এটা এখন আর আমাদের অজানা নয় যে, ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ গভীর রাত থেকে পাকিস্তানি বাহিনী বাংলাদেশে গণহত্যা শুরু করে। তবে নিশ্চিত পরাজয় জেনে তারা বাঙালি দালাল আলবদর-রাজাকারদের সহযোগিতায় ১০ ডিসেম্বর দিবাগত রাত থেকে প্রতিদিন তারা পরিকল্পিতভাবে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে হত্যা করেছিল। ধারণা করা হয় ১৪ ডিসেম্বর একযোগে অনেককে হত্যা করে রায়েরবাজার এবং মিরপুরের বধ্যভূমিতে ফেলে রেখেছিল। প্রকৃতপক্ষে ৯ মাসজুড়েই বুদ্ধিজীবী হত্যা অব্যাহত ছিল। কিন্তু পরাজয় আসন্ন জেনে বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার লক্ষ্য থেকে আমাদের বিজয়ের প্রাক্কালে দেয় মরণছোবল। ডিসেম্বরের বুদ্ধিজীবী হত্যাযজ্ঞ ছিল একটি নীলনকশার পরিণতি।
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক সরকারের সামরিক উপদেষ্টা রাও ফরমান আলী মূলত বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের একটি তালিকা তৈরি করেছিল একাত্তরের এপ্রিল মাসেই। পরবর্তী সময়ে সেই তালিকায় আরও নাম সংযোজন করে দালাল আলবদর বাহিনী। পাকিস্তান আমলে পাকিস্তানি দুঃশাসনের বিরুদ্ধে যে লেখক-সাংবাদিক, শিল্পী-শিক্ষকেরা সোচ্চার হয়েছিলেন, যারা জ্ঞান ও মনীষা দিয়ে জাতিকে পথ দেখিয়েছিলেন, তাদের ওপরই হয়েছিল হামলা, তারাই হয়েছিলেন জিঘাংসার শিকার।
নানা কারণেই বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের হোতাদের বিচার হয়নি অনেকদিন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলেও নির্দিষ্ট অপরাধে যারা অভিযুক্ত ছিল, তাদের মুক্তি দেননি। জিয়াউর রহমান যখন সিএমএলএ, তখন দালাল আইন বাতিল করে সকল দালালদেরকেই ছেড়ে দেয়া হয়। এরপর দেশ যখন মিনি পাকিস্তানে পরিণত হয়েছে, তখন ধীরে ধীরে এই দালালেরাই শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকে। বেগম খালেদা জিয়ার সরকারে আল বদর বাহিনীর নেতা মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মুজাহিদ মন্ত্রী পর্যন্ত হয়। বিচারহীনতার কারণে এরা বহুদিন প্রকাশ্য রাজনীতিতে অংশ নিতে থাকে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অঙ্গীকার করেছিলেন মানবাধিকারবিরোধীদের বিচার করবেন। তিনি সেই কাজ শুরু করেছেন। ইতোমধ্যে এদের বিচার শুরু হয়েছে। কারো বিচার হওয়ার পর সাজাও হয়েছে। কেউ দেশের বাইরে থাকায় তাদের শাস্তি কার্যকর হয়নি। কিন্তু এ রকম অপরাধ শাস্তিহীন থাকতে পারে না, সে কথা মাথায় নিয়েই পরবর্তী সময়ে বিচারপ্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে হবে।
পাকিস্তানি স্বৈরশাসকদের শাসন-শোষণ, বঞ্চনা-নিপীড়নের বিরুদ্ধে বাঙালির ধারাবাহিক যে রাজনৈতিক আন্দোলন তার পেছনে প্রেরণাদায়ী ভূমিকা ছিল বুদ্ধিজীবীদের। রাজনৈতিক অধিকার এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে বুদ্ধিজীবীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক কর্মসূচি তৈরির বুদ্ধিবৃত্তিক ভিত্তি তৈরির উপাদান-উপকরণ সংগ্রহ-সরবরাহ করতেন অর্থনীতিবিদ, শিক্ষাবিদসহ সমাজের চিন্তাশীল প্রাগসর মানুষেরা। অধ্যাপক রেহমান সোবহান, মোজাফ্ফর আহমেদ চৌধুরী, আব্দুল মতিন চৌধুরী, আনিসুর রহমানের মতো স্বনামধন্য ব্যক্তিরা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর পেছনের প্রেরণা ও পরামর্শক।
গত শতকের ষাটের দশকে পাকিস্তানের সামরিক-সাম্প্রদায়িক, অগণতান্ত্রিক শাসকদের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ আন্দোলন সংঘটনে বড় ভূমিকা পালন করেছেন শিক্ষাবিদ এবং সাংস্কৃতিক কর্মীরা। রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন, পয়লা বৈশাখ পালন ইত্যাদির মধ্য দিয়ে অসাম্প্রদায়িক একটি জাতি-মানস গঠনের প্রেক্ষাপট তৈরি হচ্ছিল। রাজনৈতিক আন্দোলনের সহায়ক এবং পরিপূরক হিসেবে সাংস্কৃতিক আন্দোলন জোরালো ভূমিকা পালন করায় পাকিস্তানি শাসকদের রাগ-ক্ষোভ ছিল বুদ্ধিজীবীদের ওপর। তাই মুক্তিযুদ্ধের আরম্ভকাল থেকে শেষ পর্যন্ত বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন পাকিস্তানিদের টার্গেট।
আমরা আমাদের শত্রু-মিত্র চিনতে অনেক সময় ভুল করি। শত্রুদের প্রতি নমনীয়তা দেখাই, দরদ দেখাই, মানবিক আচরণ করি। নানা সম্পর্কসূত্র কারো বিরুদ্ধে কঠোর মনোভাব গ্রহণ করা থেকে আমাদের বিরত রাখে, আমাদের দুর্বল করে। একারণে অনেক সময় আমরা ভুল করি এবং চরম খেসারত দিয়ে তারপর অনুশোচনা করি। কিন্তু আমাদের শত্রুপক্ষ ভুল করে না। আমাদের শত্রুরা ভুল করে না, ক্ষমাও করে না। পাকিস্তানিরা ঠিকই তাদের শত্রুচিহ্নিত করেছিল এবং তাদের নিষ্ঠুরভাবে পৃথিবী থেকে বিদায় করেছিল। ওরা কারো বয়স-শিক্ষা, মর্যাদা-সম্মান, খ্যাতি, দেশ-বিদেশে স্বীকৃতি কিছুই বিবেচনা করেনি। নারী-পুরুষ সব কিছু তুচ্ছ বিবেচনা করে বাড়ি থেকে চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে গেছে এবং নির্দয় যন্ত্রণা দিয়ে হত্যা করেছে।
শিক্ষক-সাংবাদিক, সাহিত্যিক-দার্শনিক, চিকিৎসক-প্রকৌশলী, ক্রীড়াবিদসহ বাছাই করে কৃতী মানুষদের নিষ্ঠুর অত্যাচারের মাধ্যমে হত্যা করে তারা পৈশাচিক উল্লাস করেছে। তাদের প্রতিহিংসাপরায়ণতার শিকার হয়েছেন পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার প্রথম প্রস্তাবক ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, মানবসেবায় ব্রতী কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা নূতনচন্দ্র সিংহ। বাদ যাননি অজাতশত্রু আত্মভোলা দার্শনিক ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব। নয় মাস ধরেই একদিকে যেমন গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট এবং বেপরোয়া ধর্ষণ চলেছে, অন্যদিকে তেমনি চলেছে বেছে বেছে কৃতবিদ্য মানুষদের হত্যা। পরাজয়ের আগ-মুহূর্তে তারা দলে দলে বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে গেছে বদ্ধভূমিতে।
পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ভেবেছিল, ভয় দেখিয়ে বাঙালির স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা দমিয়ে দেবে। কিন্তু ওরা বুঝতে পারেনি যে শেখ মুজিবুর রহমান নামের একজন মানুষ বাঙালি সাহসী হতে শিখিয়েছেন। লড়তে, মরতে শিখে বাঙালি মরার দেশে বরাভয় আনতে শেখা বাঙালিকে তাই পাকিস্তানিরা কোনোভাবেই রুখতে পারেনি। তারা যে নীলনকশা তৈরি করেছে, বাঙালি সেটাই ভণ্ডুল করে দিয়েছে। সেরা মানুষদের তালিকা তৈরি করে তারা হত্যা করেও পরাজয় ঠেকাতে পারেনি।
১০ ডিসেম্বর দিবাগত রাতে তারা প্রথমে সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে অপহরণ করে, তারপর সৈয়দ নজমুল হক আর আ ন ম গোলাম মোস্তফাকে। পরদিন তারা অপহরণ করে নিজামুদ্দীন আহমদকে। তার পরদিন ১৩ ডিসেম্বর অপহৃত হন সেলিনা পারভীন। এরা সবাই ছিলেন সাংবাদিক। সাংবাদিকদের প্রতি পাকিস্তানি বাহিনীর কোনো কারণে সম্ভবত বিশেষ আক্রোশ ছিল, সেটা বোঝা যায় মার্চের অপারেশন সার্চলাইটের সময়টিতেই। ২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী দৈনিক ইত্তেফাক, সংবাদ ও দ্য পিপলস পত্রিকায় গোলা ছুড়ে অফিসগুলো ভস্মীভূত করে। সংবাদ অফিসই পাকিস্তানি বাহিনী আগুন লাগিয়ে দিলে একাত্তরের ৩১ মার্চ দগ্ধ হয়ে মৃত্যু হয় শহীদ সাবেরের। বিশিষ্ট সাংবাদিক ও সাহিত্যিক শহীদুল্লা কায়সারকে অপহরণ করা হয়েছিল ১৪ ডিসেম্বর।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ শিক্ষককে অপহরণ করা হয় এদিনটিতেই। মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, আবুল খায়ের, গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, রাশীদুল হাসান, আনোয়ার পাশাসহ অনেকেই এইদিন অপহৃত হয়েছিলেন। ১৫ ডিসেম্বর অপহৃত হন চিকিৎসক ফজলে রাব্বি এবং আলীম চৌধুরী। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে অপহৃত হন ড. আবুল কালাম আজাদ। এই লেখায় শহীদ সব বুদ্ধিজীবীর নাম লেখা না হলেও তারা সবাই অকুতোভয়ে নিজ জাতি, স্বাধিকার আন্দোলন, জাতির ভাষা ও সংস্কৃতির পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন, এবং এই দেশপ্রেমই ছিল পাকিস্তানি ও তাদের দালাল রাজাকার আলবদরের কাছে সবচেয়ে বড় অপরাধ।
তালিকায় থাকা সবাইকে খুঁজে পায়নি অথবা খোঁজার সময়ও পায়নি, তাই হয়তো তারা এখনও বিবেকের কণ্ঠস্বর হয়ে জাতিকে পথ দেখিয়ে চলেছেন।
আমরা এটা জানি যে, একটি জাতির মনন গড়ে ওঠে তার বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্বের বেঁধে দেয়া ছাঁচে। সব লড়াকু মানুষের লড়াইয়ের পথ ও কৌশল এক হয় না। কেউ লড়াই করেন অস্ত্র হাতে, কেউ গান করে, কেউ কবিতা লিখে, কেউ ছবি এঁকে, কেউবা খেলার মাঠে নৈপুণ্য দেখিয়ে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার যোগফল সফলতা তথা যুদ্ধ জয়। সবার রক্তের সিঁড়ি বেয়েই আমরা উড়াতে পারছি স্বাধীনতার রক্তলাল বিজয় পতাকা।
কিন্তু জাতি হিসেবে আমাদের লজ্জা ও অপমানের বিষয় এটাই যে, আমরা একাত্তরের পরাজিত শক্তির কাছে হার মানছি বার বার। আসলে সেদিন আমরা যাদের পরাজিত ভেবেছিলাম, তারা পরাজিত হয়নি। সাময়িক কৌশল বদল করেছিল। সময় ও সুযোগমতো চার পা আগানোর জন্য সেদিন তারা দুপা পিছিয়েছিল। এতেই আমরা খুশি হয়েছিলাম।
আবার কখন কোনদিক থেকে বিপদ আসতে পারে সেটা আমরা তখন সেভাবে ভাবিনি, ভাবার গরজ বোধ করিনি। আমরা অধিকাংশ সময় স্বতঃস্ফূর্ততার ওপর ভর করি। আমরা বিজয় ছিনিয়ে এনে যখন বিজয়-আনন্দে মত্ত হই, আমাদের শত্রুরা তখন ঘাপটি মেরে থাকে, অপেক্ষা করে নিজেদের সুদিনের জন্য। আমাদের বিজয় আমাদের হাতছাড়া হয়। কিন্তু আমাদের শত্রুপক্ষ আমাদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তারা আবার ফণা তোলে।
মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ছিল একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। ধর্ম রাজনীতির নিয়ামক হবে না। অথচ দেশে আজ সাম্প্রদায়িক রাজনীতি আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তিকে আপস-সমঝোতা করে ক্ষমতায় থাকতে হয়।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের বলে যারা নিজেদের দাবি করেন, তারা এক কাতারে দাঁড়াতে পারেন না। তাদের বিভেদ-বিভক্তি শত্রুদের পথ প্রশস্ত করে দেয়। ঐক্যসূত্র না খুঁজে বিভেদের ক্ষেত্র তৈরি করা কি শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মদানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ? তারা জীবন দিয়েছিলেন এমন একটি মুক্ত স্বদেশের জন্য যেখানে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়ানোর সুযোগ কারো পাওয়ার কথা নয়।
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে আমরা আবেগপ্রবণ হই, আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে দিনটি উদযাপন করি। কিন্তু ৩০ লাখ শহীদের রক্তমূল্যে কেনা বাংলাদেশ রাষ্ট্র যদি স্বাধীনতার মূল চেতনা ও বিশ্বাস থেকে দূরে সরে যায় তাহলে কি শহীদদের প্রতি অমর্যাদা করা হয় না?
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক।