ডিজেল, কেরোসিন-ফার্নেস অয়েলের দাম বাড়ানোর সঙ্গে আরও একটি ঘোষণা হয়েছে এলপিজির দাম বাড়ানোর। বাস-ট্রাকের ভাড়া বাড়ানোর জন্য মালিকরা চাপ দিচ্ছেন। সরকার পরিকল্পনা করছে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর। ফলে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর একটি ঘোষণা অনেক ঘোষণার পথ তৈরি করে দিল। সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জ্বালানি মন্ত্রণালয় বাড়িয়ে দিল ডিজেল এবং কেরোসিনের দাম। অবশ্য দাম বাড়ানো কথাটার সঙ্গে একমত হবেন না তারা। তারা বলবেন যে, মূল্য সমন্বয় করা হয়েছে। বৃদ্ধি বা সমন্বয় যা-ই হোক না কেন ঘোষণার আগে কারো সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে সময় নষ্ট করেনি বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন বিপিসি বা সরকারের কোনো মহল।
দেশে একটি সংসদ আছে যেখানে বিরোধিতা করার মতো সদস্য খুবই কম। সরকার নির্দ্বিধায় সেখানে সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সংসদ হলো আইনসভা, নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হোক বা না হোক, আইন অনুযায়ী সর্বোচ্চ পর্যায়ের নীতিনির্ধারকরা সেখানে আছেন। সেখানে জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করে দাম বাড়ালে জনগণ খুশি হবে কি না সে বিষয়টা আলোচনা করা হয়তো যেত। কিন্তু সেখানেও আলোচনা প্রয়োজনীয় মনে করা হয়নি। বিশ্ববাজারে তেলের দাম কত, পরিবহন ব্যয় কত, সরকার শুল্ক ও ট্যাক্স বাবদ কত টাকা নেয়, রিফাইন করার খরচ কত তা নিয়ে আলোচনা হলে কতটা দাম বাড়ালে যুক্তিসংগত হয় তা বোঝা যেত।
আবার জ্বালানিতে ভর্তুকি জনগণের স্বার্থে দেয়া দরকার, ফলে কোথা থেকে সে টাকা পাওয়া যাবে তা নিয়েও আলোচনা করা যেত। দুর্নীতি অপচয় বন্ধ করতে পারলে কি দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হতো সে বিতর্কটা চলতে পারত। কিন্তু ঘোষণাই চূড়ান্ত।
বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বহুদিন নিম্নমুখী থাকার পর গত কমাস থেকে ঊর্ধ্বমুখী। ২০১৬ সালের ২৪ এপ্রিল গেজেট প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণ করা হয়। সেই সময় ডিজেলের দাম ৬৫, কেরোসিনের দাম ৬৫, অকটেনের দাম ৮৯ ও পেট্রোলের দাম ৮৬ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল।
২০১৩ সালের পর থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমেই যাচ্ছিল। একসময় সর্বনিম্ন ২০-২২ ডলারেও নেমে এসেছিল প্রতি ব্যারেল তেলের দাম। কিন্তু দেশে তেলের দাম কমেনি। বিপিসির কর্মকর্তারাই বলেছেন, ২০১৪ সালের পর টানা সাত বছর ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কম থাকায় এ সময় বিপিসি ৪০ হাজার কোটি টাকা লাভ করেছে। করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসার পর গত জুন থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়তে থাকে এবং ব্যারেল প্রতি ৭০ ডলারের বেশি হয়ে যায়। ফলে বিপিসি তেলে লোকসান দিতে শুরু করেছে গত অক্টোবরের শুরুর দিকে।
জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর প্রতিক্রিয়া জানিয়ে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের জ্বালানি উপদেষ্টা ড. এম শামসুল আলম বলেছেন, ‘সবে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়তে শুরু করেছে, তেলের এই দাম ঊর্ধ্বমুখীও থাকবে না। সরকারের উচিত হয়নি এর মধ্যে দাম বাড়ানোর। কারণ দেশের পরিবহনের বড় অংশই চলে ডিজেলে। পরিবহন খরচ এখন বাড়বে, এতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম আরও বেড়ে যাবে।’
তিনি আরও বলেছেন, ‘গত সাত বছরে তেল বেচে বিপিসি ৪০ হাজার কোটি টাকা লাভ করেছে, তখন সরকার তেলের দাম কমায়নি। উল্টো বিপিসিসহ জ্বালানি খাতের কোম্পানির কাছ থেকে ১ লাখ কোটি টাকা নিয়ে গেছে। এ রকম পরিস্থিতিতে দাম বাড়ানো অত্যন্ত অন্যায় হয়েছে।’ আন্তর্জাতিক বাজারে কোনো পণ্যের দাম বাড়লে তার প্রভাব দেশে পড়ে বিদ্যুৎগতিতে। আর দাম যদি বিশ্ববাজারে কমে তাহলে তার প্রভাবে দেশে পণ্যের দাম কমবে কচ্ছপ গতিতে।
বাংলাদেশ জ্বালানি আমদানিকারক দেশ। তাই বিশ্ববাজারের সঙ্গে সম্পর্ক খুব নিবিড়। প্রতিবছর দেশে জ্বালানি তেলের প্রয়োজন প্রায় ৬৫ লাখ টন। এর মধ্যে প্রায় ৪৫ লাখ টন ডিজেল। অর্থাৎ প্রায় ৭০ শতাংশ ডিজেল, ১০.৫ শতাংশ ফার্নেস ওয়েল, জেট ফুয়েল ৬.৫ শতাংশ, অকটেন ৪.৮ শতাংশ, পেট্রোল ৪.৮৫ শতাংশ, কেরোসিন ১.৯ শতাংশ ব্যবহৃত হয়। ডিজেল ব্যবহৃত হয় পরিবহনে বিশেষ করে ট্রাক, লরি, কাভারড ভ্যানসহ ভারী যানবাহনে, বিদ্যুৎ উৎপাদনে, সেচসহ কৃষিকাজে। ফলে মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়বে খাদ্য উৎপাদন, পরিবহন, শিল্প উৎপাদন, পারিবারিক ব্যয় বৃদ্ধিসহ জীবনের সব ক্ষেত্রে। পণ্য পরিবহনের ভাড়া বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছে ট্রাক মালিকেরা।
জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর কারণে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে চলাচলকারী যাত্রীবাহী বাসের ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। গত বুধবার রাত ১২টা থেকে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পর পরই এই রুটে যাত্রীবাহী বাসগুলোর ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে জনপ্রতি ১৪ টাকা বেশি আদায় করছে উৎসব, বন্ধনসহ বাসগুলোতে। এ ছাড়া শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বাস শীতল পরিবহনের ভাড়া জনপ্রতি ১০ টাকা বাড়ানো হয়েছে।
সাধারণ বা নন এসি বাসের আগে ভাড়া ছিল ৩৬ টাকা। বর্তমানে ১৪ টাকা বাড়িয়ে ৫০ টাকা ভাড়া নেয়া হচ্ছে। উৎসব পরিবহনের কাউন্টার থেকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে তেলের দাম বাড়ানোর কারণে মালিকপক্ষের নির্দেশে তারা ৫০ টাকা ভাড়া আদায় করছেন। ফলে নতুন ভাড়া নেয়ার সময় যাত্রীদের সঙ্গে ঝগড়া হচ্ছে। কিন্তু যাত্রীরা তো অসহায়, তাদের যেতেই হবে বেশি ভাড়া দিয়ে হলেও। বন্ধন পরিবহনও ভাড়া বাড়িয়ে ৫০ টাকা আদায় করছে। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে চলাচলকারী শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বাস শীতল পরিবহনের ভাড়া ৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৬০ টাকা করা হয়েছে।
সরকার তেলের দাম বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে বাস ভাড়া। কিন্তু কত বাড়বে বা কত বৃদ্ধি হওয়া উচিত তা দেখা বা বলার কেউ নেই। সারা দেশের সব রুটেই বাস ভাড়া বাড়বে। তেলের দাম বাড়াল সরকার, মালিক বাড়াল বাস ভাড়া, বিরোধ হবে যাত্রী আর পরিবহন শ্রমিকের মধ্যে, মূল্য বৃদ্ধির বোঝা বইবে সাধারণ জনগণ। সাধারণত প্রতি লিটার ডিজেলে কমপক্ষে ৩ কিলোমিটার চলে একটি বড় বাস। ঢাকা নারায়ণগঞ্জের দূরত্ব ১৬ কিলোমিটার। তাহলে জ্যাম ও অন্যান্য বিবেচনাতেও ৭ লিটারের বেশি ডিজেল লাগার কথা নয়। তেলের জন্য খরচ বাড়বে ১০৫ টাকা আর ১৪ টাকা করে বাড়তি ভাড়া নেয়া হলে ৪০ যাত্রীর কাছ থেকে বাড়তি ভাড়া নেয়া হবে ৫৬০ টাকা। এভাবে পণ্য পরিবহনেবিদ্যুৎ, কৃষি উৎপাদনে বাড়তি খরচের বোঝা চাপবে সর্বংসহা জনগণের ওপর। কী আর করবে তারা? একটাই পথ খাওয়া কমানো।
শাসক দলের নেতারা বলবেন, জনগণ তো মেনে নিয়েছে কারণ দেখুন, কেউ তো প্রতিবাদ করছে না। আসলে দেশের মানুষের আয় অনেক বেড়ে গিয়েছে তো! তাই এই মূল্য বৃদ্ধিতে কোনো কষ্ট হবে না কারো। তেলের মূল্য বৃদ্ধির ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে এলপিজির সিলিন্ডারের দাম আবার বাড়ানো হয়েছে। প্রতি সিলিন্ডার ৫৪ টাকা বাড়িয়ে নতুন দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১৩১৩ টাকা। চার মাসে পাঁচবার গ্যাসের সিলিন্ডারের দাম বৃদ্ধি ৪১ লাখ গ্রাহকের জীবনে দুর্ভোগ বাড়িয়েই চলেছে।
শুধু দাম বৃদ্ধি নয়, আয় বৃদ্ধির নতুন সুখবরও জানানো হলো ইতোমধ্যেই। আমাদের মাথাপিছু আয় নাকি আড়াই হাজার ডলার ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাবে দেশের মাথাপিছু আয় এখন ২ হাজার ৫৫৪ ডলার। ২০২০-২০২১ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ছিল ২ হাজার ২২৭ ডলার। নতুন হিসাবে মাথাপিছু আয় বেড়েছে আরও ৩২৭ ডলার। করোনায় মানুষ কাজ হারিয়েছে, বেকারত্ব বেড়েছে কিন্তু মানুষের আয় বেড়ে যাওয়াকে কেউ ঠেকাতে পারেনি। কিন্তু মাথাপিছু আয়ের হিসাব শুনে মাথা ঘুরে যাবার উপক্রম হলেও পকেটে হাত দিয়ে মানুষ দেখছে টাকা নেই।
কেমন করে আয় বেড়ে গেল এতো? একটা কারণ সরকার মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) হিসাব করার জন্য সম্প্রতি নতুন ভিত্তিবছর চূড়ান্ত করেছে। ২০১৫-২০১৬ ভিত্তিবছর ধরে এখন থেকে জিডিপি-প্রবৃদ্ধি, বিনিয়োগ-মাথাপিছু আয় গণনা করা শুরু হয়েছে। এতদিন ২০০৫-২০০৬ ভিত্তিবছর ধরে মাথাপিছু আয় হিসাব করা হতো। ভিত্তি পাল্টানোর ফলে হিসেবে আয় তো বেড়ে গেল কিন্তু বাস্তবে কি বেড়েছে? হিসাব অনুযায়ী ৫ সদস্যের একটি পরিবারে এখন মাসিক আয় ৯০ হাজার টাকার বেশি।
দেশের ৬ কোটি ৮২ লাখ শ্রমজীবী, ৩ কোটির ওপর কর্মক্ষম বেকার, ১ কোটির ওপর বৃদ্ধ, ৪ কোটি ছাত্রছাত্রী এদের কার কার আয় বেড়েছে তা খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাহলে কিছু মানুষের আয় এত বেড়েছে যে গড় আয়ের হিসাবে বাংলাদেশ এখন ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে। দেশের উন্নয়নের কথা শুনতে কার না ভালো লাগে। কিন্তু ভালোলাগা উবে যায় নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বৃদ্ধি দেখে।
মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি-জ্বালানির দাম বৃদ্ধি, ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রাখায় লোকসান বৃদ্ধি, পরিবহনের ভাড়া বৃদ্ধি সব কিছুর দায় জনগণের কাঁধে। ফলে গৃহস্থালির খরচ বৃদ্ধি, জনজীবনের দুর্ভোগ বৃদ্ধি, বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির আশঙ্কা বৃদ্ধির মধ্যেই জনগণকে জীবনযাপন করতে হচ্ছে। লোকসানের কারণ অনুসন্ধান আর দাম না বাড়ানোর উপায় বের করার চাইতে জনগণের ওপর ব্যয়ের বোঝা চাপানোর সহজ পথটাই কি বার বার বেছে নেয়া হচ্ছে?
লেখক: রাজনীতিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক।