নারী জাগরণের পথিকৃৎ হিসেবে তাকে বেশিরভাগ সময় সম্বোধন করা হয়। এটা কিন্তু তার প্রতি অবিচার। কারণ নারী জাগরণের পথিকৃৎ বলতে আমরা যা বুঝি, সুফিয়া কামাল শুধু এটুকুতেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না। বরং যদি বলা যায় তিনি বাঙালি জাগরণের পথিকৃৎ, তবেই বরং তার প্রতি সুবিচার করা হয়। তিনি সুফিয়া কামাল। কেবল সাহিত্যচর্চার মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থেকে বাঙালি জাতির যেকোনো দুর্যোগের সময় তিনি হাজির হয়েছেন জননীর মতো।
১৯৬১ সাল থেকে পূর্ব পাকিস্তানে রবীন্দ্রসংগীত প্রচারের ওপর নেমে আসে পাকিস্তানি শাসকদের গোপন নিষেধাজ্ঞা। সে বছর পুরো দুনিয়া যেখানে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে, সেখানে রেডিও পাকিস্তান কোনো প্রচার করেনি। শুধু তাই নয়, কিছু ‘বাঙালি’ বুদ্ধিজীবী দিয়ে রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে বিষোদগারও করানো হয় নানাভাবে।
ব্যতিক্রম ছিলেন সুফিয়া কামালসহ আরও অনেক বাঙালি সংস্কৃতিকর্মী, বুদ্ধিজীবী ও লেখক। পাকিস্তানি শাসকদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞার থমথমে পরিবেশের মধ্যেও ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠান পালন করেন তারা। অনুষ্ঠান শেষে একটি দলের সদস্য হিসেবে জয়দেবপুরে বনভোজনে যান সুফিয়া কামাল। সেখানে ‘ছায়ানট’ নামের একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠার কথা আলোচিত হয়। আর সেই সূত্রে ছায়ানটের সভাপতি করা হয় সুফিয়া কামালকে।
১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের সময় পাকিস্তান রেডিও ও টেলিভিশনে রবীন্দ্রসংগীত প্রচার বন্ধ থাকে। এরপর ১৯৬৭ সালের জুনে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। ওই বাজেট অধিবেশনে রাজশাহী থেকে নির্বাচিত বিরোধীদলীয় সদস্য মজিবর রহমান চৌধুরীর এক প্রশ্নের উত্তরে তথ্যমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিন মন্তব্য করেন, পাকিস্তানি আদর্শের সঙ্গে না মিললে রেডিও-টেলিভিশনে রবীন্দ্রসংগীত প্রচার বন্ধ করে দেয়া হবে।
এ সংবাদ ঢাকার সংবাদপত্রে (দৈনিক পাকিস্তান ও অবজারভার, ২৩-২৮ জুন ১৯৬৭) প্রকাশিত হলে ২৫ জুন ১৯ জন বিশিষ্ট বাঙালি এর প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দেন- রবীন্দ্রনাথ বাংলাভাষী পাকিস্তানির সাংস্কৃতিক সত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রতিবাদীদের একজন ছিলেন সুফিয়া কামাল।
ছোটবেলা থেকেই সুফিয়া কামাল ছিলেন প্রতিবাদী এবং সমাজ সেবকও। সুফিয়া কামাল নিজেই জানিয়েছেন, ‘চৌদ্দ বছর বয়সে বরিশালে প্রথমে সমাজ সেবার সুযোগ পাই। বাসন্তী দেবী ছিলেন অশ্বিনীকুমার দত্তের ভাইয়ের ছেলের বৌ। তার সঙ্গে দুস্থ মেয়েদের বিশেষ করে মা ও শিশুদের জন্য মাতৃসদনে আমি কাজ শুরু করি।’
এই হলেন সুফিয়া কামাল। কবি-লেখক, সমাজসেবক-সংস্কৃতিকর্মী, বুদ্ধিজীবী। বাঙালি জাতিসত্তার এক মহিরুহ। ১৯১১ সালের ২০ জুন সোমবার বরিশালের শায়েস্তাবাদে মামাবাড়িতে তার জন্ম। বাবা সৈয়দ আব্দুল বারী এবং মা সৈয়দা সাবেরা খাতুন। আরব্য উপন্যাসের হাতেম তাইয়ের কাহিনি থেকে নানি তার ডাক নাম রাখেন হাসনা বানু। আর দরবেশ নানা তার নাম রেখেছিলেন সুফিয়া খাতুন।
সুফিয়া খাতুনের বাবা পেশায় ছিলেন উকিল। কিন্তু তার সাত বছর বয়সে সুফি সাধক হওয়ার প্রেরণায় ঘর ছাড়েন বাবা। বাধ্য হয়ে মাসহ নানার বাড়িতে আশ্রয় নিতে হয় তাকে। ওদিকে তার নানা বাড়ির সবাই ছিলেন রক্ষণশীল মুসলিম। শায়েস্তাবাদের নবাব পরিবার হওয়ায় তার নানার বাড়ির কথ্যভাষা ছিল উর্দু। এ কারণে অন্দরমহলে মেয়েদের আরবি, ফারসি শেখার ব্যবস্থা থাকলেও বাংলা শেখানো ছিল হারাম পর্যায়ে। তবে সেখানে ছিল বিশাল পাঠাগার। মায়ের উৎসাহ ও প্রেরণায় লুকিয়ে সেই পাঠাগার থেকে বই পড়তেন সুফিয়া কামাল।
মায়ের কাছে বাংলা শেখেন। রক্ষণশীল পরিবারের মেয়েদের স্কুল-কলেজে পড়ার তো প্রশ্নই আসে না। কিন্তু সুফিয়া কামালের জেদের কাছে হার মেনে পায়জামা-আচকান আর মাথায় টুপি পরে ছেলের ছদ্মবেশে তাকে কিছুদিনের জন্য স্কুলে পাঠাতে বাধ্য হলো তার পরিবার। বাকিটা শিখেছেন নিজেই। তাকে সহায়তা করেছিলেন স্থানীয় পোস্ট অফিসের পোস্ট মাস্টার প্যারীলাল বাবু ও তার বড়ভাই সৈয়দ আবদুল ওয়ালী। মাত্র সাত বছর বয়সে কলকাতায় বেগম রোকেয়ার সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়। প্রথম সাক্ষাতেই সুফিয়াকে নিজের স্কুলে ভর্তি করে নিতে চেয়েছিলেন বেগম রোকেয়া। কিন্তু তার পরিবারের অতি রক্ষণশীলতার কারণে আর সে সুযোগ হয়নি।
মাত্র ১৪ বছর বয়সে মামাতো ভাই সৈয়দ নেহাল হোসেনের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। নেহাল হোসেন ছিলেন প্রগতিশীল ও নারী শিক্ষার সমর্থক। স্বামীর উৎসাহ, অনুপ্রেরণা ও সহযোগিতায় সুফিয়া এন. হোসেন নামে (তখনও তার নাম সুফিয়া কামাল হয়নি) লেখা প্রকাশিত হতে লাগল বিভিন্ন পত্রিকায়। এজন্য পরিবার থেকে প্রচুর সমালোচনা ও গঞ্জনার শিকার হয়েছেন নেহাল।
১৯২৮ সালে পারিবারিক ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে প্রথম বাঙালি মুসলমান নারী হিসেবে বিমানে উড্ডয়ন করেন সুফিয়া। এ জন্য বেগম রোকেয়া তাকে অভিনন্দন জানান বিশেষভাবে। ১৯২৯ সালে রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে গেলে বিশ্বকবির হাত থেকে গোরা উপন্যাস পান উপহার হিসেবে।
১৯৩০ সালে ছবিসহ মহিলা ‘সওগাত’ পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নেন মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন। স্বামীর অনুমতিক্রমে মহিলা সওগাত বঙ্গাব্দ ভাদ্র ১৩৩৬ সংখ্যায় ছবিসহ তার ‘বিড়ম্বিতা’ কবিতা প্রকাশিত হয়।
১৯৩২ সালে ক্ষয়রোগে স্বামীর মৃত্যুর পর চরম দুর্ভোগে পড়েন সুফিয়া। পরের বছর কলকাতা করপোরেশন স্কুলে শিক্ষকতার সুযোগ পান তৎকালীন এডুকেশন অফিসার ক্ষিতীশ প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের সহযোগিতায়। তিন মাসের মধ্যে যোগ্যতার পরিচয় দিয়ে শিক্ষয়িত্রী পদে স্থায়ীভাবে নিয়োগ পান।
১৯৩৮ সালে প্রকাশিত তার কাব্যগ্রন্থ ‘সাঁঝের মায়া’র ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। চট্টগ্রামের চুনতীর কামালউদ্দিন খানের সঙ্গে তার বিয়ে হয় ১৯৩৯ সালে। এরপর থেকে তিনি সুফিয়া কামাল নামে পরিচিত হন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সুফিয়া কামাল।
১৯৪৬ সালে কলকাতায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় নিজের এক মেয়েসহ কলকাতা ব্রেবোর্ন কলেজ সেন্টারে আশ্রয়কেন্দ্র পরিচালনা করেন। দাঙ্গার পর কংগ্রেস একজিবিশন পার্কের মধ্যে ‘রোকেয়া মেমোরিয়াল স্কুল’ নামে একটি কিন্ডারগার্টেন পদ্ধতির স্কুল চালু করেন।
১৯৪৭ সালের ২০ জুলাই কলকাতার ‘সওগাত’ অফিস থেকে ‘সাপ্তাহিক বেগম’ নামে নারীদের জন্য নতুন একটি সাহিত্যপত্রিকা প্রকাশ করেন মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন। নতুন এ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন সুফিয়া কামাল।
প্রথম মুসলমান নারী হিসেবে অল ইন্ডিয়া রেডিওতে স্বরচিত কবিতা আবৃত্তিও করেছিলেন সুফিয়া কামাল। আর এভাবেই তিনি একের পর সামাজিক প্রতিবন্ধকতা, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে লাগলেন।
দেশ বিভাগের পর কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে আসেন সুফিয়া কামাল। নতুনভাবে শুরু করেন তার বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। ১৯৫১ সালের শেষের দিকে সমাজ-সচেতন নারীদের এক সমাবেশে গঠিত হয় ‘ঢাকা শহর শিশু রক্ষা সমিতি।’ সুফিয়া কামাল এ সমিতির সভানেত্রী নির্বাচিত হন। তারপর জড়িয়ে পড়েন বাংলা ভাষা আন্দোলনে। ভাষা আন্দোলন নিয়ে অনেক কবিতা ও প্রবন্ধ লেখেন।
১৯৫৬ সালে দিল্লিতে সাহিত্য সম্মেলনে অংশ নেন সুফিয়া কামাল। ওই বছরের ৫ অক্টোবর ‘কচিকাঁচার মেলা’ নামে প্রগতিশীল শিশু সংগঠন প্রতিষ্ঠা হয় তার বাসভবনে। তিনি ছিলেন এর উপদেষ্টা।
বাংলার আরেক মহীয়সী বেগম রোকেয়া ছিলেন তার আদর্শ। ১৯৬০ সালে সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে ‘বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত স্মৃতি কমিটি’ গঠিত হয়। তার উদ্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রীনিবাসের নাম ‘রোকেয়া হল’ রাখার প্রস্তাব করা হয়।
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ১৯৬৫ সালে ঢাকায় আসেন। পাকিস্তানবিরোধী মনোভাবের কারণে বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে আলোচনায় সুফিয়া কামাল আইয়ুব খানকে বলেছিলেন, ‘আপনি সব শুনুন এবং এর একটা সমাধান করে দিয়ে যান।’ তখন আইয়ুব খানের জবাব ছিল, ‘ওধার তো সব ইনসান হ্যায়, এধার তো সব হাইওয়ান’। অর্থাৎ ওদিকে তো সব মানুষ, এদিকে সব জানোয়ার। আইয়ুব খানের মুখের উপর জবাব দিয়েছিলেন সুফিয়া কামাল, ‘আপ তো উও হাইওয়ানকৌ প্রেসিডেন্ট হ্যায়’। অর্থাৎ আপনি তো সেই জানোয়ারদেরই প্রেসিডেন্ট। ১৯৬৯ সালে আইয়ুববিরোধী মহিলাদের সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন সুফিয়া কামাল। মিছিলেরও নেতৃত্ব দেন। গঠন করেন ‘মহিলা সংগ্রম পরিষদ’।
পাকিস্তানের চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক ‘তঘমা-ই-ইমতিয়াজ’ পেয়েছিলেন ১৯৬১ সালে। ১৯৬৯ সালে বাঙালিদের ওপর নির্যাতনের কারণে তিনি সে পদক বর্জন করেন। ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত উপকূলে ত্রাণ বিতরণেও এগিয়ে আসেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে থেকেই পাকিস্তানিরা তার ওপর কড়া নজর রেখেছিল। দুরবিন দিয়ে তার বাসায় গোয়েন্দাগিরি চালাত। তার বাসার সামনে কেউ এলে তল্লাশি চালাত, যানবাহনের নম্বর লিখে রাখত। এর মধ্যে মার্চে খবর রটে যায় সুফিয়া কামালকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী হত্যা করেছে। বিদেশে এ খবর প্রচারিত হলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হলো। এ থেকে বাঁচতে পাকিস্তানি সরকারি প্রচার মাধ্যম তার সাক্ষাৎকার নিতে চাইলে তিনি এড়িয়ে যেতে লাগলেন। তাদের চাপাচাপিতে শেষ পর্যন্ত তিনি যে বেঁচে আছেন শুধু এটুকু জানাতে রাজি হলেন। তাতেই ওরা রাজি হয়ে গেল।
তারপর তার সঙ্গে যা কথা হলো-
প্রশ্ন: আপনি কেমন আছেন?
সুফিয়া কামাল: আমি মরিনি।
প্রশ্ন: সাহিত্যকর্ম কেমন চলছে?
সুফিয়া কামাল: এ অবস্থায় যেমন চলে।
এরপর আরও অনেক প্রশ্ন করা হয়েছিল তাকে। তিনি জবাব দেননি।
তার নিরাপত্তার বিষয়ে উদ্বিগ্ন ছিল সোভিয়েত সরকার। তাকে বিশেষ বিমানে সোভিয়েত ইউনিয়ন নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাবে তিনি জানালেন, ‘এখন আমি এ দেশ ছেড়ে বেহেশতেও যেতে রাজি নই। আমার দেশের মানুষেরা শান্তি পাক, সোয়াস্তি লাভ করুক। এ দেখে যেন আমি এ মাটিতেই শুয়ে থাকতে পারি।’
মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টায় তিনি নিজের বাড়িতেই ছিলেন। তার অনেক প্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজন তার কাছে রেশন কার্ড রেখে ঢাকা ছেড়েছিল। ওসব কার্ড দিয়ে চাল-ডাল তুলে নিজের বাসায় এনে রাখতেন। মুক্তিযোদ্ধারা সময় সুযোগ করে বাসার পিছনের দেয়াল ডিঙিয়ে এসে তার কাছ থেকে নিয়ে যেতেন সেগুলো।
মুক্তিযুদ্ধের সময় নির্যাতিত নারীদের নিরাপদ আশ্রয় দিতে সদা তৎপর ছিলেন এই মহীয়সী। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত সময় তাকে হত্যা করার জন্য ময়মনসিংহ থেকে আল বদরের বিশেষ ক্যাডার নিয়ে আসা হয়েছিল। মুক্তিবাহিনীর সতর্ক প্রহরার কারণে তিনি প্রাণে বেঁচে যান। আর সেই ক্যাডাররা মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে লড়াইয়ে নিহত হয়।
এটুকুতেই থেমে থাকেননি সুফিয়া কামাল। নিজের দুই মেয়েকে পাঠিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। ভারতের আগরতলায় মুক্তিযোদ্ধাদের সেবার জন্য হাসাপাতাল গঠনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন তার দুই মেয়ে সুলতানা কামাল ও সাঈদা কামাল।
মুক্তিযুদ্ধের পর নির্যাতিত নারীদের পুনর্বাসনের কাজে জড়িয়ে পড়েন সুফিয়া কামাল। তিনি ছিলেন ‘নারী পুনর্বাসন সংস্থা’র সভানেত্রী। আর ‘মহিলা পরিষদ’-এর মাধ্যমে নারী সমাজের সার্বিক মুক্তির কাজ তার কখনও থেমে ছিল না।
বঙ্গবন্ধু পরিবারের সঙ্গে সুফিয়া কামালের ছিল অকৃত্রিম সম্পর্ক। চা বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে বঙ্গবন্ধু সেগুনবাগিচার ১১৫ নম্বর সরকারি বাড়িতে থাকার সময় ১৯৫৮ সালের ১২ অক্টোবর ওই বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার হন। তিন দিনের নোটিসে বাড়িও ছাড়তে হয় বঙ্গবন্ধু পরিবারকে। বেগম মুজিব সিদ্ধেশ্বরীতে একটি বাড়ি ভাড়া নিলেও সরকারি হুমকি ধামকিতে ওই বাড়িটাও ছাড়তে বাধ্য হন। তখন এগিয়ে এসেছিলেন সুফিয়া কামাল। তার প্রচেষ্টায় সেগুনবাগিচার ৭৬ নম্বর বাড়িতে মাসিক ৩০০ টাকার ভাড়ায় ওঠেন বেগম মুজিব।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যার পর বৈরী পরিবেশেও তিনি এ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করেন। আবার চরম বৈরী পরিবেশে বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্ট গঠনে অন্যতম সহায়ক ছিলেন সুফিয়া কামাল। এই ট্রাস্টই ১৯৯৪ সালের ১৪ আগস্ট বাড়িটিকে জাদুঘর হিসেবে ঘোষণা করে সেটাকে ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘরে’ রূপান্তর করে।
১৯৯০ সালে আশি বছর বয়সেও তিনি স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে দেশবাসীকে উজ্জীবিত করার জন্য রাজপথে মিছিলের নেতৃত্ব দেন, তা-ও কারফিউর মধ্যে।
দেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার স্বাধীনতা পদকসহ অসংখ্য পুরস্কার অর্জন করেছেন সুফিয়া কামাল। তবে তার সবচেয়ে বড় পুরস্কার মানুষের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা। এটাও তিনি তার সেবা ও মহত্ত্ব দিয়ে অর্জন করেছেন। ১৯৮৪ সালে মস্কো থেকে তার ‘সাঁঝের মায়া’র রুশ সংস্করণ প্রকাশিত হয়। মস্কোতে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সুফিয়া কামাল। তখনই এক রুশ তরুণ কবি তাকে বলেছিলেন, ‘আপনি গোর্কির মা উপন্যাসের জননী’।
সুফিয়া কামাল ছিলেন অসম্ভব সাহসী এক দেশপ্রেমিক। তার মানসিক শক্তি ছিল অতুলনীয়। তিনি জীবনে অনেকবার ভেঙেছেন, আবার উঠে শুধু দাঁড়ানইনি, ছুটেছেন। শুধু নিজের জন্য নয়, সকলের জন্য ভাবতেন। সকলের জন্য কিছু করার থাকলে করতেন। আর এ কারণেই সকলের মা হওয়ার গুণ ছিল তার। বাংলা, বাংলাদেশ ও বাঙালিদের জন্য তার অসংখ্য অবদান।
আজীবনের সংগ্রামী সুফিয়া কামাল ১৯৯৯ সালের ২০ নভেম্বর শনিবার সকালে বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেন। বাঙালি মুসলমান নারী হিসেবে অনেকগুলো প্রথম কাজ করা সুফিয়া কামালও ছিলেন প্রথম বাংলাদেশি নারী, যাঁকে মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় আজিমপুর কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।
সুফিয়া কামালের প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা।
সূত্র:
একালে আমাদের কাল- সুফিয়া কামাল
সুফিয়া কামাল- ড. সেলিম জাহাঙ্গীর
জননী সাহসিকা বেগম সুফিয়া কামাল শেষ প্রণতি- সম্পাদনা সৈয়দ শামসুল হক
সুফিয়া কামাল স্মারকগ্রন্থ ডিসেম্বর ২০১১
ইন্টারনেট।
লেখক: শিশুসাহিত্যিক, কলাম লেখক।