জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে একটা জনযুদ্ধের ভেতর দিয়ে গড়ে ওঠা বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী জাতীয় ঐক্যের প্রতীক। মুক্তিযুদ্ধের সময় যেমন দেশমাতৃকাকে স্বাধীন করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তেমনি স্বাধীন বাংলাদেশেও সময়ের প্রয়োজনে নানা সংকটে জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে বহুবার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত সশস্ত্র বাহিনী আমাদের জাতির অহংকার।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ যখনই ক্ষমতায় এসেছে সশস্ত্র বাহিনীর উন্নয়নে কাজ করছে। কারণ আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। সশস্ত্র বাহিনীকে কখনও আমাদের ক্ষমতা দখলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করিনি।’ বঙ্গবন্ধু সশস্ত্র বাহিনীর যে সূদৃঢ় ভিত্তি রচনা করে গেছেন তারই ওপর দাঁড়িয়ে আজ আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর পেশাদারত্ব ও কর্মদক্ষতা দেশ ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে স্বীকৃত ও প্রশংসিত।
এবারও জাঁকজমকপূর্ণ ও সাড়ম্বরে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত হচ্ছে ৫১তম সশস্ত্র বাহিনী দিবস। সশস্ত্র বাহিনী প্রতিটি রাষ্ট্রের জন্য সার্বভৌমত্ব ও মর্যাদার প্রতীক। আমরা উন্নয়নশীল ছোট দেশ। কিন্তু আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর কর্মদক্ষতা ও পেশাদারত্ব আজ সারা বিশ্বের মানুষের কাছে প্রশংসিত।
এটা কোনো আগ্রাসী ভূমিকায় জয়লাভের জন্য নয়, বিশ্বব্যাপী জাতিসংঘের হয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় অসামান্য পেশাদারত্বের জন্য বাংলাদেশের সশস্ত্রবাহিনী আজ বিশ্ব অঙ্গনে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত। এই মর্যাদা ও সম্মান বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষের। শুধু বিদেশে নয়, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জাতীয় অবকাঠামো উন্নয়ন ও নিরাপত্তা বিধানে সেনাবাহিনীর ভূমিকায় বাংলাদেশের মানুষও সমানভাবে গর্বিত। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্ম ও বেড়ে ওঠা অন্যান্য দেশের থেকে অনেকটাই ভিন্ন।
আমাদের সেনাবাহিনীর জন্ম হয়েছে যুদ্ধক্ষেত্র, মুক্তিযুদ্ধের সময়, যে যুদ্ধটি ছিল জনযুদ্ধ। সে যুদ্ধের মহানায়ক ও সুপ্রিম কমান্ডার ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আজকে যারা সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে রয়েছেন তারা সবাই মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী প্রজন্ম। তাদের জন্য শিকড়ের সন্ধান করতে হলে ইতিহাসের দিকে তাকাতে হবে এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্মের কথা জানতে, শুনতে ও বুঝতে হবে।
সশস্ত্র বাহিনীর আজকের প্রজন্মকে জানতে হবে, সে যুদ্ধে কৃষক-শ্রমিকের সন্তান, কুলি-মজুরসহ সাধারণ মানুষ সেনাবাহিনীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। জনযুদ্ধের ভেতরে জন্ম বলেই এ দেশের সাধারণ মানুষের আবেগ, অনুভূতি, চেতনা সবকিছুর সঙ্গে সেনাবাহিনীর একটা আত্মিক সম্পর্ক রয়েছে।
একথা সত্য যে, শত প্রতিকূলতা, অর্থনৈতিক সংকট, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগড়ার পর পরই বঙ্গবন্ধু তার জীবনের আকাঙ্ক্ষা, সেনাবাহিনীর মর্যাদার প্রতীক বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথম ব্যাচের অফিসারদের প্রশিক্ষণ সমাপনী কুচকাওয়াজে বঙ্গবন্ধু স্বয়ং হাজির হয়ে তার মনের কথা ক্যাডেটদের কাছে জাতির পিতার অবস্থান থেকে ব্যক্ত করেন। ক্যাডেটদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধুর সেই অমূল্য ভাষণের কিছু অংশ এখানে তুলে ধরছি- বঙ্গবন্ধু ভাষণে বলেছিলেন-
“আজ সত্যিই গর্বে আমার বুক ভরে যায়। বাংলাদেশের মালিক আজ বাংলাদেশের জনসাধারণ। সে জন্যই সম্ভব হয়েছে আজ আমার নিজের মাটিতে একাডেমি করা। আমি আশা করি, ইনশা আল্লাহ এমন দিন আসবে, এই একাডেমির নাম শুধু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নয়, সমস্ত দুনিয়াতে সম্মান অর্জন করবে।”
এ কথার মাধ্যমে বোঝা যায়, সেনাবাহিনী নিয়ে বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ পরিকল্পনা ছিল এবং ভবিষ্যতে তিনি একটা মর্যাদাপূর্ণ সেনাবাহিনী গড়ে তোলার লক্ষ্যে মিলিটারি একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন। বঙ্গবন্ধু আবেগের সঙ্গে বলেন-
“পাকিস্তানিরা মনে করত বাঙালিরা কাপুরুষ, বাঙালিরা যুদ্ধ করতে জানে না। পাকিস্তানি সৈন্যরা বাংলাদেশের মাটিতে দেখে গেছে কেমন করে বাঙালিরা যুদ্ধ করতে পারে।”
ভাষণের শেষাংশে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন-
“মনে রেখো, তোমাদের মধ্যে যেন পাকিস্তানের মেন্টালিটি না আসে। তোমরা পাকিস্তানের সৈনিক নও, তোমরা বাংলাদেশের সৈনিক।” বঙ্গবন্ধুর ভাষণ আজও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্য সমানভাবে প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন রাষ্ট্রনায়ক। তিনি জানতেন, একটা দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় শুধু সশস্ত্র বাহিনী নয়, বৃহত্তর জনগণ ও সেনাবাহিনীর মধ্যে একাত্মতা অপরিহার্য। সেজন্যই বঙ্গবন্ধু বলেছেন- “আমার সেনাবাহিনী হবে জনগণের সেনাবাহিনী। দুয়ের মধ্যে কোনো দূরত্ব থাকবে না।”
কিন্তু বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডে সেনাবাহিনীর একাংশের জড়িত থাকা এবং পর পর দুজন সেনাপ্রধান দীর্ঘ ১৫ বছর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সেনাশাসন চালিয়ে জনগণ থেকে সেনাবাহিনীকে অনেক দূরে সরিয়ে নেন, দুয়ের মধ্যে বিশাল দূরত্ব সৃষ্টি করেন, যা দেশ ও জাতির জন্য মহাক্ষতির কারণ হয়েছে। সময়ের হাত ধরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আবার জনপ্রত্যাশার সমান্তরালে এসে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে। আজ বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনী পেশাগত উত্কর্ষে বিশ্বের যেকোনো সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে তুলনীয়।
মিসাইল, আধুনিক ট্যাঙ্ক ও গোলন্দাজ বাহিনীর সব শাখাসহ সেনাবাহিনী এমন সব উপাদান সহকারে স্বয়ংসম্পূর্ণ। ২০৩০ সালের জন্য নির্ধারিত ফোর্সেস গোলকে সামনে রেখে সেনাবাহিনীর অগ্রযাত্রা অব্যাহত রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় উচ্চশিক্ষা ও প্রশিক্ষণের জন্য রয়েছে নিজস্ব বিদ্যাপীঠ ও প্রশিক্ষণকেন্দ্র। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জাতিসংঘের শান্তি মিশনে এখন প্রথম কাতারের দেশের মধ্যে আছে, কয়েক বছর এক নম্বর দেশের মর্যাদায় ছিল। বিশ্বের অন্যান্য দেশ এখন বাংলাদেশকে শান্তি রক্ষা মিশনের জন্য একটি মডেল হিসেবে গণ্য করে।
শুধু স্বাধীনতা যুদ্ধে নয়, সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের অতন্দ্র প্রহরী। শুধু দেশেই নয়, বিদেশের মাটিতে আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকাণ্ড বিশ্বের সব দেশের শীর্ষ স্থানে রয়েছে। যার প্রশংসায় পঞ্চমুখ জাতিসংঘ। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশনে সিয়েরালিয়ন, লাইবেরিয়া, আইভরিকোস্ট, কঙ্গো, হাইতি, লেবানন, সোমালিয়াসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি সশস্ত্র বাহিনী শান্তি রক্ষার পাশাপাশি ওই সব দেশের আর্থিক ও সামাজিক উন্নয়নে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ এবং অসহায় মানুষের পুনর্বাসনে সার্বিক সহযোগিতা করে যাচ্ছে। বর্তমান সরকারের সময় সশস্ত্র বাহিনীতে যে আধুনিকায়ন করা হয়েছে অতীতে কোনো সময়ই তা করা হয়নি। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন-
‘বিগত এক দশকে সশস্ত্র বাহিনীর প্রতিটি শাখাকে আধুনিক সমরাস্ত্র ও উপকরণ দিয়ে সমৃদ্ধ করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় দুটি পদাতিক ব্রিগেড, রামুতে ১০ পদাতিক ডিভিশন, সিলেটে ১৭ পদাতিক ডিভিশন, পদ্মা সেতু প্রকল্পের নিরাপত্তা ও তদারকির জন্য একটি কম্পোজিট ব্রিগেড, স্পেশাল ওয়ার্কস অর্গানাইজেশন ছাড়াও ১০টি ব্যাটালিয়ন, এনডিসি, বিপসট, এএফএমসি, এমআইএসটি, এনসিও’স একাডেমি ও বাংলাদেশ ইনফ্যান্ট্রি রেজিমেন্টাল সেন্টারের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানসমূহ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।’
এছাড়া নৌবাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধিতে আইএফএফ প্রস্তুতকরণ প্রকল্প, মাইন-টর্পেডো ডেভেলপমেন্ট, গান ডেভেলপমেন্টসহ বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। বাংলাদেশ বিমান বাহিনী ক্রমাগত প্রচেষ্টা ও নিজস্ব বিশেষজ্ঞ দিয়ে উন্নত প্রযুক্তির সফটওয়্যার তৈরি করে সাইবার নিরাপত্তা ও নেটওয়ার্ক-কেন্দ্রিক ওয়্যারফেয়ারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। দেশে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সম্মুখসারিতে থেকে কাজ করছে সশস্ত্র বাহিনী।
যথাযথ মর্যাদা ও উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে আজ সশস্ত্র বাহিনী দিবস উদযাপিত হচ্ছে। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি ও সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী প্রদান করেছেন।
১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারী সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী সকালে ঢাকা সেনানিবাসের শিখা অনির্বাণে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেছেন। তিন বাহিনী প্রধানরা সশস্ত্র বাহিনী প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন।
আমাদের প্রত্যাশা গণতান্ত্রিক এবং নিয়মতান্ত্রিক নেতৃত্বের প্রতি অনুগত ও শ্রদ্ধাশীল থেকে পেশাগত দক্ষতা ও দেশপ্রেমের সমন্বয় ঘটিয়ে এদেশের সশস্ত্র বাহিনী তার অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে সদা তৎপর থাকবে। জাতির সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়াই তাদের অঙ্গীকার।
লেখক: রাজনৈতিক কর্মী