আমাদের দেশের জনগণ যে কতটা দুর্ভাগা তা দেশের প্রত্যেকটি স্তরে কাজ করতে গেলে বোঝা যাবে। একটা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলতে গেলে, থানায় জিডি করতে গেলে, কিংবা পোস্ট অফিস থেকে কুরিয়ার করতে গেলে তা বোঝা যায়। আমি বলছি না যে কাপড়ের দোকানে গেলে অনেক রঙের শাড়ির ভাঁজ খুলে দেয় তেমন করতে হবে। তা নয়, একটু নাগরিক সম্মান দিতে এমন কী ক্ষতি!
সম্প্রতি এক বন্ধুর কাছে জিজ্ঞেস করেছিলাম তার ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বর(টিন) আছে কি না? তার উত্তরে তিনি বলেছিলেন, না। এর জন্য ব্যাংক যে টাকা কাটে কাটুক কিন্তু তার জন্য যে পরিমাণ ভোগান্তি পোহাতে হয় তা অসহনীয়। সবক্ষেত্রেই এই বিরক্তি দেশের নাগরিকদের তিনবেলা কুঁড়ে খায়। বাজারে গেলে দেখা যাবে কোনো নিয়ম নেই। কোন দ্রব্যের দাম কে কতটা চাইতে পারে সেটাই মূল কথা। এর জন্য কোনো কথা বলা যাবে না, কথা বলার জায়গা নেই।
এবারে পরিবহনের কথায় আসি। এ এক আজব জায়গায় পরিণত হয়েছে। এটা নিয়ন্ত্রণ করেন কে কে সরকার তা জানে। জানা সত্ত্বেও এর নাটের গুরুরা ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকে। দিনের পর দিন পরিবহন সেক্টরের মালিক-শ্রমিক নেতারা দেশটাকে ‘মগের মুল্লুকে’ পরিণত করেছে। বাংলাদেশে সড়ক যোগাযোগ সেক্টরে কী কারণে যেন দেশের প্রচলিত আইন সঠিকভাবে প্রয়োগ করা যায় না। এতে করে আইন অমান্য করতে মালিক-শ্রমিকরা বেপরোয়া। মালিক-শ্রমিকরা ইচ্ছা করলেই পরিবহন ধর্মঘটের নামে দেশবাসীকে জিম্মি করে।
দেশে যা ইচ্ছা করার লাইসেন্স যেন পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের কাছে রয়েছে। ইচ্ছেমতো ভাড়া বাড়ানো, যখন-তখন নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ধর্মঘট ডাকা, সড়কে প্রতিনিয়ত বেপরোয়া প্রতিযোগিতায় সাধারণ মানুষের জীবন নেয়া তাদের কাছে কোনো ব্যাপারই নয়! তারা যখন যা যেভাবে চায়, সেভাবেই হচ্ছে সব। এদের অধিকাংশ বাসের রোড পারমিট নেই, চালকদেরও ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। রাস্তায় তারা যেমন খুশি গাড়ি চালাবে, অযথা প্রতিযোগিতা করবে। বাসচাপা পড়ে পথচারী বা যাত্রী মারা গেলেও কোনো কথা বলা যাবে না।
তাদের লাইসেন্স দেখতে চাওয়া যাবে না। গ্যাসের দাম বাড়লে তারা ভাড়া বাড়াবে, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ালেও ভাড়া বাড়াবে। জনগণের সুবিধা-অসুবিধার দিকে দৃষ্টি দেয়ার প্রয়োজনও বোধ করবে না তারা। কিছু বললেই পরিবহন ধর্মঘট। এই সেক্টর সংশ্লিষ্টদের কাছে যেন জিম্মি সরকার। এই অব্যববস্থার অচলায়তন কাটিয়ে ওঠা জরুরি। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে?
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানের খবর পেয়ে রাজধানীতে গত সোমবার থেকে মিরপুরগামী বাস কমে গেছে। মিরপুর থেকে রাজধানীর বিভিন্ন গন্তব্যে যাত্রীবাহী বাস চলাচল কমে গেছে। এতে বিপাকে পড়েছেন যাত্রীরা। বাস না পেয়ে অনেকে হেঁটে নিজ গন্তব্যে যাচ্ছেন। আবার কেউ কেউ সিএনজি অটোরিকশা ভাড়া করে যাচ্ছেন।
গত বুধবার দুপুরেও মিরপুর-১, ১০, ১১, ১২, কালশি, পূরবী, সিরামিক রোডে যাত্রীবাহী বাস কম ছিল। রাস্তার দুপাশে ফুটপাতে হেঁটে যাচ্ছেন অসংখ্য মানুষ- এমন দৃশ্যই দেখা গেছে। তবে মিরপুর ১২ নম্বরের প্রধান সড়কে বাস পার্কিং করে রাখা হয়েছে। একইভাবে উত্তরা এবং গুলশান থেকেও মিরপুরগামী বাস চলাচল কমে গেছে। কারণ কী? কারণ বিআরটিএ গাড়ির কাগজপত্র দেখছে। বর্ধিত ভাড়ার চার্ট দেখতে চাইছে। অমনি বাস বন্ধ।
পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের আন্দোলনের ফলে সরকার বাসভাড়া বাড়িয়েছে। কিন্তু তার চেয়ে বেশি ভাড়া নিচ্ছেন তারা। এর সঙ্গে যাত্রী হয়রানিও বেড়েছে। গত ১০ নভেম্বর ঘোষণা দেয়া হয়, আগামী তিনদিন পর দেশে ‘সিটিং সার্ভিস’ বা ‘গেটলক’ নামে কোনো পরিবহন থাকবে না। সেই গত রবিবার থেকে বাড়তি ভাড়া আদায় বন্ধ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা না হয়ে উল্টো ‘ওয়েবিল’ ফাঁদে পড়তে হয়েছে যাত্রীদের।
যাত্রীদের অভিযোগ একটি দেশের পরিবহন খাত কীভাবে কোনো ধরনের জানান না দিয়ে জনগণকে জিম্মি করে ধর্মঘটে যায়? তারা যা খুশি তাই ভাড়া নেবে এটা কীভাবে সম্ভব? আমাদের সবজি ফলায় যারা, ধান ফলায় যারা সেই কৃষক ক্ষেতমজুর কি তাদের ইচ্ছামতো ফসলের দাম নির্ধারণ করতে পারে? তা পারে না, পারে পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা। তারা একদফা সরকারের সঙ্গে কথা বলে ভাড়া বাড়িয়ে আদায় করছে তারও বেশি। এভাবেই তারা ভাড়া নৈরাজ্য চালিয়ে যাবে? জনগণের এই সংকট নিরসনে সরকারের কি কিছুই করার নেই? এখনও অধিকাংশ বাসেই ভাড়ার নতুন তালিকা নেই। কেউ আবার করোনার সময়ে সমন্বয় করা বাড়তি ভাড়ার পুরোনো তালিকাই ঝুলিয়ে রেখেছে। অনেক বাসে নতুন ভাড়ার তালিকা সাঁটানো হলেও সেগুলোতেও ‘ওয়েবিল’ অনুযায়ী বাড়তি ভাড়া আদায় করছে।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ‘ওয়েবিল’ হলো এমন এক ব্যবস্থা যার মাধ্যমে যতটুকু দূরত্বেই যান না কেন, এই ‘চেকিং ব্যবস্থার’ নামে যাত্রীকে পরিবহন মালিকদের নির্ধারিত ভাড়াই দিতে হয়। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্বল্প দূরত্বে যাতায়াত করলেও যাত্রীকে গুনতে হয় দ্বিগুণ ভাড়া। বিষয়টি স্বীকার করেছেন পরিবহন মালিক সমিতির নেতারাও। এদিকে সরকারের নির্দেশনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে পরিবহন মালিকদের নিজস্ব ‘চেকিং সিস্টেম’ বা ‘ওয়েবিলের’ মাধ্যমে বাড়তি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে প্রতিদিনই। ফলে যাত্রী ও বাসের চালকের সহকারীদের মধ্যে হচ্ছে বাগবিতণ্ডা। হাতাহাতি পর্যন্ত হচ্ছে যাত্রীদের সঙ্গে। তবুও এই অব্যবস্থা নিরসনে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। সরকারের থেকে এদের হাত অনেক বড়? এটা তারা বার বার দেখিয়েছে।
২০১১ সালের ১৩ আগস্ট মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার জোকা এলাকায় চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ ও সাংবাদিক মিশুক মুনীরকে বহনকারী মাইক্রোবাসের সঙ্গে চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্স পরিবহনের একটি বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে মাইক্রোবাসটি দুমড়ে–মুচড়ে যায়। এ সময় ঘটনাস্থলেই তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরসহ পাঁচজন নিহত ও তিনজন গুরুতর আহত হন। এই মর্মান্তিক ঘটনায় দায়ের মামলায় বাসচালক জামির হোসেনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিলেন মানিকগঞ্জের আদালত। ওই সাজার প্রতিবাদে খুলনা বিভাগের ১০ জেলায় ২০১৭ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি পরিবহন ধর্মঘট শুরু করে পরিবহন খাতের শ্রমিকরা। এই দুর্ঘটনার জন্য আগাম ঘোষণা ছাড়া সারা দেশে গাড়ি চলাচল বন্ধ করেছিল পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা। ধর্মঘটের আগে কোনো আইন অনুসরণ করার কথা তারা ভাবেনি। সম্প্রতি যে ঘটনা তারা ঘটিয়েছে তাও কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য নয়।
অনেকেরই মনে থাকার কথা গত বছর সারাবিশ্ব যখন করোনা ভয়ে জর্জরিত, প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানির খবর আসছে, বাংলাদেশে লকডাউন চলছে- শিথিল হচ্ছে, সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের দু’মুঠো খেয়ে বেঁচে থাকাটাই চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছিল; ঠিক সে সময়ে পরিবহন মালিকেরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে অল্প যাত্রী বহনের অজুহাতে সরকারের সঙ্গে দেন-দরবার করে বাসভাড়া ৬০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করে। দু’দিন যেতে না যেতেই তারা তাদের ওয়াদা ভঙ্গ করে কিন্তু বাসভাড়া কমেনি একটুও। এবারেও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ঘোষণা আসার সাথে সাথে পরিবহন মালিকেরা ধর্মঘট ডেকে সাধারণ মানুষকে চরম দুর্ভোগের মধ্যে ফেলে দিল এবং ভাড়া বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে সমস্যার সমাধান করা হলো।
পৃথিবীর মানুষ দীর্ঘ দুঃসময় কাটিয়ে সবেমাত্র ঘুরে দাঁড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। তখনই পরিবহনের ভাড়া বাড়ানো হলো জ্বালানি তেলের মূল্য অনুযায়ী নয়। শ্রমিক-মালিকদের ইচ্ছেমতো। বাংলাদেশ পৃথিবীর বাইরে নয়। করোনা পরিস্থিতি কেটে গেলে বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়বে একথা সবারই জানা ছিল। সরকার তার আগের নীতি-কৌশল থেকে সরে এসে বিশেষজ্ঞ বা জনমতের তোয়াক্কা না করে ডিজেল ও কেরোসিনে লিটার প্রতি পনেরো টাকা বাড়িয়ে দিল। বিআইডিজি ও পিপিআরসির জরিপ অনুযায়ী, করোনাকালে এদেশে নতুন করে দরিদ্র হয়েছে ৩ কোটি ২৪ লাখ মানুষ।
চলতি বছরের মার্চে নতুন দরিদ্রের সংখ্যা ছিল ২ কোটি ৪৫ লাখ। অর্থাৎ গত ছয় মাসে ৭৯ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে। করোনার প্রবল প্রতাপের সময় ২০২০ সালের জুলাইয়ে লোকসানের অজুহাতে ২৫টি সরকারি পাটকল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। হাজার হাজার শ্রমিক বেকার হয়েছে। তাদের অনেককেই এখনও পর্যন্ত সরকার পাওনা অর্থ বুঝিয়ে দিতে পারেনি। লাখ লাখ অভিবাসী শ্রমিক চাকরি হারিয়ে দেশে ফিরে এসেছে। যাদের রেমিট্যান্স দিয়ে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল থাকে তাদের জীবন-জীবিকার দায়িত্ব নিতে সরকারের অনাগ্রহ কেন, তা স্পষ্ট নয়।
লেখক: গবেষক, প্রবন্ধকার-সাংবাদিক।