বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

নিষ্ঠাবান রাজনীতিকের সংকট

  •    
  • ১৯ নভেম্বর, ২০২১ ১৩:১৪

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু, জাতীয় ৪ নেতাসহ স্বাধীনতা লাভে নেতৃত্বদানকারী নেতাদের হত্যা, জেলে বন্দি রাখা, নেতাদের জন্য রাজনীতিকে কঠিন করে দেয়ার মিশন নিয়ে যে সামরিক কর্মকর্তা ক্ষমতা দখল করেছিলেন, তিনি নিজে রাজনীতিবিদ ছিলেন না। তিনি নিষ্ঠাবান রাজনীতিবিদদের রাষ্ট্রক্ষমতা ব্যবহার করে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দিলেন এবং নিজে রাজনীতির মঞ্চে বসলেন। কিন্তু মূল রাজনীতির কোনো শিক্ষা তার ছিল না। ফলে রাজনীতির মাঠে তিনি যাদের আমদানি করলেন তারা ছিল রাজনীতিতে পরিত্যাজ্য। এরাই পরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে চষে বেড়ায়, দল গঠন করে এবং মিথ্যা গণতন্ত্রের কথা বলে। ফলে নীতি-আদর্শহীন, স্বাধীনতাবিরোধী এবং দেশ ও জাতির কল্যাণবিরোধী ব্যক্তিরা বাংলাদেশের রাজনীতিতে হাইব্রিড নেতাকর্মী তৈরি করার সুযোগ পায়।

জাতীয় সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টাঙ্গাইল-৭ (মির্জাপুর) আসনের সংসদ সদস্য; সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি একাব্বর হোসেনের মৃত্যুতে বক্তব্যদানের সময় গত ১৭ নভেম্বর বুধবার বলেছেন যে, দেশের উন্নয়নে নিষ্ঠাবান রাজনীতিক কতটা প্রয়োজন তা তিনি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেন। প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য দেশের রাজনীতি-সচেতন মানুষের উপলব্ধির সঙ্গে শতভাগ মিলে যায়। দেশ পরিচালনায় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা প্রায় ১৮ বছর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি ভালোভাবেই জানেন দেশপরিচালনার জন্য দক্ষ-অভিজ্ঞ, সৎ ও নিষ্ঠাবান রাজনীতিবিদের প্রয়োজন কত বেশি প্রয়োজন।

বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থা হচ্ছে, এখানে রাজনীতিতে লোকের অভাব নেই। নেতাকর্মী পরিচয়ে যারা এ দল, ও দলে রয়েছে তাদের কতজন সত্যিকার নিষ্ঠাবান রাজনীতিবিদ সেটি নিয়ে অনেক দিন থেকেই রাজনীতি-সচেতন মহলের মধ্যে প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু সত্যিকার রাজনীতিবিদ সেভাবে গড়ে ওঠেনি, যা প্রত্যাশিত ছিল। কেন দেশপরিচালনায় নিষ্ঠাবান রাজনীতিবিদের অভাব ঘটেছে- সেটি গভীরভাবে খুঁজে দেখা দরকার। পাশাপাশি সত্যিকার দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদ হওয়ার পথ প্রশস্ত করাও ভীষণভাবে জরুরি।

বিশেষত, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মতো সংগঠনে নিষ্ঠা ও আদর্শবান রাজনীতিবিদের সংখ্যা যত বেশি হবে; তত শুধু দল হিসেবে আওয়ামী লীগই নয়, বাংলাদেশও রাজনৈতিকভাবে অনেক বেশি অগ্রসর হওয়ার পথ খুঁজে পাবে। সৎ-যোগ্য, আদর্শবান-মেধাবী ও নিষ্ঠাবান রাজনীতিবিদের নেতৃত্বেই বাংলাদেশ আর্থসামাজিক, শিক্ষা-সাংস্কৃতিক এবং আন্তর্জাতিকভাবে বিশ্বের মানচিত্রে উন্নত ও সমৃদ্ধ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে সক্ষম হবে।

যোগ্য রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছাড়া রাষ্ট্র কখনও যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারে না। ইতিহাসের এই শিক্ষা কাউকে স্মরণ করিয়ে দেয়ার প্রয়োজন নেই। বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন এবং স্বাধীনতা-উত্তর রাষ্ট্র পুনর্গঠনে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকা যেমন দেখেছে, আবার পঁচাত্তর-উত্তরকালে যোগ্য রাজনীতিবিদের অভাবে বাংলাদেশ কতটা পিছিয়ে পড়েছিল সে অভিজ্ঞতাও হয়েছে।

শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের ফলে বাংলাদেশ ২১ বছর পর ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ পেয়েছিল। কিন্তু, ২০০১-এর পর নিষ্ঠাহীন ও স্বাধীনতাবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল নেতৃত্বের হাতে দেশের শাসনভার পড়ে যাওয়ায় আবার যে রাজনৈতিক সংকট তৈরি হয়, এর ফলে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিকভাবে ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে অভিহিত করা হয়েছিল। সে অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে বাংলাদেশের প্রয়োজন ছিল ভিশনারি ও মিশনারি রাজনৈতিক নেতৃত্বের।

দিন বদলের সনদ কর্মসূচি নিয়ে শেখ হাসিনা ২০০৮-এর ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। জনগণ শেখ হাসিনার কর্মসূচির মধ্যে দেশের আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক ও শিক্ষা-সংস্কৃতির ব্যাপক পরিবির্তবনের সম্ভাবনা দেখেছিল। ২০০৯ সালে দায়িত্ব গ্রহণের পর শেখ হাসিনা প্রতিশ্রুত সব কর্মসূচি বাস্তবায়নে একের পর এক দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে থাকে।

সে কারণে বাংলাদেশ স্বল্প সময়ের মধ্যে বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান, ডিজিটালাইজেশন-খাদ্য উৎপাদন, কৃষি অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পায়ন-হাইটেক, চিকিৎসা-শিক্ষা, যোগাযোগ ব্যবস্থা, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক-সামাজিক নিরাপত্তাবলয় বৃদ্ধি, মানুষের জীবনমান উন্নয়ন নিশ্চিত করা এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের ধারায় দেশকে ফিরিয়ে আনাসহ বিভিন্ন মেগাপ্রকল্পের উদ্যোগ গ্রহণ করতে থাকেন। এটিই হচ্ছে নিষ্ঠাবান, যোগ্য ও মিশনারি-ভিশনারি নেতৃত্বে দেশকে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধিতে এগিয়ে নেয়ার প্রমাণ।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। তবে তখনও রাজনীতিতে অনেক দল ও রাজনৈতিক নেতা ছিল। কিন্তু সব দল বা নেতাই বাংলাদেশের জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম, ত্যাগ, জেল-জুলুম সহ্য করেছে এমনটি নয়। অনেকেই ছিল পাকিস্তানের অন্ধভক্ত।

তারা পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক নীতির কোনো প্রতিবাদই করেনি। নিজের জনগণের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকসহ যাবতীয় জাতিগত সমস্যার বিষয়গুলো মোটেও আমলে নেয়নি। এই দল ও রাজনীতিবিদদের জাতি-রাষ্ট্র গঠনের জন্য কোনো ভূমিকা থাকে না। বরং তারা জাতির অধিকার আদায়ের বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে।

এদেরকে কখনও রাষ্ট্র ও রাজনীতির মঙ্গলে কাজ করার রাজনীতিবিদ হিসেবে অভিহিত করা যাবে না। আবার বেশকিছু রাজনৈতিক দল বা নেতা ঐতিহাসিক প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে ব্যর্থ ছিল। তারা সমাজবিপ্লবসহ নানা শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামের কথা বলত। কিন্তু জাতির আশু সমস্যা সবসময় তাদের কাছে উপেক্ষিত ছিল।

এসব দল ও রাজনীতিবিদ কখনও জনগণের কাছাকাছি পৌঁছাতে পারেনি। সুখকর হয়নি এদের শেষ পরিণতিও। নানা বিভ্রান্তিতে তারা নিজেরাই একসময় রাজনীতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ইতিহাসে তাদের অবস্থানও স্মরণীয় হয়ে থাকার মতো কিছু নয়।

কারণ তারা পাকিস্তানকালে জাতিগত সমস্যাবিমুখ রাজনীতি করেছে। ফলে তাদের ব্যক্তিগত কিংবা দলগত অবস্থান পরিবর্তিত হয়েছে। নানা উপদলে তারা বিভক্ত হয়েছে এবং অনেকেই শেষ পর্যন্ত জাতির স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক মুক্তিসহ বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে অবস্থান করেছে।

অপরদিকে পূর্ব বাংলার জনগণের অধিকার আদায়ে যারা রাজনীতিতে আত্মনিয়োগ করেছিল, পাকিস্তানের জেল-জুলুম ও অত্যাচার-নির্যাতন ভোগ করে আন্দোলন-সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল- তারাই ধীরে ধীরে জনসমর্থন লাভ করতে থাকে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই ধারার পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ হয়ে উঠেছিলেন। ৬০-এর দশকে এসে তিনি গোটা জাতিকে পাকিস্তানি রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে মুক্ত করার জন্য রাজনৈতিক কর্মসূচি ৬ দফা উত্থাপনের মাধ্যমে যে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন, এর পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল নিষ্ঠাবান-সৎ, ত্যাগী ও আদর্শবান রাজনীতির নেতাকর্মীরা।

এরা পূর্ব বাংলার জনগণের স্বায়ত্তশাসনসহ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকারগুলো মূল নেতা শেখ মুজিবের চিন্তাধারা উপলব্ধির মাধ্যমে বুঝতে সক্ষম হয়েছিল। সেকারণেই শেখ মুজিবকে কেন্দ্র করে বেড়ে ও গড়ে ওঠেছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমেদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, এএইচএম কামারুজ্জামানসহ অসংখ্য রাজনীতিবিদ। যারা ইতিহাসের গতিকে এগিয়ে নিতে জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত ছিলেন।

এমন একঝাঁক নিষ্ঠাবান, দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদ ছাড়া ৬ দফার আন্দোলন কোনোভাবেই সফল হতো না। পাকিস্তানের সামরিক শাসকগোষ্ঠী কিছুতেই পূর্ব বাংলার জনগণের ন্যায্য দাবি-দাওয়া মেনে নিত না। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা রাজনীতিবিদরা জনগণের আস্থা অর্জন করতে পেরেছিলেন। এর ফলেই ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ৭০-এর নির্বাচন এবং ৭১-এর সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ সংঘঠিত করা সম্ভব হয়।

সেখানে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করেও পাকিস্তানিরা আন্দোলন-সংগ্রাম ও স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে স্তব্ধ করতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতেই তার অনুসারী নেতৃত্বস্থানীয়রা মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছিল। এখান থেকেও প্রকৃত নিষ্ঠাবান রাজনীতিবিদের প্রমাণ পাওয়া যায়। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ সে নেতৃত্বেরই অবদান। এটি ভুলে গেলে চলবে না।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু, জাতীয় ৪ নেতাসহ স্বাধীনতা লাভে নেতৃত্বদানকারী নেতাদের হত্যা, জেলে বন্দি রাখা, নেতাদের জন্য রাজনীতিকে কঠিন করে দেয়ার মিশন নিয়ে যে সামরিক কর্মকর্তা ক্ষমতা দখল করেছিলেন, তিনি নিজে রাজনীতিবিদ ছিলেন না। তিনি নিষ্ঠাবান রাজনীতিবিদদের রাষ্ট্রক্ষমতা ব্যবহার করে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দিলেন এবং নিজে রাজনীতির মঞ্চে বসলেন। কিন্তু মূল রাজনীতির কোনো শিক্ষা তার ছিল না। ফলে রাজনীতির মাঠে তিনি যাদের আমদানি করলেন তারা ছিল রাজনীতিতে পরিত্যাজ্য।

এরাই পরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে চষে বেড়ায়, দল গঠন করে এবং মিথ্যা গণতন্ত্রের কথা বলে। ফলে নীতি-আদর্শহীন, স্বাধীনতাবিরোধী এবং দেশ ও জাতির কল্যাণবিরোধী ব্যক্তিরা বাংলাদেশের রাজনীতিতে হাইব্রিড নেতাকর্মী তৈরি করার সুযোগ পায়। কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে ভরে যাওয়া রাজনীতি লুটকারী, সুবিধাভোগী, আদর্শ-প্রকৃত শিক্ষা ও দেশপ্রেমহীন ব্যক্তিরা রাষ্ট্র রাজনীতির সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করে অনেক দিন ধরে।

সেই অবস্থার ফলে তৃণমূল থেকে বর্তমানে আর সৎ-নিষ্ঠাবান রাজনীতিবিদ প্রত্যাশিত মানে ও সংখ্যায় উঠে আসছে না। সেকারণেই সে রাজনীতি নিয়ে শুধু রাজনীতি-সচেতন ব্যক্তিদের মধ্যেই নয়, নেতৃত্বের মধ্যেও হতাশা পরিলক্ষিত হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কণ্ঠে সেই সুরই প্রতিধ্বনিত হয়েছে।

সেকারণেই গুরত্ব দিতে হবে ত্যাগী, আদর্শ-নিষ্ঠাবান ও যোগ্য স্বাধীনতার পক্ষের কর্মী ও নেতাদের। যারা রাজনীতির পথপরিক্রমায় নিজেদের যথার্থ বলে প্রমাণ দিতে সক্ষম হবে তাদেরকেই সামনে তুলে আনতে হবে। এভাবেই দেশ ও স্বাধীনতা রাজনৈতিক নেতৃত্বের ধারাবাহিকতায় বিকশিত হওয়ার সুযোগ পাবে।

লেখক: গবেষক, অধ্যাপক

এ বিভাগের আরো খবর