরাজয়ের প্রাক্কালে হিংস্র হায়েনারা ওদের দেশি দোসর আলবদর বাহিনীর সাহায্যে নিউ সার্কুলার রোডের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায় সেলিনা পারভীনকে। ওই সময় মাটি লেপা একটি মাইক্রো নিয়ে ঢাকা শহর থেকে চিহ্নিত বুদ্ধিজীবীদের তুলে নিচ্ছিল আলবদর বাহিনী।
সেলিনা পারভীনকে তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন বিখ্যাত নারী অধিকারকর্মী মালেকা বেগম। তিনি সেলিনা পারভীনকে নিয়ে স্মৃতিচারণায় লিখেছেন-
“১৩ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে দশটায় কয়েকজন এসে বলল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডাক পড়েছে, যেতে হবে। সুমন (সেলিনা পারভীনের একমাত্র ছেলে) তখন ৮ বছর বয়সের ছিল। সব স্মরণ আছে তার। বলেছে তেল মাখিয়ে মা তাকে মামার সঙ্গে ছাদে পাঠিয়ে মোড়ায় বসে রান্না করছিলেন। বললেন পরে যাবেন কারফিউ শেষ হোক। ওরা সুযোগ দিল না। সুমন চেয়েছিল সঙ্গে যেতে। অনুমতি মেলেনি।” (পৃষ্ঠা ৯৩, স্মৃতি ১৯৭১, দ্বিতীয় খণ্ড)
ঘাতকদের সঙ্গে যাওয়ার সময় ৪ বছরের ছেলে সুমনকে বলে গিয়েছিলেন কাজ শেষ করে দ্রুতই ফিরবেন। কিন্তু তার আর ফেরা হয়নি। বিজয়ের ঊষালগ্নে অন্যান্য বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে তার শরীর। প্রাণহীন দেহটির শেষ আশ্রয় হয়েছে রায়েরবাজারের ইটখোলার বধ্যভূমিতে। পরনে সাদা শাড়ি, সাদা জুতা আর মোজা থাকায় খুব সহজেই শনাক্ত করা গিয়েছিল এই শহীদকে।
তথ্যসূত্র:
*রশীদ হায়দার, স্মৃতি ১৯৭১, (সম্পাদনা দ্বিতীয় খণ্ড, ২০১৭-১৮) বাংলা একাডেমি, ঢাকা
*ড. আবু মো. দেলোয়ার হোসেন, সংবাদপত্রে ঢাকার মুক্তিযুদ্ধ (২০১৮), বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট।
*বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ সাংবাদিক প্রকাশক: মহাপরিচালক, বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট (২০১৫)।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।