বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

পিতামাতার দায় অস্বীকারের সুযোগ নেই

  • লাভা মাহমুদা   
  • ১৭ নভেম্বর, ২০২১ ১৮:৩১

সমাজে প্রচলিত আছে, স্ত্রীর প্ররোচনায় স্বামী নিজের পিতামাতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। কথাটা কিছুটা সত্য, কিছুটা সত্য নয়। ব্যক্তিত্বসম্পন্ন পুরুষেরা বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে স্ত্রীর মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রেখেই বাবা-মাকে তাদের প্রাপ্য সম্মান দিতে পারেন। আরেক পরিবার থেকে আগত মেয়েটিকে যেমন আপন করে নিতে হবে পরিবারের সবাইকে, তেমনি মেয়েটিকেও বুঝতে হবে পিতামাতার সঙ্গে তার স্বামীর সম্পর্ক একেবারেই শর্তহীন এবং স্বার্থহীন; ঠিক যেমন মেয়েটির সঙ্গে তার নিজের বাবা-মায়ের সম্পর্ক।

আধুনিক সমাজে প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় বিশ্বায়নের ঢেউ আছড়ে পড়েছে আমাদের দেশেও। অর্থনীতির সূচকগুলো যেমন উপরে উঠছে তরতর করে, তেমনি জীবনমানও বাড়ছে, বাড়ছে চাহিদাও। এখন আর অল্পে তুষ্ট নয় বেশিরভাগ মানুষ। ভোগবাদী জীবন ব্যবস্থা ভালো না মন্দ, সেই বিবেচনা সময়ই করবে। তবে সারা পৃথিবীর মানুষ একই ছাদের নিচে চলে আসছে, মানুষে মানুষে যোগাযোগ বাড়ছে, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-সংস্কৃতি, শিক্ষার প্রসার ঘটছে; এটা অবশ্যই ভালো দিক। পৃথিবী এগিয়ে যাবে আর আমরা পিছিয়ে থাকব, তা হয় না।প্রযুক্তির উৎকর্ষের কারণে কি না, মুক্তবাজার অর্থনীতির কারণে কি না কে জানে- এই সমাজের মানুষের মানসিকতাগুলো রাতারাতি পাল্টে যাচ্ছে। মানুষ দ্রুতই অসামাজিক হয়ে উঠছে, বাড়ছে অসহিষ্ণুতা। সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা লেগেছে পারিবারিক পরিমণ্ডলে। প্রিয়জন, আপনজনেরা দ্রুতগতিতে ছিটকে যাচ্ছে আপন বলয় থেকে। ন্যায়-অন্যায় বোধ হারিয়ে কাণ্ডজ্ঞানবর্জিত আচরণ করছে।সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমরা তথাকথিত সামাজিক হলেও ব্যক্তি জীবনে অতিমাত্রায় আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছি। পরিবারগুলো ভেঙে অণু পরিবার হতে হতে পরমাণু পরিবারে রূপ নিচ্ছে। চারপাশে দৃষ্টি বোলালে সবচেয়ে কষ্ট এবং অস্বস্তিকর যে বিষয়টি ঠেকছে, তা বাবামাকেন্দ্রিক।আমরা পৃথিবীতে এসেছি পিতামাতার মাধ্যমে। তাদের হাত ধরেই এ পৃথিবীর আলো দেখা, চলতে শেখা, এগিয়ে যাওয়া। আমাদের ছন্দবদ্ধ বহতা জীবনের উৎস তো তারাই। অথচ কী অবলীলায় আমরা (অধিকাংশই) তাদের অবহেলা-অনাদর, অসম্মান করছি। এ সমাজে বিপুলসংখ্যক ছেলেমেয়ে আছে, যারা তাদের পিতামাতার দায়িত্ব পালনে ইচ্ছুক নয়। আতঙ্কের বিষয়, সংখ্যাটা দিন দিন বাড়ছে।অবস্থানগত কারণে শহরাঞ্চলে প্রকটভাবে প্রকাশ না পেলেও গ্রামের আঁচটা ব্যাপকভাবেই গায়ে লাগে। বৃদ্ধ বাবা মায়ের আহাজারি, চোখের জল, দরিদ্রতা, চিকিৎসার অভাব, নিঃসঙ্গতা, একাকিত্ব আর কষ্ট মিলেমিশে নিদারুণ এক অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে পরিবারগুলোতে। আগে এটি অশিক্ষিত নিম্নবিত্ত পরিবারে সীমাবদ্ধ ছিল, এখন মধ্যবিত্ত শিক্ষিত পরিবারগুলোকেও গ্রাস করেছে অনেকটা মহামারির মতো।প্রায়ই দেখা যাচ্ছে সন্তান, বিশেষ করে ছেলে সন্তান বিয়ের পর পরই বা বিয়ের কিছুদিনের ভেতরেই বাবা-মা থেকে পৃথক হয়ে স্ত্রীকে নিয়ে আলাদা সংসার পাতছে। বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে অতি আদরের বাবা-মা থেকে। পরম প্রিয় মা-বাবা হয়ে যাচ্ছে বিরাট বোঝা। দায়িত্ব নিতে প্রকাশ্যে অপারগতা প্রকাশ করছে। বাবা-মায়ের সঙ্গে একসঙ্গে থাকাকে উটকো ঝামেলা মনে করছে।বর্তমানে ‘প্রাইভেসি’ শব্দটি বহুল প্রচলিত এবং প্রচারিত। এই প্রাইভেসি নষ্ট হওয়ার দায়ে, খরচের বোঝা বহন করতে না পারার দায়ে, বাসা বা বাড়িতে স্থান সংকুলান না হওয়ার দায়ে, প্রজন্মগত অমিলের দায়ে বাবা-মা থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া বা আলাদা করে দেয়ার বিষয়টি এখন আর শুধু নজির হিসেবে থাকছে না, ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে সমাজের আনাচে-কানাচে সবখানেই।সন্তানকে লালন-পালন করতে, মানুষ করতে জীবনের সর্বস্ব ব্যয় করেন বাবা মা। খেয়ে না খেয়ে মুখে তুলে দেন আহার, দামি খাবারটা, ভালো খাবারটাও সযতনে তুলে রাখেন সন্তানের জন্য। সন্তানের মঙ্গল কামনায় অহর্নিশ আকুল প্রার্থনায় রত থাকেন বাবা-মা। সন্তানের সাফল্যে সবচেয়ে বেশি যারা আনন্দিত হয়, গর্বে বুক ফুলে ওঠে, সে তো বাবা-মা। ব্যর্থতায় ততধিক কষ্ট পান সেও বাবা-মা।

সন্তানের সুরক্ষার কথা মাথায় রেখেই বাড়ি বানালেন পিতা, কষ্টকর উপার্জিত অর্থের অনেকখানি সঞ্চিত রাখলেন সন্তানের সুখের নিমিত্তে অথচ সেই বাড়িতে জায়গা হয় না বাবা-মায়ের। সম্পদ, বাড়ি, অর্থ গ্রাস করে বৃদ্ধ মাকে টেনেহিঁচড়ে কাঠগড়ায় তুলতেও দ্বিধা নেই অনেক যত্নে লালিত সেই সন্তানের। পিতা-মাতা এক সময় অচ্ছুৎ হয়ে যায়।

সব সম্পত্তি লিখে নিয়ে বাবা-মাকে বাড়ি ছাড়া করার উদাহরণ এখন আর হাতে-গোনা নয়। ভেঙে খান খান হয়ে যাচ্ছে বন্ধন-স্নেহ, আদর-ভালোবাসা, আস্থা-বিশ্বাস।এসব নিয়ে নানান বিশ্লেষণ আছে। সমাজ বিজ্ঞানীরা এক ধরনের বিশ্লেষণ দেন, মনোবিজ্ঞানীরা আরেক ধরনের আবার অর্থনীতিবিদরা হয়তো ভিন্ন ধরনের বিশ্লেষণ দেন। কিন্তু পিতামাতার প্রতি দায়িত্ব কর্তব্য পালনে কোনো বিশ্লেষণই গ্রহণযোগ্য বা যথেষ্ট নয়।এটা তো যে সে সম্পর্ক নয়; এটা আত্মার সঙ্গে আত্মার বন্ধন, প্রাণের সঙ্গে নাড়ির যোগ, রক্ত দিয়ে প্রজন্ম সৃষ্টি। এটাতে হিসেব-নিকেশের সীমা-পরিসীমা থাকতে পারে না, পারে না বিচার বিশ্লেষণযোগ্য কোনো কারণও। এ সম্পর্ক শর্তহীন-স্বার্থহীন, অকৃত্রিম-অম্লান।যদিও কন্যা সন্তানদের ক্ষেত্রে বিষয়টি বেশ জটিল। বাঙালি সমাজে মেয়েরা বাবা মায়ের পুরোপুরি দায়িত্ব নিয়েছে, এই সংখ্যাটা নেহায়েত হাতে-গোনা। কৌশলগত কারণেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মেয়েরা পিতামাতার দায়িত্ব নিতে পারছে না।পৃথিবীর আলো দেখার আগে থেকেই বাবা-মা পরম মমতায়, নিবিড় যত্নে আগলে রাখেন মাতৃকোঠরে, নতুন দিনে নতুন সূর্যালোকে সাদরে আহ্বান জানান অদেখা ভুবনে। নিশ্চিত নিরাপত্তা দেন, নিশ্চয়তা দেন বেড়ে ওঠার কালে। বুকের সঙ্গে বুক মিশিয়ে বড় করতে থাকেন, গায়ের সঙ্গে গা সেঁটে পথ চলতে শেখান। অথচ সেই পিতামাতার আজ যখন অবলম্বন প্রয়োজন, তখন সেই সন্তানই মুখ ফিরিয়ে নেয় দ্বিধাহীনভাবে। ফলে বৃদ্ধাশ্রমগুলোর কদর বাড়ছে ঠিক পাশ্চাত্যের মতোই। দিনে দিনে উন্নতির নামে আমাদের মানসিক দৈন্য যত বাড়তে থাকবে; বৃদ্ধাশ্রমগুলো ততই ভরে উঠবে।আবার অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা রয়েছে এমন বাবা-মায়েরা কেবল সন্তান সঙ্গের জন্য আকুল হয়ে প্রতীক্ষা করেন। একটা সময় যখন বুঝতে পারেন নিজের অস্তিত্ব থেকে বেড়ে ওঠা হৃদপিণ্ডটা কখন যেন অন্য কারো হয়ে গেছে, তখন নিদারুণ হাহাকারে দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আর কীই-বা করার আছে।কন্যা সন্তানদের ক্ষেত্রে বিষয়টি আরও জটিল। বাঙালি সমাজে মেয়েরা বাবা মায়ের পুরোপুরি দায়িত্ব নিয়েছে, এই সংখ্যাটা নেহায়েত হাতে-গোনা। কৌশলগত কারণেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মেয়েরা পিতামাতার দায়িত্ব নিতে পারছে না। কিন্তু কেন এতটা নৈতিক অবক্ষয়? কেনই-বা এত লোভ হিংসা অসম্মান?সমাজে প্রচলিত আছে, স্ত্রীর প্ররোচনায় স্বামী নিজের পিতামাতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। কথাটা কিছুটা সত্য, কিছুটা সত্য নয়। ব্যক্তিত্বসম্পন্ন পুরুষেরা বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে স্ত্রীর মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রেখেই বাবা-মাকে তাদের প্রাপ্য সম্মান দিতে পারেন। আরেক পরিবার থেকে আগত মেয়েটিকে যেমন আপন করে নিতে হবে পরিবারের সবাইকে, তেমনি মেয়েটিকেও বুঝতে হবে পিতামাতার সঙ্গে তার স্বামীর সম্পর্ক একেবারেই শর্তহীন এবং স্বার্থহীন; ঠিক যেমন মেয়েটির সঙ্গে তার নিজের বাবা-মায়ের সম্পর্ক। একই পরিবারে একসঙ্গে থাকতে গেলে সমস্যা হতেই পারে, মতের অমিল হতে পারে, প্রজন্মগত পার্থক্য তো অবশ্যই থাকবে কিন্তু সেটাকে পুঁজি করে বিবাদের সৃষ্টি করে বিচ্ছিন্ন হওয়া গুরুতর অন্যায়।পাশ্চাত্যের অনেক ভালো দিক যেমন রয়েছে, তেমন আত্মিক বন্ধনের দুর্বল এ দিকটি মোটেও সুখকর নয়। সেখানে বিশেষ দিবসগুলোতেই সন্তানের সঙ্গে পিতামাতার যোগাযোগ হয়। অনেকটাই কৃত্রিম আবরণে মোড়ানো সে সম্পর্কগুলোতে উপহারের নামে উপহাস আসে, ভালোবাসার নামে দীর্ঘশ্বাস আসে। তবে সেখানে রাষ্ট্রীয় কাঠামো বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের পাশে নিরঙ্কুশ মানবিক অবস্থান নিয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।পিতামাতার প্রাপ্য সম্মান, শ্রদ্ধার জায়গাটা নিরঙ্কুশ রাখতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে, সেই জায়গাটাতে যেন কোনোভাবেও আঘাত না লাগে। তাদের শরীরের পাশাপাশি মনেরও যত্ন নিতে হবে। বুঝতে হবে বিষয়টি পরম্পরা। বয়স হলে নিজেদেরও কিন্তু সেই সন্তানের কাছেই আশ্রয় হাতড়ে বেড়াতে হবে।আঙুল তুলতে হবে নিজের দিকেই। সমস্যার শেকড়টা খুঁজে বের করতে হবে।আমরা আসলে আমাদের সন্তানদের কী শেখাচ্ছি? আমরা তাদের পুথিগত বিদ্যায় যতটা পারদর্শী করে তুলতে আগ্রহী, নৈতিকতায় ঠিক ততটা নই।

ভালো রেজাল্ট চাই, গোল্ডেন ফাইভ চাই, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিসিএস অফিসার চাই, চাই মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির বড় কর্তা, চাই অর্থ বিত্ত যশ প্রতিপত্তি। চাইতে সমস্যা নেই, সময়ের দাবি। কিন্তু সবকিছুর আগে চাইতে হবে ভালো মানুষ গড়ার প্রত্যয়। শুধু কাগজ-কলমে নীতিবাক্য শেখানো নয়, শুধু বইয়ের পাতার তত্ত্বকথা মুখস্থ নয়, জীবনের বাস্তবতায় নৈতিকতার ব্যবহারিক প্রয়োগ শেখাতে হবে। সেটার প্রথম এবং গুরুত্বপূর্ণ পীঠস্থান নিজের পরিবার, বাবা-মা, পারিবারিক আবহ। তারপর আছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ভালো বই এবং পারিপার্শ্বিকতার ভূমিকা।‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে।’আপনার সন্তান; সে ছেলে হোক, মেয়ে হোক- শৈশব থেকেই সেই মূল্যবোধে গড়ে তুলুন, যাতে সব হিসাব-নিকাশের বাইরের বিশুদ্ধ, স্বার্থহীন অমলিন এই সম্পর্কের মর্যাদা সে বোঝে, সম্মান করতে শেখে। পিতা-মাতার দায়িত্ব পালনের জন্য সন্তানকে যদি আইন-আদালত দেখাতে হয়, তা হবে জীবনের বিপুল পরাজয়, মনুষ্যত্বের অবমাননা।

লেখক: শিক্ষক-প্রাবন্ধিক

এ বিভাগের আরো খবর