বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ

  •    
  • ১৩ নভেম্বর, ২০২১ ১৫:৪৭

আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ এবং সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরাই তাদের প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য ‘রাজাকার’ শব্দটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেন। অথচ সেই দলকেই এখন এই ‘রাজাকার’ শব্দের কারণে বিব্রত হতে হচ্ছে। দলের নেতারাই পরস্পরকে রাজাকার, রাজাকারের ছেলে বা নাতি বলে অভিযোগ করছেন, গালি দিচ্ছেন। প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করার প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছেন এই ঘৃণ্যতম শব্দটি।

মাঠের রাজনীতিতে এখন আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কোনো দল আছে কি না— সেটি এক বিরাট প্রশ্ন। আইনত সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। বস্তুত, তারা সরকারেরই অংশ। গত সংসদেও তারা বিরোধী দল ছিল। কার্যত, সেটি ছিল ‘সরকারি বিরোধী দল’।

২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মাঠ ও ভোটের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি অংশ নিলেও অবিশ্বাস্য ফলাফলের মধ্য দিয়ে তারা জাতীয় পার্টির চেয়েও নিচে নেমে গেছে। ফলে তাদের পক্ষে প্রধান বিরোধী দল হওয়ার সৌভাগ্য অর্জনের সৌভাগ্যও হয়নি। আর জাতীয় পার্টি যেহেতু কার্যত সরকারেরই অংশ কিংবা সরকারি বিরোধী দল— ফলে মাঠের রাজনীতিতে এখন ওই অর্থে আওয়ামী লীগের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়া তো ভোট হয় না।

যদি হয় সেটিকে বলা হয় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী। কিন্তু সংসদের সবগুলো আসনে কিংবা স্থানীয় সরকারের প্রতিটি নির্বাচনের প্রতিটি এলাকায় আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়ে যাবেন— তাও দৃষ্টিনন্দন নয়। অতএব, কিছু বিরোধিতা, কিছু প্রতিদ্বন্দ্বিতা তো প্রয়োজন। সেই বিরোধিতার মাঠ কারা পূরণ করবেন?

স্মরণ করা যেতে পারে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ভোট ছাড়াই অর্থাৎ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে গিয়েছিলেন ১৫৩ জন। ফলে ভোট হয় যে ১৪৭ আসনে, তার মধ্যে অন্তত ৫৫টি আসনে আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল আওয়ামী লীগ। সাবেক কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এবং সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্লাহর শক্ত প্রতিপক্ষ ছিলেন দলের দুই বিদ্রোহী প্রার্থী। সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকুর বিরুদ্ধে লড়েছেন সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী আবু সাইয়িদ। সাবেক স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী মজিবুর রহমান ফকিরের প্রতিপক্ষ হয়েছিলেন নিজদলের নাজনীন আলম।

ঢাকা মহানগরীর তিনটি আসনেও আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ ছিল আওয়ামী লীগ। এর মধ্যে ঢাকা-৭ আসনে মোস্তাফা জালাল মহিউদ্দিন মনোনয়ন পেলেও তার বিরুদ্ধে লড়েন আওয়ামী লীগ নেতা হাজী সেলিম। ঢাকা-১৫ আসনে কামাল আহমেদ মজুমদারের প্রতিপক্ষ ছিলেন এমপি ইলিয়াস মোল্লাহর ভাই এখলাস মোল্লা। ঢাকা-১৬ আসনে ইলিয়াস মোল্লাহর বিরুদ্ধে নির্বাচন করেন ছাত্রলীগের সাবেক নেতা এস এ মান্নান।

২০১৬ সালে দলের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা ও বিদ্রোহী প্রার্থী ঠেকাতে দলীয় গঠনতন্ত্র সংশোধন করে দলের প্রতীকের বিরুদ্ধে নির্বাচন করা দলীয় নেতাদের সরাসরি বহিষ্কারের ধারা অন্তর্ভুক্ত করে আওয়ামী লীগ। কিন্তু তাতেও বিদ্রোহী প্রার্থী ঠেকানো যাচ্ছে না। চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও বিভিন্ন এলাকায় আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ।

দ্বিতীয় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ৮৪৮ ইউপিতে প্রায় ৯০০ আওয়ামী লীগ নেতা বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দেন। এর একটি বড় কারণ হয়তো এই যে, বিএনপি ওই অর্থে মাঠে নেই। তাছাড়া সাম্প্রতিক বছরগুলোয় পুরো নির্বাচনি ব্যবস্থাটা যেভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, তাতে বিএনপি প্রার্থী দিয়েও যে খুব একটা সুবিধা করতে পারবে না— সেটি তারা জানে। হয়তো সে কারণেই মাঠের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগকে এখন বিএনপির মতো বড় প্রতিপক্ষ সামলাতে না হলেও ঘর সামলাতে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে।

বস্তুত, টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার ফলে মহানগর, জেলা থেকে শুরু করে উপজেলা, পৌরসভা, ইউনিয়ন, ওয়ার্ড পর্যন্ত সব জায়গায় ক্ষমতার একটি বলয় গড়ে উঠেছে। নিজেদের মধ্যেই বিভিন্ন দল-উপদল ও গ্রুপ তৈরি হচ্ছে। মাস কয়েক আগে বরিশাল শহরে পোস্টার অপসারণ কেন্দ্র করে সিটি মেয়র এবং সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মধ্যে যে তুলকালাম কাণ্ড ঘটে গেল, তারও নেপথ্যে স্থানীয় রাজনীতির এই বিরোধ প্রধানত দায়ী বলে শোনা যায়।

সম্প্রতি এই ইস্যুতে সবচেয়ে আলোচিত মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেছেন, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাই এখন একে অপরের দিকে ‘রাজাকার’–এর তকমা লাগানোর চেষ্টা করছেন।

২৭ অক্টোবর রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে এক অনুষ্ঠানে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন দেয়ার বিষয়টিকে ‘দুর্বিষহ’ আখ্যায়িত করে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘যার সঙ্গে তার বনবে না, তাকে বলবে রাজাকারের ছেলে, অথবা বলবে রাজাকারের নাতি বা শান্তি কমিটির সদস্য ছিল তারা। এসব অভিযোগ করে একজন আরেকজনের প্রতিপক্ষকে। এসব অভিযোগের স্তূপ হয়ে গেছে পার্টি অফিসে।’

ওবায়দুল কাদেরের এই বক্তব্যটি টিট ফর ট্যাট কি না— সে প্রশ্ন তোলাও অযৌক্তিক নয়। কারণ, আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ এবং সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরাই তাদের প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য ‘রাজাকার’ শব্দটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেন। অথচ সেই দলকেই এখন এই ‘রাজাকার’ শব্দের কারণে বিব্রত হতে হচ্ছে। দলের নেতারাই পরস্পরকে রাজাকার, রাজাকারের ছেলে বা নাতি বলে অভিযোগ করছেন, গালি দিচ্ছেন। প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করার প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছেন এই ঘৃণ্যতম শব্দটি।

আশঙ্কার বিষয় হলো, এখন রাজাকার শব্দটি নিয়ে এখন খোদ আওয়ামী লীগ যেভাবে বিব্রত হচ্ছে; তৃণমূলের নেতারাই মনোনয়ন পাওয়া এবং প্রতিপক্ষের মনোয়ন ঠেকাতে যেভাবে পরস্পরের বিরুদ্ধে রাজাকারের তকমা লাগানোর রাজনীতি শুরু করেছেন, সেটি অব্যাহত থাকলে এবং দলের শীর্ষপর্যায় থেকে এটি থামানো না গেলে ভবিষ্যতে আবার রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করা হলে সেটি নিয়েও বিতর্ক হবে। জনগণের বিরাট অংশের কাছে হয়তো সেই তালিকা গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। হয়তো ২০১৯ সালের মতো আরেকটা সমস্যার জন্ম দেবে।

এই মুহূর্তে সবচেয়ে আলোচিত ইস্যু হচ্ছে জ্বালানি তেলের দাম ও পরিবহন ভাড়া এবং নিত্যপণ্যের বাজার ঊর্ধ্বগতি। খোদ আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা ও ১৪ দলের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমু বলেছেন যে, ডিজেলের দাম একসঙ্গে ১৫ টাকা বাড়ানো ঠিক হয়নি। দলের একাধিক সিনিয়র নেতা বলেছেন, নিত্যপণ্যের বাজার অস্থিতিশীল করার চক্রান্ত চলছে।

সুতরাং এখন এই প্রশ্ন স্বভাবতই উঠবে যে, তেলের দাম তাহলে কে বাড়াল এবং তারা কি সরকারি নির্দেশনার বাইরে গিয়ে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে? নিত্যপণ্যের বাজার কি সরকারবিরোধী লোকজন নিয়ন্ত্রণ করে? একটি দল টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার পরেও নিত্যপণ্যের বাজার কী করে অন্য কোনো দল নিয়ন্ত্রণ করতে পারে?

আদর্শিকভাবে সরকার ও সরকারি দল এক নয়। কিন্তু এটিও বাস্তবতা যে, সরকারি দলকে এখন আর সরকার থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখারও সুযোগ নেই। ফলে তেলের দাম ও পরিবহন ভাড়া বাড়ানোর ইস্যুতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং ১৪ দলের নেতাদের যে স্পষ্ট অবস্থান, সেটি এক অর্থে খুব ইতিবাচক যে তারা জনগণের পালস বুঝতে পারছেন। পক্ষান্তরে প্রশ্ন হলো, প্রশাসনসহ সরকারের নানা মেশিনারিজের মধ্যে সমন্বয়ের ঘাটতি রয়েছে এবং সবক্ষেত্রে যে সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই— এই ঘটনায় হয়তো সেটিও আবার প্রমাণিত হলো।

কিছুদিন আগেও সরকারের অতিমাত্রায় আমলানির্ভরতার সমালোচনা হয়েছিল জাতীয় সংসদেই। সরকারের অতিমাত্রায় আমলানির্ভরতার সমালোচনায় সংসদে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়েছেন আওয়ামী লীগের আরেক সিনিয়র নেতা তোফায়েল আহমেদ। সুতরাং, মাঠের রাজনীতিতে শুধু বিএনপি বা অন্যান্য রাজনৈতিক দল তো বটেই, মাঝেমধ্যে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, সরকার বোধ হয় প্রশাসনের লোকজনকে ভয় পায় কিংবা তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।

অথবা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলে তারাও বিপক্ষে চলে যেতে পারে— এই শঙ্কায় একধরনের বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে অর্থাৎ সমঝে চলার একটা ব্যাপার হয়তো কাজ করছে। সব মিলিয়ে মাঠের রাজনীতিতে বিএনপি থাক বা থাক; হেফাজতে ইসলাম বা এরকম ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোকে যত কৌশলেই নির্বিষ বা নিউট্রাল করে রাখা হোক না কেন— ঘরের ভেতরেই যে আওয়ামী লীগকে নানারকম চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে, সেটিই বাস্তবতা। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে, এসব চ্যালেঞ্জ তার জন্য আরও বড় হয়ে দেখা দিতে পারে।

একটি দেশের গণতন্ত্র কতটা শক্তিশালী হবে তা নির্ভর করে সে দেশের বিরোধী দল কতটা শক্তিশালী তার ওপর। কেননা, শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকলে সরকার স্বৈরাচারী আচরণ করতে পারে, জনবিরোধী আইন করতে পারে, নাগরিকদের অসুবিধা বিবেচনায় না নিয়ে অতিরিক্ত কর আরোপের মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এ কারণে বিরোধী দলকে বলা হয় ‘ছায়া সরকার’ আর বিরোধীদলীয় নেতাকে বলা হয় ‘ছায়া প্রধানমন্ত্রী’। বিরোধীদলীয় নেতাকে পূর্ণ মন্ত্রীর মর্যাদা দেয়া হয়।

বাংলাদেশের সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে ১৯৯১-১৯৯৪ সালকে সংসদীয় গণতন্ত্রের ‘স্বর্ণযুগ’বলে মনে করা হয়। কেননা ওই সময়ে সরকার ও বিরোধী দলের সমানসংখ্যক সদস্য নিয়ে গঠিত সংসদীয় তদন্ত কমিটি ‘সিটিং মন্ত্রীর’ বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ তদন্ত করেছে। সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাবও ভোটাভুটিতে সমাধান হয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেশে ওই অর্থে কোনো কার্যকর বিরোধী দল নেই।

আবার বিরোধিতার মানেই যে রাজপথে জ্বালাও-পোড়াও, তাও নয়। বরং সরকারকে ‘রাইট ট্র্যাকে’ রাখা তথা চাপে রেখে গণবিরোধী নীতি ও আইন প্রণয়নে বাধা দিয়ে জনবান্ধব নীতি ও আইন প্রণয়নে বাধ্য করাই বিরোধী দলের কাজ। ফলে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে কারা সরকার গঠন করবে— তার চেয়ে বড় প্রশ্ন হওয়া উচিত, কারা বিরোধী দলে থাকবে; তারা কতটি আসন পাবে; তারা দশম ও একাদশ সংসদের মতো সরকারি বিরোধী দল হবে নাকি সত্যিকোরের বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করবে?

লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

এ বিভাগের আরো খবর