সবে ‘আগুনপাখি’ বেরিয়েছে। কাইয়ূম চৌধুরীর প্রচ্ছদে ছাপা বইয়ের ভেতরে টুকটাক ভুল রয়ে গেছে। এক দুপুরে দোতলার ঘরে বসে ছাপা হওয়া বইয়ের কপিতেই কাটাকুটি করছেন হাসান আজিজুল হক। খবরের কাগজে চাকরির সুবাদে তার একটা লেখা নেয়ার অনুরোধ করতে গিয়ে শুরুতেই তার মৃদু ধমক, ‘লেখা চাই বললেই হলো? এসেছো, বসো।’ এই দৃশ্য পরিচিত। বহুদিন এমন হয়েছে। টেবিলে বসে তিনি কাজ করেছন, আমি তার বইয়ের ভাঁড়ারে হানা দিয়েছি। এদিনও তাই হলো।
কাজ সেরে তিনি মুখ তুললেন, ‘লেখা তো এখনও শেষ হয়নি। কী করে দিই বলো তো?’ হেড অফিসের তাড়ায় নাছোড়বান্দা আমি। ততধিক অনড় তিনি। অগত্যা ব্যর্থ হয়ে ফোন দিতে হলো মাসুদ হাসানকে। কথা বলিয়ে দিলাম দুজনের। মাঝখানে দাঁড়িয়ে পাল্টা এক পরিকল্পনা হয়ে গেল। হাসান আজিজুল হকের একটা সাক্ষাৎকার নেয়া হবে। আটঘাট বেঁধে দিনক্ষণ মেপে এক সন্ধ্যায় ফের গন্তব্য ‘উজান’।
সেই দোতলার ঘরে বসে শুরু হলো সাক্ষাৎকার। বরাবরের মতো কখন যে সেটা আড্ডায় পরিণত হলো, খেয়ালই রইল না। কাজেই সৌভিক রেজা হাজির হয়ে তিনিও ঢুকে পড়লেন এর মধ্যে। দীর্ঘ আলাপ শেষ হলো। রাত ঘনিয়েছে বাইরে। হাসতে হাসতে হাসান আজিজুল হক বললেন, ‘কত বড় হলো বলো তো? তোমাদের ক’ কলাম যেন? আঁটবে তো ওতে?’ জবাবে বলেছিলাম, ‘আমাদের আট কলামের সাধ্য কী আর আপনাকে আঁটায়? ওই ঠেসেঠুসে ঢুকিয়ে দিতে হবে আর কী!’ হাসান স্যারও পাল্টা বললেন, ‘ঢাকার বাইরে থেকে ঠেসেঠুসে যে দিতে পারছ, এইবা মন্দ কী!’ এরপর দিলেন তার সেই বিখ্যাত হাসি।
যেদিন হাসান আজিজুল হক চিরবিদায় নিলেন, ঠিক তার পরদিন ঢাকার খবরের কাগজগুলোতে গড়পড়তা সেই খবরের ট্রিটমেন্ট দেখে স্মৃতির ভাঁড়ার ঠেলে বেরিয়ে এল সেই শ্লেষমাখানো হাসি। যে হাসি অনেকবার আমি শিখতে চেয়েছি। বহুবার ‘আর হচ্ছে না, ঢাকা যাই’- বলতে গিয়ে উল্টো রাজশাহীতে মাটি কামড়ে থেকে কাজ করার নতুন মনোবল নিয়ে এসেছি তারই কাছ থেকে।
তার মৃত্যুর যে শোক, তা আরও ঘনিয়ে এল, ঢাকার কিছু খবরের কাগজের এক কলাম দু কলামের ট্রিটমেন্টে। কিন্তু তখনই সেই স্মৃতি মনে পড়ল, ভেসে উঠল সেই হাসি। উড়ে এল প্রশ্ন, ‘তোমাদের ক’ কলাম যেন? আঁটবে তো ওতে?’ শামসুর রাহমান কিংবা সৈয়দ শামসুল হকের মৃত্যু সংবাদও আমরা দেখেছি। হুমায়ূন আহমেদেরটা তো দেখেছিই।
সেসবের সঙ্গে তুলনা করতে যাবার কোনো ইচ্ছে নেই মোটেও। কিন্তু প্রশ্নটা ঘুরপাক খাচ্ছে, রাজশাহীর মতো একটা এলাকায় সামষ্টিক মানবিকচর্চার কোথায় হাসান আজিজুল হকের অবস্থান, তা কি ঢাকার খবরের কাগজগুলো জানে না? শুধুই কি এক কথাসাহিত্যিক হিসেবে তাকে ওরা দেখে এসেছে? কে জানে, হয়ত তাই।
বড় শহরের রোশনাই হয়ত কখনও কারো চোখ ধাঁধায়। তখন আলোর ছটা হামলে পড়ে, অস্বচ্ছ দেখায় অনেক কিছু। কিন্তু আমরা তো জানি, কাজ করতে চাইলে মানুষের প্রতি দরদটা রাখতে হয়, খণ্ড খণ্ড চোখে নয়, সম্পূর্ণ জগৎটাকে দেখতে হয়। এই দীক্ষা মিলেছে সেই হাসান আজিজুল হকের কাছ থেকেই, যাকে আমাদের চেনা ছকের চেনা কলামে আঁটানো যায় না।
লেখক: সাংবাদিক