জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে কদিন আগেই বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উত্তরণের সুপারিশ এসেছে। এমন একটা সময় খবরটা এসেছে যখন বাংলাদেশের বিজয়ের ৫০ বছর পূর্তি হতে আর অল্প কদিন বাকি।
বাংলাদেশ যে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি পেল, সেখানে দেশের জনগণ ও সরকারের নীতির ভূমিকা আছে। তবে বিশেষ বিবেচনায় বলা যেতে পারে, এ ক্ষেত্রে বেসরকারি খাত; বিশেষ করে উদ্যোক্তারা সবচেয়ে কার্যকরী ভূমিকা রেখেছে। একই সঙ্গে বিদেশি বিনিয়োগ– হোক সে প্রযুক্তি হস্তান্তর বা গাঁটের পয়সা খরচ করে নতুন কোনো পণ্য বা সেবা তৈরির চেষ্টা। স্বল্পোন্নত বা এলডিসি থেকে উন্নয়নশীলের কাতারে আসার কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে বাংলাদেশের অনেক সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। তবে এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে চাইলে অনেক চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করতে হবে।
সাম্প্রতিক দেশের এই অগ্রযাত্রায় একসময়ের বৈদেশিক সাহায্যনির্ভর অর্থনীতি এখন উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এগিয়ে চলা এই অর্থনীতিকে এখন বিনিয়োগবান্ধব নীতিতে ধাবিত করে পৌঁছাতে হবে উন্নত দেশের তালিকায়।
বিনিয়োগবান্ধব নীতির পথে হাঁটতে অর্থনৈতিক ও ব্যবসায়িক পরিধি বিস্তৃত করার পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের সময়োপযোগী নীতিমালা অবলম্বন করা দরকার। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ বা এফডিআই-এর পরিমাণ ছিল খুবই কম। স্বাধীনতা লাভের পর থেকে বিভিন্ন সময় বিদেশি বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টির জন্য প্রচলিত আইন ও নীতির কিছু পরিবর্তন এবং পরিমার্জন করা হয়েছে। এর সঙ্গে স্বল্প মজুরি, কাঁচামালের সহজলভ্যতা ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনার ফলে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য পরিমাণ প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছে।
তারপরেও কিন্তু বেশ কিছু বাধা রয়েছে। সেগুলো অপসারণ করা সময়ের দাবি। কারণ একটাই, বাংলাদেশ এখন আর কোটারি অর্থনীতির মধ্যে নেই যে কোটার কারণে উন্নত দেশগুলো এ দেশ থেকে তাদের সব পণ্য ও সেবা কিনবে। বরং প্রতিযোগিতা করে বাজারের সেরা সেবা নিশ্চিত করেই এগিয়ে যাওয়া জরুরি।
যুক্তরাজ্য-যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের পাশাপাশি চীন, নেদারল্যান্ডস, জার্মানি ও কানাডার মতো অনেক দেশ এখন বাংলাদেশে বিনিয়োগ করছে। সরকারও বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। এর মধ্যে প্রণোদনা ও উৎসাহমূলক সুবিধার ব্যবস্থাও থাকছে। যদিও অতিমাত্রায় আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতা এখানে অন্যতম বাধা। এ ছাড়া দলিলপত্র প্রক্রিয়াকরণে দীর্ঘসূত্রতা, স্থানীয় উদ্যোক্তাদের প্রয়োজনীয় স্থিরমনস্কতার অভাব ও অহেতুক বিলম্ব সমস্যা সৃষ্টি করছে।
এর বাইরে আমদানি-সংক্রান্ত শুল্ক নীতিতে ঘন ঘন পরিবর্তনের কারণে প্রকৃত প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ কার্যকারিতা অনেকটাই বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এই বিষয়গুলোতে দৃষ্টি না দিয়ে বিদেশি বিনিয়োগকে কেবল আহবান করলেই কাজ হবে না। বিনিয়োগের চলার পথ করতে হবে মসৃণ। তাহলে সেটি স্রোতের মতো প্রবাহিত হয়ে অর্থনীতির এগিয়ে যাওয়ার পথকে প্রসারিত করবে।
জাতিসংঘের কনফারেন্স অন ট্রেড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের বিশ্ব বিনিয়োগের প্রতিবেদন অনুসারে- ২০১৭ সালে বাংলাদেশে এফডিআই-এর পরিমাণ ছিল ২ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার। পরের বছর সেটি চলে আসে ৩ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলারে। কিন্তু কাছাকাছি অর্থনীতির দেশগুলোতে এর পরিমাণ অনেকটাই এগিয়ে। সমস্যাগুলোকে আড়াল না করে যদি স্বীকার করে নিয়ে সমাধানের চেষ্টা করা হয়, তাহলেই বিনিয়োগ তখন আমাদেরকে খুঁজে নেবে এমন আশা করা যায়। তখন আর এখনকার মতো বিনিয়োগ খুঁজতে হবে না। এসব কারণেই সরকারের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রাসহ অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য বিনিয়োগের বিকল্প নেই।
বাংলাদেশে ব্যবসা করার ক্ষেত্রে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এই কারণে বিদেশি বিনিয়োগ প্রত্যাশা অনুযায়ী মিলছে না। এ ছাড়া বিশ্বব্যাংকের ব্যবসা সহজ করার সূচকে বারবার পিছিয়ে পড়াও ভোগাচ্ছে। একই সঙ্গে অবকাঠামোগত দুর্বলতা, অবকাঠামো সঠিক ব্যবহার করতে না পারা, শ্রমিকের যথাযথ দক্ষতার ঘাটতি, সামগ্রিক দুর্নীতি, ব্যবসায়িক বিরোধ নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সম্পত্তি নিবন্ধনে জটিলতা ও ঋণপ্রাপ্তির চ্যালেঞ্জসহ নানা কারণে ব্যবসা শুরু করতেই অনেক সময় লেগে যায়। এসব ব্যাপারও দেশীয় উদ্যোক্তাদের যেমন অনাগ্রহী করে, একই সঙ্গে বিদেশি বিনিয়োগেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
ব্যবসা ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কৃষি হতে পারে বড় একটি ক্ষেত্র। জাতীয় আয়ে কৃষির অবদান আগের চেয়ে কমেছে। কিন্তু এখনও সেটি অনেক। ২০১৯-২০ অর্থবছরেও জাতীয় আয়ে কৃষির অবদান ছিল ১৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ। যদিও শিল্প খাতের অবদান এখানে অনেক বেশি। কিন্তু কৃষি খাতটি এত বিস্তৃত ও সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর এর প্রভাব এত বিশাল যে, শুধু কৃষি খাতের আধুনিকায়ন করে গোটা দেশকে বদলে ফেলা সম্ভব।
কৃষির ক্ষেত্রেও শিল্পের যোগ আছে। কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প গড়ে তুলেও অনেক মানুষের কর্মসংস্থান করা সম্ভব। একই সঙ্গে কৃষি ও মৎস্য খাতের সঙ্গে শিল্পের সংযোগ ঘটাতে পারলে সবার জন্য সুষম খাবারের নিশ্চয়তা অর্জন করা যাবে।
এ ছাড়া প্রযুক্তিগত বিনিয়োগ তো আছেই। যা বিনিয়োগে অনেক বড় ক্ষেত্র। কারণ অগ্রগতির চাকা অনেকাংশে প্রযুক্তিই দ্রুততর করে দিতে পারে। প্রযুক্তির সঙ্গে সঙ্গে আসে নতুন জ্ঞান, নতুন শিক্ষা। সেগুলো ধাপে ধাপে সঞ্চারিত হয় স্থানীয়দের মধ্যে। যেখান থেকে দাঁড়িয়ে যায় নতুন সম্ভাবনা এবং সৃষ্টি হয় হাজার-লাখো কর্মসংস্থান।
সামগ্রিক এই সম্ভাবনাকে আমলে নেয়া জরুরি। খেয়াল রাখা দরকার, প্রতি বছর ২০ লাখ তরুণ শ্রমবাজারে যুক্ত হচ্ছে। চলমান করোনা মহামারিতে শ্রমবাজারের এই চিত্র নিশ্চয়ই আরও জটিল হয়েছে। সুতরাং ব্যবসা ও বিনিয়োগবান্ধব অর্থনৈতিক নীতির দিকে এগিয়ে যাওয়াই বড় সমাধান বলা যেতে পারে।
বিদেশি বিনিয়োগ টানার অসংখ্য ক্ষেত্র বাংলাদেশে রয়েছে। প্রয়োজন শুধু যথেষ্ট সুযোগ তৈরি করা। আবার বিদেশি বিনিয়োগ টানতে যেসব বিষয় গুরুত্বপূর্ণ তার একটি হলো রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা; যেখানে বাংলাদেশ বেশ উন্নতি করেছে। বিদেশি বিনিয়োগ আনতে সর্বোচ্চ রাজনৈতিক সিদ্ধান্তও আছে বাংলাদেশের পক্ষে। বাকি থাকে কেবল পারিপার্শ্বিক উন্নয়ন। সেটির দায় সবার। সবাই মিলে কাজ করলে দেশীয় উদ্যোগ ও বিদেশি বিনিয়োগ মিলে ২০৪১-এর আগেই বাংলাদেশ উন্নত বিশ্বের কাতারে যেতে পারবে বলে আশা করা যায়।
লেখক: কলাম লেখক ও নির্বাহী পরিচালক, ডাক বিভাগের মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস ‘নগদ’।