বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

মুরাদ হাসানের এমপি পদ থাকা না থাকা

  •    
  • ৮ ডিসেম্বর, ২০২১ ১৩:৫৩

যার বিরুদ্ধে সোশ্যাল মিডিয়ায় নারীদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার, একজন চিত্রনায়িকার শরীর নিয়ে অসম্মানজনক মন্তব্য এমনকি তাকে ধর্ষণ করার হুমকি দেয়ার অভিযোগ প্রমাণিত— তিনি কী করে জাতীয় সংসদের সদস্য হিসেবে বহাল থাকেন? সংসদের বাকি ৩৪৯ সদস্য কি তার সঙ্গে সংসদের চেয়ারে বসতে বিব্রতবোধ করবেন না? এরকম নোংরা মানসিকতা ও বিশ্রী ভাষার লোকের মুখের দিকে তাকিয়ে কি তার নারী সহকর্মীরা কথা বলতে পারবেন?

একটি ইউটিউব চ্যানেলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং তার মেয়েকে নিয়ে নোংরা মন্তব্য এবং দুই বছর আগে চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহির সঙ্গে তার একটি ফোনালাপ ফাঁসের ঘটনায় গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক সমালোচনার মুখে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ডা. মুরাদ হাসান তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। তবে প্রশ্ন উঠেছে, তার সংসদ সদস্য পদ থাকবে কি না? প্রশ্নটি একেবারে অবান্তর নয়। আমরা একটু দেখতে চাই সংবিধান কী বলছে?

মঙ্গলবার আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, মুরাদ হাসানের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হতে পারে। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে সুপারিশ করা হবে। অর্থাৎ তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হতে পারে। সেক্ষেত্রে তার পরিণতি কী?

সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বেশ কিছু কারণে সংসদ সদস্য পদ বাতিল হতে পারে। যেমন: কোনো উপযুক্ত আদালত যদি তাকে অপ্রকৃতিস্থ বলে ঘোষণা করেন; তিনি দেউলিয়া ঘোষিত হওয়ার পর যদি দায় থেকে অব্যাহতি লাভ না করেন; তিনি কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব অর্জন করেন কিংবা কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা বা স্বীকার করেন; তিনি নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে কমপক্ষে দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন; তিনি যদি প্রজাতন্ত্রের কোনো লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত থাকেন; সংসদের অনুমতি ছাড়া তিনি যদি একটানা নব্বই বৈঠকে অনুপস্থিত থাকেন এবং সংবিধানের বহুল আলোচিত ৭০ অনুচ্ছেদের আলোকে তিনি যদি তার দল থেকে পদত্যাগ করেন অথবা সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোট দেন।

দেখা যাচ্ছে, উপরোক্ত একটি কারণও মুরাদ হাসানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। সংবিধান বলছে, দল থেকে পদত্যাগ করলে তার সংসদ সদস্য পদ যাবে। কিন্তু যদি তাকে বহিষ্কার করা হয়, তাহলে বিধান কী— সেটি স্পষ্ট নয়।

দল থেকে বহিষ্কার হলে সংসদ সদস্য পদ যাবে কি না, এই প্রশ্ন আগেও উঠেছে। স্মরণ করা যেতে পারে, একটি হত্যামামলার আসামি হওয়ার পরে টাঙ্গাইলের বিতর্কিত সংসদ সদস্য আমানুর রহমান খান রানাকে জেলা আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কারের পর তার সংসদ সদস্য পদ থাকবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল।

যদিও আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র বলছে, দলের কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার কেন্দ্রীয় সংসদের। ওই সময়ে তিনি দীর্ঘদিন কারাভোগও করেন। তবে তার সংসদীয় আসন শূন্য ঘোষণা করা হয়নি।

দল ও জোটের সিদ্ধান্ত অমান্য করে একাদশ জাতীয় সংসদের সদস্য হিসেবে শপথ নেয়ার কারণে বিএনপি থেকে নির্বাচিত জাহিদুর রহমান জাহিদকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম শরিক গণফোরাম থেকে নির্বাচিত দুজনকেও দল থেকে বহিষ্কার করা হয় এবং স্পিকারের কাছে তাদের আসন শূন্য ঘোষণার আবেদন করা হয়। কিন্তু এই কারণে তাদের সংসদ সদস্য পদ বাতিল হয়নি।

তারও আগে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের পর সপ্তম সংসদে বিএনপির নির্বাচিত দুজন সংসদ সদস্য তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারে যোগ দিয়ে প্রতিমন্ত্রী হয়েছিলেন। তাদের সদস্যপদ বাতিলের বিষয় আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল। কিন্তু কোনো ফলাফল আসার আগেই ওই সংসদের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। নবম সংসদের শেষদিকে জাতীয় পার্টি থেকে সাতক্ষীরা-৪ আসনের সংসদ সদস্য এইচএম গোলাম রেজাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। কিন্তু শেষপর্যন্ত সংসদে তার সদস্যপদ স্বতন্ত্র এমপি হিসেবে বহাল ছিল। এর আগে অষ্টম সংসদের (২০০১-২০০৬) শেষদিকে ক্ষমতাসীন বিএনপি থেকে রাজশাহী-৪ আসনের সাংসদ আবু হেনাকে বহিষ্কার করা হয়।

সেক্ষেত্রেও তার সদস্যপদ বহাল ছিল। দুটি ক্ষেত্রেই সংসদের ব্যাখ্যা ছিল, দল তাদের বহিষ্কার করেছে। কিন্তু তারা দল থেকে পদত্যাগ করেননি। যে কারণে তাদের সদস্যপদ বহাল ছিল। দশম সংসদে সরকারদলীয় সাংসদ আবদুল লতিফ সিদ্দিকী দল থেকে পদত্যাগ করেন। এ কারণে তিনি সংসদ সদস্যপদ হারান।

প্রসঙ্গত, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে অনেক সময়ই বিভ্রান্তির সৃষ্টি হলেও এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে দলের ভেতরে শৃঙ্খলা বজায় রাখা। যাতে করে সংসদের ফ্লোর ক্রসিং এড়ানো যায়। অর্থাৎ যিনি যে দল থেকে নির্বাচিত হয়েছেন, তিনি যেন সেই দলেই থাকে। এই আলোকে কেউ যদি দল থেকে বহিষ্কৃত হন, তাহলেও তার সদস্যপদ বাতিল হয়ে যাওয়া উচিত।

অর্থাৎ দল থেকে পদত্যাগ করলে যদি সংসদ সদস্যপদ বাতিল হয়, তাহলে বহিষ্কৃত হলেও তার সংসদ সদস্যপদ বাতিল হওয়ার কথা। কিন্তু যেহেতু সংবিধানে বিষয়টি স্পষ্ট নয়, ফলে দল থেকে বহিষ্কারের পরও অনেকের সংসদ সদস্যপদ টিকে গেছে। তবে আওয়ামী লীগ যদি সত্যিই তার সংসদ সদস্যপদও বাতিল চায়, সেক্ষেত্রে তাকে দল থেকে বহিষ্কার না করে প্রতিমন্ত্রীর মতো দল থেকে পদত্যাগের নির্দেশ দিতে পারে। সেক্ষেত্রে তার সংসদ সদস্যপদ স্বয়ংক্রিয়ভাবেই বাতিল হয়ে যাবে এবং স্পিকার তার আসনটি শূন্য ঘোষণা করবেন।

সংবিধানের ৬৬ (৪) অনুচ্ছেদ বলছে, কোনো সংসদ-সদস্যের আসন শূন্য হবে কি না, সে সম্পর্কে বিতর্ক দেখা দিলে শুনানি ও নিষ্পত্তির জন্য প্রশ্নটি নির্বাচন কমিশনের কাছে পাঠানো হবে এবং এক্ষেত্রে কমিশনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবে। সুতরাং, এমপি মুরাদের প্রতিমন্ত্রিত্ব যাওয়ার পরে যদি তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয় এবং তখন তার সংসদ সদস্যপদ থাকবে কি না তা নিয়ে বিতর্ক দেখা দেয়, তাহলে বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য নির্বাচনে কমিশনে পাঠানোর সুযোগ রয়েছে। তবে এটা ঠিক, আইন ও সংবিধানের চেয়ে নৈতিকতা অনেক বড় বিষয়। আইনত তার সদস্যপদ থাকবে কি থাকবে না সেটি বিতর্কের বিষয় এবং সময়ই বলে দেবে।

একজন সংসদ সদস্য যখন প্রকাশ্যে গালাগালি, অশ্লীল ও অশ্রাব্য ভাষায় কথা বলেন এবং সেটি নিয়ে গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়, তখন তার সংসদ সদস্যের মতো একটি সাংবিধানিক পদে থাকার নৈতিক অধিকার থাকে না। যে অভিযোগে তিনি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে প্রতিমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন, সেই একই অভিযোগে, নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধে (শাস্তি না হলেও) তার আসনটি শূন্য ঘোষণা করা উচিত। অথবা তার নিজেরই উচিত সংসদ সদস্যপদ ছেড়ে দেয়া।

মুশকিল হলো, আমাদের জনপ্রতিনিধিদের অভিধানে পদত্যাগ বলে কোনো শব্দ নেই। বরং কারো মন্ত্রণালয় বা এখতিয়ারের ভেতরে ভয়াবহ কোনো দুর্ঘটনা বা অনিয়ম হলেও তার দায় নিয়ে কেউ পদত্যাগ করতে চান না। উপরন্তু সেসব ঘটনাকে ‘বিরোধীদের ষড়যন্ত্র’ বলে দাবি করেন। আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত কোনো এক প্রসঙ্গে সংসদে আলোচনায় রসিকতা করে বলেছিলেন: ‘মাননীয় স্পিকার, আমরা দুটি জিনিস ছাড়া আর কিছু ত্যাগ করতে চাই না...।’

সুতরাং যার বিরুদ্ধে সোশ্যাল মিডিয়ায় নারীদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার, একজন চিত্রনায়িকার শরীর নিয়ে অসম্মানজনক মন্তব্য এমনকি তাকে ধর্ষণ করার হুমকি দেয়ার অভিযোগ প্রমাণিত— তিনি কী করে জাতীয় সংসদের সদস্য হিসেবে বহাল থাকেন? সংসদের বাকি ৩৪৯ সদস্য কি তার সঙ্গে সংসদের চেয়ারে বসতে বিব্রতবোধ করবেন না? এরকম নোংরা মানসিকতা ও বিশ্রী ভাষার লোকের মুখের দিকে তাকিয়ে কি তার নারী সহকর্মীরা কথা বলতে পারবেন?

ডা. মুরাদ হাসানের বিষয়টিকে শুধু একজন ব্যক্তির অপরাধ হিসেবে বিবেচনারও সুযোগ নেই। কারণ তিনি একজন জনপ্রতিনিধি; ক্ষমতাসীন দলের এমপি এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের একজন প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। তিনি যা বলেছেন, যা করেছেন তার দায় তার দল ও সংসদ এড়াতে পারে না।

লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

এ বিভাগের আরো খবর