বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

তিন নভেম্বর ও খালেদ মোশাররফের দুর্বলতা

  • রাহাত মিনহাজ   
  • ২ নভেম্বর, ২০২১ ১৯:৪২

খালেদের সমন্বয়হীন অভ্যুত্থানের সঙ্গে সঙ্গে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই খুনি চক্র আরকেটি ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেছিল। ৩ নভেম্বর রাতেই কারাগারে নিষ্ঠুর হত্যার শিকার হন জাতীয় চারনেতা। যতদূর জানা যায় মোশতাক ও খুনি মেজর চক্রের যোগসাজসেই নিহত হন মুক্তিযুদ্ধের চার মূল সংগঠক। খালেদ মোশাররফ ওই সময় জাতীয় চারনেতার বিষয়ে কিছুই ভাবেননি। তিনি সচেতন হলে অথবা চাইলে হয়তো ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতো।

নভেম্বর, ১৯৭৫। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ধোঁয়াশাপূর্ণ একটি অধ্যায়। এই সময় বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিভাজনের যে বীজ অঙ্কুরিত হয়েছিল তা আজ এক বিশাল মহিরুহ হয়ে দেশের রাজনীতিতে দণ্ডায়মান। তাই এই সময় নিয়ে নানামুখী আলোচনা-সমালোচনা হতে পারে, পরস্পর বিরোধী কথার যুদ্ধ বা আক্রমণ চলতে পারে কিন্তু এই অস্থির সময়কে উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকেই বাংলাদেশ নামক নবীন রাষ্ট্রটি প্রবেশ করে অদ্ভুত এক গোলকধাঁধায়। রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক, নতুন সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়া কিন্তু দেশ চলছিল খুনি মেজরদের নির্দেশে। দৃশ্যত, তখন দেশ ছিল বিশৃঙ্খল, বিভক্ত, দিশাহীন। আর ক্ষমতার কেন্দ্র ছিল দুটি। বঙ্গভবন ও সেনানিবাস। ১৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে সব ক্ষমতা ছিল খুনি চক্রের হাতেই। ফারুক-রশীদ চক্র জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে খুন করে অনেককেই ক্ষমতার স্বাদ পাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিল।

ফলে তারা ছিলেন খুনিদের প্রতি অনুরক্ত, নিস্ক্রিয়, প্রতিক্রিয়াহীন। অপরদিকে খুনিচক্রের হঠকারিতাকে নিজের স্বার্থে মেনে নিলেও তাদের ঔদ্ধত্য, আস্ফালন নিয়ে সেনাবাহিনীর অনেকেই বিরক্ত ও শঙ্কিত ছিলেন। এই নিয়ে তৈরি হয় ধোঁয়াশা। যা ধীরে ধীরে বাংলাদেশকে নিয়ে যায় আরেক রক্তাক্ত নাটকের শেষ অঙ্কে। যে বিয়োগান্তক নাটকের আলোচিত চরিত্র খালেদ মোশাররফ।

খালেদ মোশাররফ বীর উত্তম। একজন দুর্দান্ত মুক্তিযোদ্ধা। গেরিলা যোদ্ধাদের গুরু। যার হাতে ত্রিপুরার মেলাঘরে বৃহত্তর ঢাকার হাজার হাজার অগ্রসর তরুণ গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছেন। খালেদ নিজেও রণাঙ্গনে মারাত্মক আহত হন বিজয়ের আগে। পরে চিকিৎসা শেষে তিনি ফিরেছেন স্বাধীন বাংলাদেশের সেনাবাহিনীতে। ছিলেন খুবই সম্মানিত ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আস্থাভাজন সেনা কর্মকর্তা।

১৯৭৫ সালে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মেশাররফ ছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সিজিএস। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদ। আর সেনাবাহিনীতে তার আস্থাভাজন ছিলেন ঢাকার ৪৬ ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়াত জামিল। সে সময় ৪৬ ব্রিগেড ছিল একটি শক্তিশালী স্বতন্ত্র কমান্ড। ১৯৭৫ সালের খুনি চক্র অর্থাৎ ফারুক-রশীদরা সারাসরি শাফায়াতের কমান্ডে ছিল। কিন্তু ১৫ আগস্টের কালরাতে তারা কমান্ডকে ব্রেক করে ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে ফেলে।

এতে সেনাবাহিনীতে শাফায়াতের যোগ্যতা নিয়ে মারাত্মক প্রশ্ন ওঠে। এদিকে খুনিদের ঔদ্ধত্য আর সেনানিবাসে না ফিরে আসায় ধীরে ধীরে সেনানিবাসের উচ্চপর্যায়ে অন্য ধরনের, পাল্টা ব্যবস্থা নেয়ার প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। ১৯৭৫ সালের অক্টোবরে সবাই অনেকটা নিশ্চিত হয়ে যায় খুব দ্রুত কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। কিন্তু তা কী আর কার মাধ্যমে এটা ঘটবে সেটা নিয়ে ছিল জল্পনা-কল্পনা, সংশয়।

ডেট লাইন: তিন নভেম্বর ১৯৭৫

পারস্পরিক সন্দেহ-সংশয় আর শঙ্কার ওই সময়ে পরিবর্তনের প্রক্রিয়ার সূত্রপাত ঘটান খালেদ মোশাররফ ও শাফায়াত জামিল। শাফায়াতের দাবি অনুযায়ী খুনিদের সেনা চেইন অব কমান্ডে আনতে খালেদ ও শাফায়াত একমত হন। পরিবর্তন বা পাল্টা অভ্যুত্থানের দিন ঠিক করা হয় ৩ নভেম্বর ১৯৭৫।

শাফায়াত জামিল তার ‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ রক্তাক্ত মধ্য-আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর’ (১৯৯৮) গ্রন্থে এই অভ্যুত্থান সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। তার বর্ণনা অনুযায়ী- “পরিকল্পনামতো রাত তিনটায় বঙ্গভবনে মোতায়েন প্রথম বেঙ্গলের কোম্পানি দুটো ক্যান্টনমেন্টে চলে এলো। আমার স্টাফ অফিসারবৃন্দ- মেজর নাসির, মেজর ইকবাল, মেজর মাহমুদ এবং এম.পি. অফিসার মেজর আমিন অভ্যুত্থান শুরুর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। সেনাপ্রধান জিয়াকে ১৫ আগস্টের খুনি বিদ্রোহকারীদের কবল থেকে বিচ্ছন্ন করে রাখার জন্য ক্যাপ্টেন হাফিজউল্লাহর নেতৃত্বে প্রথম বেঙ্গলের এক প্লাটুন সেনা পাঠানো হলো তাঁকে নিরাপত্তামূলক হেফাজতে রাখতে। মেজর নাসির ও মেজর আমিনকে পাঠালাম ট্যাঙ্ক বাহিনী হেড কোয়ার্টারে।” (পৃষ্ঠা; ১৩২-১৩৩)

এখানে উল্লেখ্য যে, শাফায়াত জামিল জিয়াউর রহমানকে সরাসরি বন্দি না বলে ‘নিরাপত্তামূলক হেফাজত’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। যদিও সেই সময়ের অনেক সেনা কর্মকর্তা বিভিন্ন বই আর নিবন্ধে জিয়াকে বন্দি করার বিষয়টি উল্লেখ করে থাকেন। শাফায়াতের মতে, এই অভ্যুত্থানে প্রাথমিক সফলতার মূল ছিল বিমান বাহিনী।

কাক ডাকা ভোরে বিমানবাহিনীর পাইলটরা সেদিন বঙ্গভবনের ওপর ফাইটার প্লেন ও হেলিকপ্টার উড়িয়েছিলেন। যাতে ভীত সন্ত্রস্ত হয়েই মোশতাক ও খুনি চক্র ক্ষমতা ছাড়তে রাজি হয়। ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানকারীরা এক সময় বিনা প্রতিরোধেই আত্মসমর্পণ করে। তাদের পরাভূত করতে একটি গুলিও খরচ করতে হয়নি। টেলিফোন যুদ্ধেই পরাজয় মেনে তারা বিদেশে চলে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করে।

তিন নভেম্বরের অভ্যুত্থানে প্রাথমিক সফলতা আসলেও পরবর্তী সময়ে দ্রুত উল্টে যায়। অতি অল্প সময়ের মধ্যে সক্রিয় হয়ে ওঠে সে সময় বেশ প্রতাপশালী জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদের উইং বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা। যারাই মূলত নতুন করে পট পরিবর্তনের সূচনা করে। তাদের মূল নেতৃত্বে ছিলেন রণাঙ্গনের আরেক বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল (অব.) আবু তাহের।

তাহের ও জাসদের প্রতিক্রিয়া ছাড়াও ওই সময়ে খালেদ মোশাররফের ব্যর্থতার বেশ কয়েকটি কারণ ছিল। সামরিক বিশ্লেষকরা মনে করেন সিদ্ধান্ত গ্রহণে অকল্পনীয় বিলম্ব, অদূরদর্শিতা আর নমনীয়তা তাকে সফল হতে দেয়নি। এছাড়া সেনাবাহিনীতে বেশ জনিপ্রয় জিয়াকে বন্দি করে নিজে সেনাপ্রধান পদে অধিষ্ঠিত হওয়াকেও অনেকেই খালেদের পতনের কারণ বলে মনে করে থাকেন। এছাড়া সক্রিয় ছিল রশীদ-ফারুকের অনুগত সেনারা। যারা খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত ছিল।

এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানের পর ফারুক-রশীদের অনুগত সেনারাই জেলখানায় জাতীয় চারনেতাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। তাই বলা যায়, খালেদ মোশাররফকে বহুমুখী প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হয়। যা সম্মিলিতভাবে তার অভ্যুত্থানকে ব্যর্থ করে দেয়। যার শেষ পর্যায়ে নির্মমভাবে প্রাণ দিতে হয় খালেদ ও তার সহযোগী হুদা-হায়দারকে।

সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব

অভ্যুত্থান সংঘটিত হওয়ার পর পরিস্থিতির পুরো নিয়ন্ত্রণ নিতে খালেদ অনেক সময় নেন। বঙ্গভবনে দিনরাত চলে দেন দরবার। দরকষাকষি। সামরিক ইতিহাসে কোনো অভ্যুত্থানকারী কখনও সিদ্ধান্ত নিতে এত সময় নেননি। খালেদ অভ্যুত্থান করলেন আবার নানা বিষয়ে দেন-দরবার মোশতাকের সঙ্গে!

বিষয়টি স্ববিরোধী। যার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, তার সঙ্গেই আলোচনা! এদিকে এই আলোচনার মধ্যে খুনি চক্র নিরপদ বিদেশ গমনের নিশ্চয়তা চায়। একপর্যায়ে তা তারা আদায়ও করে! আর এতে প্রশ্ন আসে খালেদের এই অভ্যুত্থানের প্রকৃত উদ্দেশ্য নিয়ে। এ বিষয়ে একটা মূল্যায়ন পাওয়া যায় কবি নির্মলেন্দু গুণের বিশ্লেষণে। তিনি তার ‘রক্তাক্ত নভেম্বর ১৯৭৫’ গ্রন্থে লিখেছেন-

“আমার মনে প্রশ্ন জাগে, তবে কি সামরিক বাহিনীতে চেইন অব কমান্ড পুনঃপ্রতিষ্ঠার সীমিত লক্ষ্যকে সামনে রেখেই খালেদ মোশাররফ এই অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিলেন? দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণে অপটু একজন দুর্বল চিত্তের জেনারেল হিসেবে খালেদ যখন চিহ্নিত হতে চলেছেন, তখন আমাদের কানে আসে শাফায়েত জামিলের নাম। আমরা শুনতে পাই শাফায়েত জামিল বঙ্গভবনে গিয়ে খুনি মোশতাককে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছিলেন। তখন জেনারেল ওসমানী সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে মোশতাককে রক্ষা করেন- এমন কথা শোনা যাচ্ছিলো।”(পৃষ্ঠা:২৩) কবি নির্মলেন্দু গুণের এই বিশ্লেষণ অনেক প্রাসঙ্গিক। শুধু তিনিই নন, অন্যান্য সামরিক বিশ্লেষকও মনে করেন খালেদ সিদ্ধান্ত নিতে অনেক সময় নিয়েছেন, কিছু ক্ষেত্রে অযথা সময় নষ্ট করেছেন। যা তার অভ্যুত্থানকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করে।

ভারতপন্থি খালেদ?

খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানবিরোধী বেশ কয়েকটি পক্ষ ছিল। জাসদের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা, ফারুক-রশীদের অনুগত সেনা, জেনারেল জিয়ার অনুগত সেনা কর্মকর্তা ও অফিসার এবং খন্দকার মোশতাকের সমর্থকরা। সংগঠিত এই শত্রুরা খালেদ ভারতপন্থি, এই অভ্যুত্থান ভারতপন্থিদের কাজ বলে গুজব ছড়ায়। এ কাজে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার প্রচারণা ছিল সবচেয়ে বেশি। তারা বিভিন্ন সেনানিবাসে এ নিয়ে লিফলেটও ছড়ায়। যা ওই সময় বেশ কার্যকর প্রমাণিত হয়। আর রেডিও টিভিতে কোনো ঘোষণা না থাকায় জনসাধারণও ছিলেন বিভ্রান্তিতে।

এছাড়া ৪ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য এক শোক র‌্যালিতে খালেদ মোশাররফের মা ও ভাই যোগ দেয়ায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে। ওই সভার ছবি প্রকাশিত হয়েছিল ‘বাংলাদেশ টাইমস্’ সংবাদপত্রে। এতে খালেদের বিরুদ্ধে ভারতপন্থিতার যে গুজব তা সত্যি বলেই ধরে নেয় জনসধারণ থেকে শুরু করে সেনাবাহিনীর একটি অংশ। যদিও ১৯৭১ সালের মুক্তি সংগ্রাম থেকে শুরু করে পরবর্তী সময়ে কখনই খালেদ ভারতপন্থি বলে বিবেচিত হন- এমন কোনো কাজ করেননি। বরং সেই সময় গেরিলা রিক্রুট থেকে নানা ইস্যুতে খালেদ ভারতবিরোধী বলেই পরিচিত ছিলেন।

তবে অভ্যুত্থান পরবর্তী কিছু অদূরদর্শী পদক্ষেপ আর বিরূপ পরিবেশের কারণে খালেদ মোশাররফকে ভারতের চর হিসেবে চিত্রিত করা হয়। যা সত্য ছিল না। এ বিষয়ে সাবেক সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম. সাখাওয়াত হোসেন পিএসসি (অব.) তার ‘বাংলাদেশ: রক্তাক্ত অধ্যায় ১৯৭৫-৮১’ বইতে লিখেছেন-

“ভারতের সাথে যোগসাজোস থাকার ধারণা অমূলক। খালেদ মোশাররফ, শাফায়েত জামিল ও অন্যান্যরা যে ধরনের দেশ প্রেমিক ও যুদ্ধে তাদের যে অবদান রয়েছে সেখানে তাদের সম্পর্কে এ ধরনের ধারণা (ভারতের চর) পোষণ করা অত্যন্ত Unjustified. হয়ত কিছু কাকতালীয় ঘটনা সে সময় ঘটতে পারে।” (পৃষ্ঠা: ১০০-১০১)

এই ঘটনার বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করে জানা যায়, খালেদ ভারতপন্থি ছিলেন না। তবে পারিপার্শ্বিক নানা ঘটনা ও ষড়যন্ত্র তাকে ভারতপন্থি হিসেবে চিত্রিত করেছিল। যা তার অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ার পেছনে জোরালোভাবে কাজ করে।

গণমাধ্যম থেকে দূরে থাকা

খালেদ ও শাফায়াত ঠিক কী করতে যাচ্ছেন তা নিয়ে জাতির সামনে কিছুই পরিষ্কার করেননি। গণমাধ্যম ছিল একেবারেই নীরব। যদি গত শতাব্দীতে বিশ্বজুড়ে যতগুলো ক্যু বা পাল্টা ক্যু হয়েছে তাতে মূল অস্ত্র ছিল গণমাধ্যম, বিশেষ করে বেতার। কিন্তু রহস্যজনক কারণে ওই সময় খালেদ রেডিও ব্যবহার করেননি। ওই সংকট মুহূর্তে জাতিকে অন্ধকারে রাখার বিষয়ে লে. কর্নেল (অব.) এমএ হামিদ পিএসপি’র একটি বর্ণনা পাওয়া যায়। তিনি তার ‘তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও না বলা কিছু কথা’ (২০০৩) গ্রন্থে লিখেছেন-

“সকাল থেকেই সারাদেশে আবার বিভ্রান্তি। রেডিও বাংলাদেশ ধরতে গিয়েই বিপত্তি। কোন শব্দ নেই। রেডিও বন্ধ। সবাই ধরে নিল আবার ক্ষমতার হাতবদল হয়ে গেছে। যদিও মোশতাক তখনও প্রেসিডেন্ট। শাফায়েত জামিল সাভারে অবস্থিত রেডিও ট্রান্সমিটারের একটি অংশ খুলে নেওয়ায় রেডিও ব্রডকাস্টিং সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল। দেশের মানুষ আর একটি রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানের আশঙ্কায় ভীত হয়ে পড়ল।”(পৃষ্ঠা ৭৮) এ বিষয়ে লেখকের সঙ্গে কথা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সুপারনিউমারি অধ্যাপক ড. সাখাওয়াত আলী খানের সঙ্গে। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি জানান-

“বেতারে ঘোষণা বা বেতারে তখন (৩ নভেম্বরের পর) ঠিক সম্প্রচার হচ্ছিল সে বিষয়ে আমার ভালো ধারণা নেই। রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর ১৫ আগস্ট রেডিওকে যেভাবে ব্যবহার করা হয় ৩ নভেম্বর খালেদ বেতারকে সেভাবে কোনো কার্যকরভাবে ব্যবহার করেছে তেমনটা আমার মনে হয় না। আমার ধারণা খালেদের পক্ষের লোকেরা বেতারকে সেভাবে ব্যবহার করেননি। কারণ যদি করা হত তাহলে সে বিষয়টি আমার জানা থাকতো।”(সাক্ষাৎকার ড. সাখাওয়াত আলী খান: ২০১৯)।

একটি অভ্যুত্থানের সাফল্য নির্ভর করে সুর্নিদিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ ও তা সম্পর্কে যথাযথ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সবার সহযোগিতার মাধ্যমে। যে লক্ষ্যে খালেদ মোশাররফ গণমাধ্যমের ব্যবহার করেননি। যা তার অভ্যুত্থানকে ব্যর্থ করতে সহযোগিতা করে। শত্রু বা প্রতিপক্ষ সম্পর্কে গোয়েন্দা তথ্য না নেয়া

খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থান ছিল রক্তপাতহীন। খালেদ কোনো রক্তপাত চাননি এ কথা সত্য। কিন্তু খালেদ মোশাররফ তার শত্রু সম্পর্কে সচেতন ছিলেন না। তার কাছে ছিল না যথাযথ গোয়েন্দা তথ্য। জাসদের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার কার্যক্রম সম্পর্কে খালেদ ছিলেন সম্পূর্ণ অন্ধকারে।

এছাড়া জিয়াউর রহমানের অনুসারী ও ফারুক-রশীদ চক্রের অনুগত সেনাদের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে খালেদ কোনো পদক্ষেপ নেননি। খালেদ সরল মনে সবাইকে বিশ্বাস করে নিজ লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। এই পথে চলতে গিয়ে তাতে যে তার নিজের পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে তা তিনি খেয়ালই করেননি। খালেদের এই শত্রুরা ছিলেন সংগঠিত, অনেক নিষ্ঠুর। যুদ্ধ বা অভ্যুত্থান প্রেক্ষাপটে শত্রুদের সম্পর্কে কোনো ধারণা না থাকা বা ইতিবাচক ধারণা পোষণা করা খুব একটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। ওই অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ার কিছু কারণ তুলে ধরেছেন সাখাওয়াত হোসেন।

তিনি ‘বাংলাদেশ: রক্তাক্ত অধ্যায় ১৯৭৫-৮১’ গ্রন্থে লিখেছেন- “সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরেও খালেদ মোশাররফ ও তার সঙ্গীদের সাথে সাধারণ সৈনিকদের কোন যোগাযোগ না থাকায় সৈনিকদের সাথে দূরত্ব বাড়তে থাকায় নানা ধরনের সংস্থা শিকড় গাড়তে সক্ষম হয়। জনপ্রিয়তার দিক থেকে খালেদ মোশাররফের চাইতে জিয়াউর রহমান এগিয়ে ছিলেন। ...খালেদ মোশররফ অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেন ঠিকই কিন্তু অভ্যুত্থানের কোথাও কোন সমন্বয় তিনি করতে পারেননি। এ কয়েকটা দিনে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকেও কোন কাজে লাগাননি। সেজন্য তিনি ভেতর বা বাইরের কোন খবর সময়মতো তিনি পাননি। রংপুর থেকে ৭২ ব্রিগেডের ইউগুলোকে ঢাকায় আনার কোন ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি।” (পৃষ্ঠা ১১৫-১১৬)

খালেদের সমন্বয়হীন অভ্যুত্থানের সঙ্গে সঙ্গে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই খুনি চক্র আরকেটি ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেছিল। ৩ নভেম্বর রাতেই কারাগারে নিষ্ঠুর হত্যার শিকার হন জাতীয় চারনেতা। যতদূর জানা যায় মোশতাক ও খুনি মেজর চক্রের যোগসাজসেই নিহত হন মুক্তিযুদ্ধের চার মূল সংগঠক। খালেদ মোশাররফ ওই সময় জাতীয় চারনেতার বিষয়ে কিছুই ভাবেননি। তিনি সচেতন হলে অথবা চাইলে হয়তো ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতো।

৩ নভেম্বর অভ্যুত্থানের নায়ক হয়েও তিনি এই বর্বর এই হত্যাকাণ্ডের খবর জেনেছিলেন অনেক পরে। ততক্ষণে খুনিরা বিশেষ বিমানে দেশ ছেড়েছে। ৩ নভেম্বর জেল হত্যার জন্য দায়ী কে বা কারা তা উচ্চ আদালতের রায়ে অনেকটা পরিষ্কার হয়েছে। জাতি প্রকৃত সত্য জানতে পেরেছে। কিন্তু তিন নভেম্বর শুরু হওয়া অভ্যুত্থানের হয়তো আরও অনেক সমীকরণ আছে। যা এখনও অজানা।

যেমন অজানা তিন নভেম্বর অভ্যুত্থান প্রেক্ষাপটে ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ সকালে তিন বীর মুক্তিযোদ্ধা খালেদ-হুদা-হায়দারের হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি। কাদের হাতে নিষ্ঠুরভাবে প্রাণ দিতে হয়েছিল এই তিন জনকে? লেখকের সঙ্গে এক আলাপচারিতায় খালেদ মোশাররফের কন্যা সাবেক সংসদ সদস্য মেহজাবিন খালেদ জানিয়েছিলেন, তাদের কাছে থাকা তথ্য অনুযায়ী তার বাবার খুনিদের দুজন এখনও বেঁচে আছেন। এই হত্যকাণ্ডের রহস্য উন্মেচনে তিনি আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার কথাও বলেছিলেন। যদিও এর দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি এখনও চোখে পড়ে না।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

এ বিভাগের আরো খবর