বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীর নতুন অঙ্গীকার

  • হীরেন পণ্ডিত   
  • ৭ ডিসেম্বর, ২০২১ ১৮:১৯

আওয়ামী লীগের ৬ দফা ও ছাত্রদের ১১ দফার মধ্যেও সংসদীয় পদ্ধতির সরকার গঠনের কথা ছিল। বঙ্গবন্ধু তার অন্তরে লালিত আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন করেছিলেন এবং দেশের শাসনব্যবস্থাসহ সব উন্নয়ন ও পুনর্গঠনের কর্মকাণ্ড এগিয়ে নেয়ার কাজে ব্রতী হয়েছিলেন। রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামোয় বঙ্গবন্ধু সর্বদাই সংসদীয় গণতন্ত্রের পক্ষে ছিলেন। তাই মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি করা হলেও স্বাধীন দেশে তিনি রাষ্ট্রপতির পদ ত্যাগ করেন।

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী চলছে। এরই মধ্যে বাঙালির জীবনে নতুন তাৎপর্য নিয়ে এলো বিজয়ের মাস- বাংলাদেশের বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীও এবার। বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীর দিনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশবাসীকে শপথ গ্রহণ করাবেন বলে গণমাধ্যমে খবর এসেছে। খবরটি চমকপ্রদ ও আশাব্যঞ্জক। এই অনুষ্ঠান নিঃসন্দেহে ‘জাতীয় শপথ’ আয়োজন বলে বিবেচিত হবে। এই আয়োজনের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা ও আদর্শ সঞ্চারিত হবে বলে আশা করা যায়।

মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও বিজয়কে সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে উদ্দীপিত করার প্রেরণা শপথ অনুষ্ঠানকে মহিমান্বিত করবে। নতুন প্রজন্মসহ সবার মাঝে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আরও শাণিত হবে। নতুন প্রজন্ম জানতে পারবে, কী মহান আদর্শের ভিত্তিতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ভেতর দিয়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের স্বাধীনতা।

বাংলাদেশের জন্ম নিয়ে অনেকের হতাশাবোধ দেখে বিস্মিত হয়ে যাই! তরুণ প্রজন্মের মধ্যে হতাশার কথা শুনি, তাদের এ প্রকাশ অবাক ও বিষণ্ন করে। তরুণদের মনোজগতে বাংলাদেশের অস্তিত্ব ও দর্শনের কার্যকারিতা সম্পর্কে আরও কাজ করা প্রয়োজন। এই প্রজন্ম যেন আদর্শিকভাবে হারিয়ে না যায়। তাই জাতিগতভাবেও অনেক কিছু করার আছে।

পৃথিবীতে সবসময় তরুণ প্রজন্মের হাত ধরেই রাষ্ট্র বিকশিত ও প্রগতিশীলতার দিকে এগিয়ে যায়। স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টিতেও তরুণ প্রজন্মের অবদান অনেক। কিন্তু বর্তমানে তরুণ প্রজন্মের অনেকের দিকে তাকালে সেই ঐতিহাসিক সত্যটিও যেন মরীচিকায় পরিণত হয়! আদর্শবিচ্যুত তরুণ প্রজন্ম নিয়ে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের রূপরেখা কল্পনাও কষ্টকর, সেজন্য এখনি সাবধান হওয়া দরকার।

স্বাধীনতার স্থপতি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে জনযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এ দেশের মানুষ। ৯ মাসের লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে ৩০ লাখ মানুষের জীবন ও দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে জাতীয় জীবনে মুক্তি আসে।

পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছিল ১৬ ডিসেম্বর। আবার এই ডিসেম্বরেই পাকিস্তানিরা তাদের এ দেশীয় দোসর- রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সহযোগিতায় জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান, বুদ্ধিজীবীদের হত্যায় মেতে ওঠেছিল। এ কারণে বাঙালি বিজয়ের মাসটি উদযাপন করে একই সঙ্গে আনন্দ ও বেদনায়।

প্রতিবছর বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনায় নানা অনুষ্ঠান-আয়োজনের মাধ্যমে মাসজুড়ে বিজয়ের আনন্দ উদযাপন করে বাংলাদেশ। লাল-সবুজ পতাকা ওড়ে সারা দেশে। একটি স্বাধীন-সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় সর্বাধিক অবদান ও আত্মত্যাগ যে মহামানবের, তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। নিজের জীবনের সর্বস্ব বিলীন করে মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও যিনি অবিচল চিত্তে বাংলাদেশকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন, সেই বঙ্গবন্ধু সদ্য স্বাধীন-সার্বভৌম কিন্তু যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে গ্রহণ করেন মহাযজ্ঞ, পালন করেন আরেক ঐতিহাসিক দায়িত্ব।

১৬ ডিসেম্বর বিজয় লাভের পর বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন ১৯৭২-এর ১০ জানুয়ারি। এরপর রেসকোর্স ময়দানে দেয়া তার সেই ভাষণটি প্রণিধানযোগ্য। কেননা, ১৯৭১-এর সাত মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটি যেমন ছিল স্বাধীনতার সুস্পষ্ট রূপরেখা, ঠিক তেমনি ৯ মাস পর স্বাধীন দেশে প্রত্যাবর্তনের পর রেসকোর্সে দেয়া তার ভাষণটিও ছিল ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের একটি রূপকল্প। ওই ভাষণে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ পুনর্গঠনের কাজের প্রতিই তিনি বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছিলেন।

যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে সম্মিলিত উদ্যোগে সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছিলেন বার বার। দৃপ্তকণ্ঠে তিনি ঘোষণা করেছিলেন, বাংলাদেশের পুনর্গঠন কাজ পরিচালিত হবে শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে।

উল্লেখ্য যে, পাকিস্তানে ১৯৭০-এ নির্বাচনের আগে বঙ্গবন্ধু যেসব নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ১৯৭২-এর ১০ জানুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে দেয়া ভাষণেও সেসব নীতিগত দিকনির্দেশনার গভীর অন্ত্যমিল খুঁজে পাওয়া যায়। অর্থাৎ, বঙ্গবন্ধু তার স্বদেশ ও জাতি নিয়ে যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তা সদাজাগ্রত থাকত তার মনে। তাই তার প্রতিটি কথা ও কাজে বার বার ওঠে আসত স্বদেশ গঠন ও জনগণের কল্যাণের কথা।

অসাম্প্রদায়িক ও জাতীয়তাবাদী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের সরকার পদ্ধতি নির্ধারণে মনোনিবেশ করেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশের প্রথম মুজিবনগরে গঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার-কাঠামো ছিল রাষ্ট্রপতি-শাসিত যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার ব্যবস্থায় সংসদীয় গণতান্ত্রিক সরকার। তবে বাংলাদেশ সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ সেসময় নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগ করতেন। বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ১৯৭১-এর ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণার এক স্থানে উল্লেখ করা হয়, সংবিধান প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট থাকবেন এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রজাতন্ত্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকবেন।

আওয়ামী লীগের ৬ দফা, ছাত্রদের ১১ দফার মধ্যেও সংসদীয় পদ্ধতির সরকার গঠনের কথা ছিল। বঙ্গবন্ধু তার অন্তরে চির লালিত আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন করেছিলেন এবং দেশের শাসনব্যবস্থাসহ সব উন্নয়ন ও পুনর্গঠনের বিশাল কর্মকাণ্ড এগিয়ে নেয়ার কাজে ব্রতী হয়েছিলেন। রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামোয় বঙ্গবন্ধু সর্বদাই সংসদীয় গণতন্ত্রের পক্ষে ছিলেন। তাই মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি করা হলেও স্বাধীন দেশে তিনি রাষ্ট্রপতির পদ ত্যাগ করেন।

বাংলাদেশের সংবিধান গৃহীত এবং ১৯৭২-এর ১৬ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হওয়ার পর সংবিধানের বিধিমতে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৩-এর ৭ মার্চ। নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ স্বাধীন বাংলাদেশে সরকার গঠন করে। বঙ্গবন্ধু তার নিজস্ব এবং দলের সমষ্টিগত ধ্যান-ধারণার আলোকে স্বাধীন বাংলাদেশকে সোনার বাংলারূপে গড়তে অসংখ্য উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। তার গৃহীত পদক্ষেপগুলোকে মূল ভিত্তি হিসেবে নিয়ে বাংলাদেশের সব সরকারি কর্মপরিকল্পনা প্রণীত হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে।

প্রশাসনিক কাঠামো সমন্বয়ের পরের কাজটি ছিল জাতীয় সংবিধান প্রণয়ন। মাত্র এক বছরের মধ্যে একটি বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত সংবিধান তৈরি করে বঙ্গবন্ধু ইতিহাস সৃষ্টি করেন। এরপরের কাজটি ছিল অত্যন্ত জরুরি এবং চ্যালেঞ্জিং। বঙ্গবন্ধু সেই কাজটি করেন দৃঢ়চিত্তে ও সুচারুরূপে।

দেশ মুক্ত হওয়ার মাত্র তিন মাসের মধ্যে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সৈন্যদের সে দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করেন তিনি। এমন নজির পৃথিবীর সমসাময়িক ইতিহাসে বিরল। এ ক্ষেত্রে ভারতের সেসময়ের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর অবদানও স্মরণীয়।

দেশ পুনর্গঠনের এ মহাকর্মযজ্ঞে যখন হাত দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ঠিক তখনই দেশের ভেতরে ও বাইরে দানা বাঁধতে থাকে ষড়যন্ত্র। সেগুলো মোকাবিলা করে উন্নয়ন ও পুনর্গঠনের পথে বঙ্গবন্ধু এগিয়ে যাচ্ছিলেন ঠিকই। কিন্তু সব প্রয়াস ব্যর্থ করে দিয়ে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট ষড়যন্ত্রকারীরা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে।

এর সঙ্গে মৃত্যু হয় একটি সদ্য স্বাধীন দেশের উন্নয়নস্পৃহার। কিন্তু তারা সফল হয়নি। জাতির পিতার হাতের স্পর্শে গড়ে ওঠা এ দেশের একেকটি প্রতিষ্ঠান আজও সাক্ষ্য দিচ্ছে- স্থপতি কখনও মরে না। জাতির পিতারও মৃত্যু নেই। তার সুনিপুণ হাতের ছোঁয়ায় গড়ে ওঠা এ রাষ্ট্র তারই আদর্শে উন্নয়নের শিখরে নিয়ে যাচ্ছেন তার সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও রিসার্চ ফেলো, বিএনএনআরসি।

এ বিভাগের আরো খবর