বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

দ্রব্যমূল্য ও বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধিই অস্তিত্ব সংকটের কারণ

  • হীরেন পণ্ডিত   
  • ৮ নভেম্বর, ২০২১ ১৫:০২

ভাড়া বাড়াতে হলে ভাড়াটিয়ার সঙ্গে আলোচনা করে তা করতে হবে। বাড়িভাড়া একটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তি। এই নিয়ম মানা না হলে ভাড়াটিয়ার জন্য অন্যত্র চলে যাওয়ারও সুযোগ থাকবে। আর মালিকের উচিত চুক্তির সময়ই ভাড়াটিয়ার সঙ্গে ভাড়া বৃদ্ধির বিষয়ে কথা বলে নেয়া যে, কখন থেকে ভাড়া বৃদ্ধি করা হবে এবং কী পরিমাণ বৃদ্ধি করা হতে পারে।

কোভিড-১৯ মহামরি সারা পৃথিবীকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। মানুষের জীবন-জীবিকার সংকট এখন প্রকট। বেঁচে থাকা ও অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রামই মুখ্য। করোনাকালে উদ্ভূত জটিল এ পরিস্থিতিতে মহাসংকটে পড়েছে মধ্যবিত্ত শ্রেণি। হতদরিদ্র মানুষজন সরকার ও বিত্তবানদের কাছ থেকে সহায়তা পায়। কিন্তু খাদে পড়া অসহায় মধ্যবিত্ত-সমাজকে সহায়তা কে দেবে? মুখ বুজে সব সহ্য করা ছাড়া তাদের কোনো উপায় নেই। ফলে মধ্যবিত্তের সংকট সমাধানের আশু কোনো সম্ভাবনাও দেখা যায় না।

কোভিডের কারণে চাকরিচ্যুত হয় শতকরা ৩৬ জন। তিন শতাংশ মানুষের চাকরি থাকা সত্ত্বেও তারা বেতন-ভাতা পায় না ঠিকমত। এদের বেশির ভাগই মধ্যবিত্ত। তাহলে সংকট উত্তরণ হবে কীভাবে? কোভিড-১৯ সংক্রমণজনিত এ সংকটকালে বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষের সার্বিক সুরক্ষা ও জীবন-জীবিকা নির্বাহের জন্য উন্নয়ন কার্যক্রম এবং জনবান্ধব পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।

মহামারির কারণে বর্তমান বাংলাদেশের সমাজচিত্র অনেকটাই বদলে গেছে। অসংখ্য মানুষ কর্মহীন অবস্থায় জীবন কাটাচ্ছে। অনিশ্চয়তার প্রহর ক্রমেই দীর্ঘায়িত হচ্ছে। দিশেহারা হয়ে অনেক মানুষ গ্রামে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। সেখানেও কি শান্তি আর বসবাসের নিশ্চয়তা আছে? কর্মসংস্থানের সুযোগ-সুবিধা আছে? এসব প্রশ্নের কোনো সদুত্তর পাওয়া যায় না।

চাকরি হারা কেউ কেউ ক্ষুদ্র ব্যবসার দিকে ঝুঁকছে। সেখানেও কি সুবিধা পাচ্ছে? বিভিন্ন গবেষণায় প্রকাশিত খবরে দেখা যায়, এই সংকট শুধু বাংলাদেশেরই নয় গোটা বিশ্বের। আন্তর্জাতিক শ্রমসংস্থা আইএলওর সর্বশেষ রিপোর্টে যে তথ্য পাওয়া যায়, তাতে তো সংকট আরও বাড়বে। আইএলও বলেছে- কোভিডের কারণে বিশ্বব্যাপী ৩৪ কোটি মানুষ কাজ হারাতে পারেন। বিপর্যস্ত দেশগুলোর তালিকায় আছে বাংলাদেশও।

বাসস্থান মানুষের মৌলিক প্রয়োজনের অন্তর্ভুক্ত। জীবিকা ও উপার্জনের তাগিদে বহু মানুষ শহরমুখী। তাই প্রয়োজন হয়েছে বিপুলসংখ্যক বাসস্থানের। জীবনের এই অপরিহার্য প্রয়োজন পূরণের তাগিদে শহরগুলোতে গড়ে উঠছে বহুতল ভবন ও বড় বড় অ্যাপার্টমেন্ট। বসবাস বা ব্যবসার প্রয়োজনে বাড়ি বা দোকান ভাড়া নেয়া নতুন কোনো বিষয় নয়। এটি যুগ যুগ ধরে চলমান ব্যবস্থা। ভাড়া বাসায়ই সারা জীবন পার করে দিচ্ছে এমন মানুষের সংখ্যাও অনেক।

দুঃখজনক ব্যাপার হলো, অনেক ক্ষেত্রে সঠিক নিয়মের অভাবে বাড়িওয়ালা কর্তৃক ভাড়াটিয়া নিগৃহীত হয়। আবার কোনো ক্ষেত্রে ভাড়াটিয়ার দ্বারা বাড়িওয়ালা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শুধু নিজের স্বার্থই সামনে রাখে, অন্যের ক্ষতি হলো কি না বা তার প্রতি জোর-জবরদস্তি হলো কি না তা ভেবেও দেখে না।

প্রথমে প্রয়োজন ভাড়ার পরিমাণ নির্দিষ্ট করা। যে বাড়ি বা ফ্ল্যাট ভাড়া হবে এর সব সুবিধা-অসুবিধা ও সংশ্লিষ্ট বিষয় ভাড়াটিয়াকে সুস্পষ্টভাবে অবহিত করা। ভাড়া কত তা নির্ধারণ করা। গ্যাস, পানি ও বিদ্যুৎ বিল কি ভাড়ার অন্তর্ভুক্ত, না এর বাইরে তা জানানো। এছাড়া নাইট গার্ড ও বাড়ির দারোয়ানের বেতন, ময়লা ফেলার বিল কিংবা অ্যাপার্টমেন্টগুলোর সার্ভিস ফি ইত্যাদি মিলে প্রতি মাসে সাধারণত কত টাকা হয়, তা চুক্তির সময়ই বলে দেয়া। বাড়ির সুবিধা-অসুবিধা সম্পর্কে ভাড়াটিয়াকে আগে থেকে অবহিত করা। পানি নিয়মিত বা সার্বক্ষণিক না থাকা বা নিয়ম করে পানি দেয়া। গ্যাসের সমস্যা থাকা বা দারোয়ান না থাকার কারণে গেট নিয়ন্ত্রণের সমস্যার মতো ব্যাপারগুলো আগে থেকেই ঠিক করে রাখা দরকার যাতে পরবর্তীতে দ্বন্দ্ব না হয়।

প্রতিটি ফ্ল্যাটে পানির মিটারও ভিন্ন হওয়া উচিত, যেন যার যার খরচ অনুযায়ী বিল নেয়া যায়। ওয়াসা প্রতি ইউনিটের জন্য আলাদা মিটার দেয় না। তাই এক্ষেত্রে প্রতি মাসের পানির বিল সব ফ্ল্যাটের ভাড়াটিয়াদের মাঝে বণ্টন করে দেয়া উচিত।

বাড়িওয়ালারা বিভিন্ন বিষয়কে কেন্দ্র করে ভাড়া বাড়ায়। যেমন অনেক মালিক বাজারে পণ্যের দাম বা সরকারি বেতন বাড়লে, নতুন বছর শুরু হলে এমনকি কোনো কারণ ছাড়াই হুট করে ভাড়া বাড়িয়ে দেয়। এসব ক্ষেত্রে বাড়িওয়ালা নিজ ইচ্ছা অনুযায়ীই সব ঠিক করে। অথচ অযথা কিংবা যৌক্তিক কারণ ছাড়া ভাড়া বাড়ানো একটি অন্যায় কাজ।

এছাড়া একসঙ্গে অস্বাভাবিক পরিমাণ ভাড়া বাড়িয়ে দেয়াও অন্যায়। ভাড়া বাড়াতে হলে ভাড়াটিয়ার সঙ্গে আলোচনা করে তা করতে হবে। বাড়িভাড়া একটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তি। এই নিয়ম মানা না হলে ভাড়াটিয়ার জন্য অন্যত্র চলে যাওয়ারও সুযোগ থাকবে। আর মালিকের উচিত চুক্তির সময়ই ভাড়াটিয়ার সঙ্গে ভাড়া বৃদ্ধির বিষয়ে কথা বলে নেয়া যে, কখন থেকে ভাড়া বৃদ্ধি করা হবে এবং কী পরিমাণ বৃদ্ধি করা হতে পারে। যেন পরবর্তী সময়ে মনোমালিন্যের পরিস্থিতি সৃষ্টি না হয়।

কোভিডকালে কেউ ভালো নেই। তবে ভালো না থাকার দলে আগে থেকেই ছিল ভাড়াটিয়ারা। ফি বছর ভাড়া বৃদ্ধির জন্য তারা থাকে চাপের মুখে। ভাড়া বৃদ্ধির প্রস্তাবে রাজি না হলে দেয়া হয় বাড়ি ছাড়ার নোটিশ। মহামারির আগ্রাসনে সিংহভাগ মানুষের আয় কমে গেছে। বিশেষ কিছু নাগরিক ছাড়া সবাই দুরবস্থার শিকার।

বেকারত্ব বৃদ্ধি এবং আয় কমে যাওয়ায় শুধু নিম্নবিত্তই নয়, ঢাকায় বাড়ি ভাড়ার টাকা জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোও। ফলে তাদেরকে কম দামের বাসা খোঁজ করতে হচ্ছে বাধ্য হয়ে।

১৯৯১-এর বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন বলছে- “নিয়ন্ত্রক বাড়ি ভাড়া আইন কার্যকর করবেন” তাই দেশের লাখ লাখ ভাড়াটের বিপদের বন্ধু হলো নিয়ন্ত্রক। এই নিয়ন্ত্রক হলেন সহকারী জজ। ভাড়াবাড়ি শাসন ঠিক বিচারবিভাগীয় কার্যক্রমের অংশ নয়। তবে নিশ্চয়ই আধা বিচারবিভাগীয়। আইন বলছে, সরকার প্রজ্ঞাপন দ্বারা নিয়ন্ত্রক নিয়োগ করবে। দরকার পড়লে নির্দিষ্ট এলাকায় অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রক বা উপ-নিয়ন্ত্রক নিয়োগ করবে। সারা দেশে অবশ্য কেবল সহকারী জজরাই নিয়ন্ত্রকের দায়িত্ব পালন করছেন।

প্রসঙ্গক্রমে বলা দরকার, ১৯৯১-এর বাড়িভাড়া আইনটিতে গলদ অনেক। তবু সেটা ভাড়াটে-বান্ধব আইন হিসেবেই পরিচিত। এর কতগুলো বিধান আছে, যা শোধরানোর দাবি রাখে। ৯১-এর আইনে আরও বলা আছে- “কোনো বাড়ির ভাড়া মানসম্মত ভাড়ার অধিক বৃদ্ধি করা হলে ওই অধিক ভাড়া, কোনো চুক্তিতে ভিন্নরূপ কিছু থাকা সত্ত্বেও আদায়যোগ্য হবে না। মানসম্মত ভাড়া, বাড়ি-মালিক বা ভাড়াটের আবেদনের ভিত্তিতে প্রতি দুই বছর পর (নিয়ন্ত্রক কর্তৃক) পুনর্র্নিধারণ করা যাবে।”

এই আইনে আরও বলা হয়েছে- “কোনো ভাড়াটের কাছে বাড়িওয়ালা জামানত বা কোনো টাকা দাবি করতে পারবেন না। এক মাসের বেশি অগ্রিম ভাড়া নেয়া যাবে না। প্রতিমাসে ভাড়া নেয়ার রসিদ প্রদান করতে হবে, নইলে বাড়িওয়ালা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।” ভাড়াটেদের স্বার্থরক্ষায় এমন আরও অনেক কথাই উল্লেখ আছে এ আইনে। কিন্তু প্রয়োগ নেই।

এলাকাভেদে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন বাড়িভাড়া নির্ধারণের জন্য সরকারকে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিশন গঠনের আদেশ দেন হাইকোর্ট। কিন্তু আজ অবধি এই নিয়ন্ত্রণ কমিশন গঠিত হয়নি এবং আলোর মুখ দেখেনি। রায়ে বাড়িভাড়া নির্ধারণে কমিশন গঠন, ওয়ার্ডভিত্তিক বাড়িভাড়া ২৫ হাজার টাকার বেশি হলে তা ব্যাংকের মাধ্যমে পরিশোধ করা। যদিও ট্যাক্স না দেয়ার জন্য কৌশলে অনেক বাড়িওয়ালা এটি এড়িয়ে যাচ্ছে। বাড়িভাড়া কি বাড়বেই প্রতিনিয়ত? এর প্রতিকার কী?

সরকারের নাগরিক সুবিধা গ্রামে পৌঁছানোর কর্মসূচিকে আরো ত্বরান্বিত ও বেগবান করা উচিত। কারণ ঢাকার ওপর জনসংখ্যার চাপ কমানোর বিষয়টি নিয়েও ভাবতে হবে। নিম্ন ও মধ্য আয়সহ সব ধরনের লোকজনের ঢাকামুখী অভিযাত্রা কমাতে হবে।

নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাওয়া কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। অভাব আর দারিদ্র্যের কষাঘাতে দুঃখ ও হাহাকারে পূর্ণ মধ্য ও নিম্নমধ্যবিত্ত। মানুষের ওপর চেপে বসেছে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ঘোড়া। জীবন ধারণের উপযোগী প্রতিটি জিনিসের অগ্নিমূল্য। চাল-ডাল, মাছ-মাংস, তেল, তরিতরকারি, ফলমূল, চিনি-লবণ, আটা ইত্যাদি দ্রব্যের মূল্য আগের তুলনায় কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। অতিরিক্ত মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের জন্যই সাধারণ মানুষকে অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।

স্বাধীন দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের লাগামছাড়া অবস্থা দরিদের পক্ষে বজ্রাঘাততুল্য। বিভিন্ন শ্রেণীর ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি করছে। সরকারকে কঠোর হাতে অতিলোভী অসাধু এসব ব্যবসায়ীকে দমন করতে হবে। বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্যতালিকা টানানো এবং নির্ধারিত মূল্যে পণ্য বিক্রয় করা হচ্ছে কি না, সেটি পর্যবেক্ষণের জন্য সব বাজারে দ্রব্যমূল্য মনিটরিং কমিটি গঠনের ব্যবস্থা করা দরকার। সরকার ও ব্যবসায়ীদের সদিচ্ছাই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করে দেশের সাধারণ মানুষের আরও একটু সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা প্রদানে ভূমিকা রাখতে সক্ষম। সরকারের সদিচ্ছাই অনাকাঙ্ক্ষিত বাড়িভাড়া বৃদ্ধি ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করে মধ্যবিত্তের জীবনকে দুর্বিষহ অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে পারে।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও রিসার্চ ফেলো, বিএনএনআরসি

এ বিভাগের আরো খবর