প্রতিদিন ঘরে ঢুকে বুকে ফুঁ দিই। যাক আজকের মতো অপঘাতে মৃত্যু থেকে বেঁচে গেলাম! অপঘাত বলতে সড়ক দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যাওয়া। ঢাকায় অফিস থেকে বাসা, বাসা থেকে অফিসহ বা অন্যান্য গন্তব্যে হেঁটে চলতে ভালোবাসি। শহরে যানজট দানা বাঁধার আগে থেকেই হেঁটে চলি। আতঙ্কে থাকি সব সময়ই। কখন কোন দ্রুততম সিএনজি, মটরসাইকেল, গাড়ি, বাস এসে প্রাণ ভোমড়াটা কেড়ে নেয়।
এইতো গত পরশু দিন হাতিরঝিলে রাস্তা পার হচ্ছিলাম ঠিকঠাক, হঠাৎ উল্টো পথে মিনি ট্রাক চলে এল। পেছনের পথচারী চিৎকার দেয়ায় বেঁচে গেছি। অল্প কিছু দিন আগে মেয়ে আর আমি রিকশায়। উল্টো দিক থেকে সিএনজি এসে রিকশাকে ধাক্কা দিয়ে চলে গেল। বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারত। এছাড়া প্রতিদিনই বাস, গাড়ির রক্তচক্ষুর সামনে চলি।
হাতিরঝিল, গুলশান, পান্থপথ, ধানমন্ডিতে ডাবল সাইলেন্সারের শব্দ ফাটিয়ে যারা গাড়ি হাঁকান তাদের ভয়েতো জড়সড় থাকতেই হয়। বহুদিন তাদের সামনে পড়ার অভিজ্ঞতাও আছে। একাধিক দিন দেখেছি ওই গাড়ির চালকরা পথ ছেড়ে ফুটপাতে উঠে গেছে। পথচারী এবং অন্য বাহনের যাত্রীরা আহত-নিহত হয়েছেন।
এসব বাহনের চালক শহরের পুঁজিপতিদের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া সন্তান। এদের কেউ মাদকাসক্ত, কেউ বেপরোয়া পুঁজিতে বেপরোয়া। ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী বাবার পাশে বসে গাড়ি চালাচ্ছিল হাতিরঝিলে। ফলাফল দুর্ঘটনা।
দিনপাঁচেক আগে গুলশান দুই নম্বরে মাদকাসক্ত এক তরুণী তার দুই বন্ধু নিয়ে বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালাতে গিয়ে রিকশা উড়িয়ে দেয়। আহত হন মা মেয়ে। ঠিক পরদিনই দশম শ্রেণির স্কুলছাত্র মায়ের পাশে বসে গাড়ি চালাচ্ছিল বেইলি রোডে । প্রচণ্ড গতিতে চালাতে গিয়ে গাড়ি রিকশাকে ধাক্কা দেয়। রিকশায় থাকা বাবা ও তার পাঁচ মাসের শিশু গুরুতর আঘাত পায়। শিশুটি এখনও হাসপাতালে মুমূর্ষু অবস্থায় আছে।
আমরা যদি একটু নব্বই দশকের দিকে ফিরি। মনে পড়বে ইস্কাটন এলাকায় তরুণ কবি-ছড়াশিল্পী বাপ্পী শাহরিয়ারের মৃত্যু হয়েছিল এক প্রভাবশালীর পুত্রের বেপরোয়া গাড়ি চালনায়।
এখানে অপ্রাপ্ত বয়সে স্টিয়ারিংয়ে বসা পুত্র-কন্যাদের দোষ কি দেব? আসলে তো এই দায় অভিভাবকদের। সন্তানদের হাতে গাড়ির চাবি তুলে দিচ্ছেন তারাই। কেউ কেউ সন্তানের বীরত্ব দেখতে পাশে সওয়ার হচ্ছেন। এই যে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই, সন্তানের হাতে গাড়ি চাবি তুলে দেয়া, সন্তান প্রাপ্তবয়স্ক হলেও পথে কীভাবে গাড়ি চালাচ্ছে, তার বন্ধু কারা, সে মাদকাসক্ত কি না, এদিকে নজর দেয়ার দায়িত্ব অভিভাবকদের। অভিভাবক হিসেবে আমরা সেই দায়িত্ব থেকে অনেক দূরে।
আমরা নিজেদের সন্তানের নৈতিকতার শৃঙ্খলায় বাঁধতে পারছি না। কারণ নিজেরাই নৈতিকতার পথ থেকে সরে গেছি। আমাদের অবৈধ, বেপরোয়া আয়ের উৎস সন্তানদের কাছে দৃশ্যমান। তাই তারা আমাদের কাছে যখন আবদার করে, সেই আবদারে এক প্রচ্ছন্ন হুমকিও থাকে। না দিলে লোকে জানবে অবৈধ আয়ের উৎসের কথা। নিজেরাও আমরা অবৈধ অর্জন উপভোগে এতটাই মাতোয়ারা থাকি যে, সন্তানদের দিকে নজর রাখার অভ্যাস বা নিয়ম ভুলে যাই। কখনও কখনও নিজেদের ভোগ-উপভোগে সন্তানদেরকেও সঙ্গী করি।
নিজেরাই নৈতিকতার শৃঙ্খলায় না থাকায়, ওই পথে সন্তানদের চিনিয়ে নিয়ে যাওয়ার মনের জোরও আমরা হারিয়ে ফেলেছি। আমাদের কোনো কোনো পরিবারে হয়তো সচ্ছলতা এসেছে জলোচ্ছ্বাসের গতিতে। সেই জলোচ্ছ্বাস দুই কূল এমনভাবে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে যে, তাতে ব্যক্তিগত ও সামাজিক দুর্ঘটনা বাড়ছেই। সড়ক দুর্ঘটনার মাধ্যমে হয়তো আমরা এর বাহ্যিকতা দেখতে পাচ্ছি, ভেতরও পুড়ছে। কবে যে সেই দগ্ধতা বিস্ফোরণে রূপ নেয় সেই আতঙ্কে আছি।
লেখক: সাংবাদিক, কলাম লেখক।