গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অনেক কিছুই মানুষ ভুলে যাচ্ছে। এই তালিকা অনেক দীর্ঘ হতে পারে। আবার এ কথাও ভুলে যাচ্ছে যে, পাকিস্তান আমলের দীর্ঘ ২৩ বছর বাঙালি জাতি যে ধারাবাহিক আন্দোলন করে, এর মূল দাবিগুলো কী ছিল? প্রায় সবাই বলবে সেগুলো- রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, পূর্ব বাংলার পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে, ছয় দফা মানতে হবে ইত্যাদি। কিন্তু যদি প্রশ্ন করা হয়, কৃষক কিংবা শ্রমিকেরা কোনো স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল, কোন স্বার্থে বেকার যুবক-যুবতী, মধ্যবিত্ত সমাজ, তাঁতি-কুমার, জেলে প্রভৃতি বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল- এর কোনো স্পষ্ট জবাব অনেকেই দিতে পারবেন না।
কীভাবে নানা দাবিতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করা সম্ভব হয়? কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্যের দাবিতে কৃষক-সমাজ, ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার এবং নিয়মিত ও ন্যায্য মজুরির দাবিতে শ্রমিক শ্রেণি, বেকার জীবনের অবসান হবে এই আশ্বাসে যুবসমাজ, নারী-পুরুষের মধ্যকার বৈষম্যের অবসান ঘটানো হবে এই প্রতিশ্রুতিতে নারী সমাজ, এককেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা এবং সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রয়োগের প্রত্যয়ে ছাত্রসমাজ ঐক্যবদ্ধ হয়। সাম্প্রদায়িকতা দূর করে একটি অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের প্রতিশ্রুতি পেয়ে ধর্মীয় ‘সংখ্যালঘু’ ও আদিবাসীরাও সক্রিয়ভাবে সাড়া দেয়।
এসব দাবি বা প্রতিশ্রুতি নিয়ে ২৩ বছর ধরে ব্যাপক গণ-আন্দোলন গড়ে তোলা হয়। অসংখ্য জনসভা-কর্মিসভা, সম্মেলন-সমাবেশ ও মিছিল হয়। এরই শেষপর্যায়ে একাত্তরের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু জাতীয় ঐক্যের ডাক দেন। লাখো মানুষ তাতে উদ্বুদ্ধ হয় এবং ঐক্যবদ্ধ হয়ে গণসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
১৯৭১-এ নয় মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের পর দেশ স্বাধীন হলে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় ঐক্যই ছিল তার প্রধান ভিত্তি। বিজয়ের পর পরই বঙ্গবন্ধু সংবিধান প্রণয়ণে হাত দেন। ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত হয় সংবিধান প্রণয়ন কমিটি। দ্রুততম সময়ের মধ্যে তারা সংবিধানটি প্রণয়নের কাজ শেষ করেন।
মাত্র নয় মাসের মধ্যে বাহাত্তরের সংবিধান প্রণয়নের কাজ শেষ করে তা চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য সংসদে পেশ করা হয়। কদিন ধরে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার পর ৪ নভেম্বর ১৯৭২ তারিখে সংবিধানটি সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদিত হয়।
এই সংবিধানের প্রস্তাবনায় সুস্পষ্টভাবে লিখিত হয়-
“আমরা, বাংলাদেশের জনগণ, ১৯৭১ খ্রীষ্টাব্দের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়া ২[জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের] মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করিয়াছি;
৩[আমরা অঙ্গীকার করিতেছি যে, যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল- জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে;]
আমরা আরও অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা- যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে;
মূলনীতি
৮। ১[(১) জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা- এই নীতিসমূহ এবং তৎসহ এই নীতিসমূহ হইতে উদ্ভূত এই ভাগে বর্ণিত অন্য সকল নীতি রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি বলিয়া পরিগণিত হইবে।]
জাতীয়তাবাদ
২[৯। ভাষাগত ও সংস্কৃতিগত একক সত্তাবিশিষ্ট যে বাঙালী জাতি ঐক্যবদ্ধ ও সংকল্পবদ্ধ সংগ্রাম করিয়া জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জন করিয়াছেন, সেই বাঙালী জাতির ঐক্য ও সংহতি হইবে বাঙালী জাতীয়তাবাদের ভিত্তি।]
সমাজতন্ত্র ও শোষণমুক্তি
৩[১০। মানুষের উপর মানুষের শোষণ হইতে মুক্ত ন্যায়ানুগ ও সাম্যবাদী সমাজলাভ নিশ্চিত করিবার উদ্দেশ্যে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হইবে।]
গণতন্ত্র ও মানবাধিকার
১১। প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে…
***
ধর্ম নিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা
৬[১২। ধর্ম নিরপেক্ষতা নীতি বাস্তবায়নের জন্য
(ক) সর্ব প্রকার সাম্প্রদায়িকতা,
(খ) রাষ্ট্র কর্তৃক কোন ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান,
(গ) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মীয় অপব্যবহার,
(ঘ) কোন বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাহার উপর নিপীড়ন,
বিলোপ করা হইবে।]
রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব এবং মেহনতি মানুষকে কৃষক ও শ্রমিককে এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ হইতে মুক্তি দান করা।
মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থা
১৫। রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে পরিকল্পিত অর্থনৈতিক বিকাশের মাধ্যমে উৎপাদনশক্তির ক্রমবৃদ্ধিসাধন এবং জনগণের জীবনযাত্রার বস্তুগত ও সংস্কৃতিগত মানের দৃঢ় উন্নতি সাধন, যাহাতে নাগরিকদের জন্য নিম্নলিখিত বিষয়সমূহ অর্জন নিশ্চিত করা যায়:
(ক) অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা;
(খ) কর্মের অধিকার, অর্থাৎ কর্মের গুণ ও পরিমাণ বিবেচনা করিয়া যুক্তিসঙ্গত মজুরীর বিনিময়ে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তার অধিকার;
(গ) যুক্তিসঙ্গত বিশ্রাম, বিনোদন ও অবকাশের অধিকার; এবং
(ঘ) সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার, অর্থাৎ বেকারত্ব, ব্যাধি বা পঙ্গুত্বজনিত কিংবা বৈধব্য, মাতাপিতৃহীনতা বা বার্ধক্যজনিত কিংবা অনুরূপ অন্যান্য পরিস্থিতিজনিত আয়ত্তাতীত কারণে অভাবগ্রস্ততার ক্ষেত্রে সরকারী সাহায্যলাভের অধিকার।”
বাহাত্তরের মূল সংবিধান বাঙালি জাতির হৃদয় ছুঁতে পেরেছিল। এমনকি পঙ্গুত্বে বা বৈধব্যেও যাতে কাউকে অসহায়ত্বে নিক্ষেপ না করে এর জন্যেও সরকারি ব্যবস্থার নিশ্চিয়তা দেয়া হয়। তাই মুক্তিযুদ্ধ বা এর পূর্ববর্তী পাকিস্তান আমলের আন্দোলন-সংগ্রামে যে প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে সেই আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটে এ সংবিধানে।
সংবিধান হলো- একটি রাষ্ট্রের মৌলিক আইন- এ আইনের বিপরীতমুখী পরিবর্তন অনাকাঙ্ক্ষিত এবং অনৈতিক। তাই মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তী এবং সংবিধান গ্রহণের সুবর্ণজয়ন্তীতে পর্যালোচনা-সমালোচনা এবং আত্মসমালোচনা প্রয়োজন। মুক্তিযুদ্ধের প্রদত্ত এবং বাহাত্তরের সংবিধানে গৃহীত অঙ্গীকারসমূহ এই পঞ্চাশ বছরে কতটা এগোতে পেরেছে? যে শ্রমিক-কৃষক, মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত ও বিত্তহীনদের কথা মাথায় রেখে বঙ্গবন্ধু এবং তার সহকর্মী-সহযোদ্ধারা সংবিধানটি জাতিকে উপহার দেন এর মর্যাদাইবা কতটুকু রক্ষা করা গেছে? সেটা ভাববার সময় পেরিয়ে যাচ্ছে।
সরকারের পক্ষ থেকে যে বিত্ত-গৃহহীনদের বাড়ি নির্মাণ করে দেয়া হচ্ছে কিংবা বেকারদের নানাভাবে সাহায্য করা হচ্ছে এতেই কি সংবিধানের পূর্ণ মর্যাদা রক্ষা পাচ্ছে? এগুলো তো সংবিধান অনুযায়ী মানুষের মৌলিক অধিকারের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত; মানুষের সংবিধানপ্রদত্ত অধিকার। যদি যথাযথভাবে সংবিধানের মর্যাদা রক্ষা করা হয়, তাহলে নিশ্চয়ই সরকারকে কারো জন্য বাড়ি নির্মাণ বা কাউকে স্কুটার-রিকশা দান করে বাঁচানোর ব্যবস্থা করার কি দরকার হবে?
শিক্ষাক্ষেত্রে একটি পর্যায় পর্যন্ত বিনামূল্যে বই সরবরাহ কীসের ইঙ্গিত দেয়? এতে কি বোঝা যায় না যে, মানুষের আর্থিক অবস্থার অবনয়ন ঘটেছে? জিডিপি ও মাথাপিছু আয় বাড়ার যে তথ্য পাওয়া যায়, তা কি বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ? বস্তুত, পুঁজির বিকাশ ঘটলেও তা মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে গিয়ে জমা হয়েছে।
এই বিষয়গুলো পর্যালোচনা করা দরকার। এছাড়াও সাম্প্রদায়িকতা দূরীকরণ ও ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা কতদূর এগিয়েছে? এর হিসাব-নিকাশ কতটুকু হয়েছে? এই সবকিছুর উত্তর মিলবে সংবিধানের পরিপূর্ণ প্রয়োগের মাধ্যমে। তবেই প্রতিবছর ৪ নভেম্বর সংবিধান দিবস জাতীয়ভাবে পালন করার উদ্শ্যে সফল হবে।
লেখক: রাজনীতিক, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক।