বাংলাদেশের অর্থনীতি কৃষিনির্ভর। সমবায় সমিতি এমন একটি জনকল্যাণ ও উন্নয়নমূলক আর্থসামাজিক প্রতিষ্ঠান, যার মধ্যে থাকে গণতন্ত্র, সম্মিলিত কর্মপ্রচেষ্টা, ব্যাপক উৎপাদন কর্মযজ্ঞ এবং সদস্যদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতির প্রয়াস। আধুনিক কৃষির জন্য যে পুঁজি, ঝুঁকি এবং যৌথ মেধার দরকার এর জন্য প্রয়োজন গণমুখী কৃষিভিত্তিক সমবায়ব্যবস্থা। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত ও মানুষের দারিদ্র্য দূর করতে হলে কৃষি সমবায়ের কোনো বিকল্প নেই।
যথাযথ নীতি, স্বচ্ছ ব্যবস্থাপনা এবং সার্বিক সহযোগিতা পেলে কৃষি সমবায় খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করতে পারে। দারিদ্র্য বিমোচন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, পরিবেশ বিপর্যয় প্রতিরোধ এবং খাদ্য নিরাপত্তাবলয় সৃষ্টিতে অন্যতম এবং উৎকৃষ্ট পদ্ধতি হলো সমবায়ী উদ্যোগ। এর জন্য প্রয়োজন সম্মিলিত চেষ্টার মাধ্যমে দেশ ও নিজের জন্য সমবায় প্রতিষ্ঠা। এই মর্মবাণী ধারণ করে সমবায় আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং বাংলাদেশে সমবায় আন্দোলনকে ছড়িয়ে দেয়ার দায়িত্ব সবার।
দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও স্বনির্ভরতা অর্জনে সমবায়ের গুরুত্ব অপরিসীম। শতাব্দীপ্রাচীন এ আন্দোলন বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে সমবায়ের চেতনাকে প্রবল ও অর্থবহ করে তুলেছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আজন্ম লালিত স্বপ্ন- ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও শোষণমুক্ত সোনার বাংলা বিনির্মাণ করা। তিনি দরিদ্র-সুবিধাবঞ্চিত মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে গণমুখী সমবায় আন্দোলনের স্বপ্ন দেখেছিলেন। সমবায়ের প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করে সংবিধানের ১৩(খ) অনুচ্ছেদে সম্পদের মালিকানার দ্বিতীয় খাত হিসেবে সমবায়কে স্বীকৃতি এবং গণমুখী আন্দোলনে পরিণত করার ডাক দিয়েছিলেন।
জনগণের পুষ্টিচাহিদা পূরণে দরিদ্র, ভূমিহীন, নিম্নবিত্ত দুগ্ধ উৎপাদনকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণপূর্বক সমবায়ের মাধ্যমে সুসংগঠিত করার লক্ষ্যে ১৯৭৩ সালে ‘সমবায় দুগ্ধ প্রকল্প’ নামে একটি দুগ্ধশিল্প উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করে পাঁচটি উৎপাদনকারী এলাকায় দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা স্থাপন করেন। মিল্কভিটা এই সুদূরপ্রসারী উদ্যোগের ফসল। জাতির পিতা সমবায় পদ্ধতিতে সমন্বিত ও যৌথ খামার প্রচলনের মাধ্যমে উন্নয়নের পাশাপাশি স্থানীয় রাজস্বে পল্লী উন্নয়ন করতে চেয়েছিলেন।
যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশ পুনর্গঠনকালেই জাতির পিতা সমবায়ের মাধ্যমে এ দেশের আর্থসমাজিক উন্নয়নের স্বপ্ন দেখেন। কৃষি, ভূমি ব্যবস্থাপনা, শিল্প উদ্যোগ, কৃষি ঋণ বিতরণ- সব ক্ষেত্রে সমবায় কৌশলকে কাজে লাগিয়ে স্থায়ী অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। সংবিধানে সমবায়কে রাষ্ট্রীয় সম্পদের মালিকানার দ্বিতীয় খাত হিসেবেও স্বীকৃতি দেন। তার দর্শনকে ধারণ করেই সরকার প্রতিটি গ্রামে সমবায়ভিত্তিক মৎস্য খামারসহ গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগির খামার গড়ে তুলছে।
সমিতির মাধ্যমে সামাজিক বনায়ন, পরিবেশের উন্নয়ন, তাঁত ও সেলাই, হস্তশিল্প, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প, কুটির শিল্প, মৃৎশিল্প, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ইত্যাদি উন্নয়নমূলক প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। তবে সমবায়কে উৎপাদনমুখী কার্যক্রম পরিকল্পনায় নতুন করে সাজানো প্রয়োজন। দেশে সমবায় আন্দোলন ও গ্রামীণ অর্থনীতি বিকাশের স্বার্থে সমগ্র গ্রাম-ইউনিয়ন পর্যায়ে ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে কৃষি ও ফলমূলভিত্তিক, দুগ্ধ ও মৎস্য খামার, হাঁসমুরগি পালন, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ভিত্তিক সমবায় সমিতি গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি।
এ ক্ষেত্রে সরকার সমবায় অধিদপ্তরকে শক্তিশালী করে একটি সমন্বিত ও সুষ্ঠু কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের মাধ্যমে তা তদারকি ও বাস্তবায়ন করতে পারে। দেশের সব জাতীয়, কেন্দ্রীয় ও প্রাথমিক সমিতিগুলোকে ইউনিয়নের সদস্যভুক্ত করা যায়। সমিতিগুলো নিয়মিত চাঁদা পরিশোধ করলে ইউনিয়নের অর্থসংকট হবে না। ইউনিয়ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচিসহ বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে। সর্বোপরি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সৎ, অভিজ্ঞ ও প্রকৃত সমবায়ীদের দ্বারা ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করলে সবচেয়ে বেশি কার্যকর হবে।
এ ছাড়া রাষ্ট্রীয় লোকসানি শিল্প-কারখানাগুলোকে সমবায়ের আওতায় শ্রমিক ও কর্মচারীদের মাধ্যমে পরিচালিত করা উচিত। তাহলে লোকসানি খাতগুলো রাজস্ব আয়ের খাত হিসেবে পরিণত হবে। এর মাধ্যমে সমবায়ীরাও দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে বলে আশা করা যায়।
সুষ্ঠু কর্মপরিকল্পনা, আয়-ব্যয়ের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাবে সমবায় খাতে প্রত্যাশিত অগ্রগতি আজ অবধি দৃশ্যমান হয়নি। ব্রিটিশ আমল, পাকিস্তান আমল এবং স্বাধীন বাংলাদেশের সূচনালগ্নে গঠিত সমবায় সমিতিগুলো হয় বন্ধ হয়ে গেছে, নয়তো নিষ্ক্রিয় রয়েছে। কেবল কিছু সমিতির কার্যক্রম চালমান আছে। নতুন সমিতি খুব একটা গঠিত হয় না। এর পরিপ্রেক্ষিতে দেশের নিষ্ক্রিয় ও মৃতপ্রায় সমবায় সমিতিগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করতে একজন সমবায় বিশেষজ্ঞকে প্রধান করে এবং আরও দুইজন অভিজ্ঞ সমবায় গবেষককে সদস্য করে কমিশন গঠন করা যেতে পারে।
কমিশনটি দেশের সমবায় সমিতির বিদ্যমান পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে সমস্যা ও সম্ভাবনা নির্ণয় করে সরকারের কাছে করণীয় প্রস্তাবনা পেশ করবে। আর যেসব সমিতি আর পুনরুজ্জীবিত করা সম্ভব নয়, সেগুলোর বিলুপ্তি ঘোষণা এবং যেসব সমিতি পুনরায় চালু করা সম্ভব সেগুলো কোন প্রক্রিয়ায় চালু হবে সেসব বিষয় নিয়ে কাজ করবে।
যে সমিতিগুলো বন্ধ আছে এর কারণ অনুসন্ধানপূর্বক দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ারও সুপারিশ করা যেতে পারে। পাশাপাশি সমবায়ের বেহাত ও বেদখল হওয়া সম্পদ পুনরুদ্ধারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। সমবায় অধিদপ্তরের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে সমবায়ীদের কোনো অভিযোগ থাকলে তা কমিশনে পেশ করার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। কমিশন দায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। পাশাপাশি দেশের বিদ্যমান সমবায় আইন বিধিমালা প্রয়োজন অনুযায়ী সংশোধনের জন্য সরকারের নিকট প্রস্তাব পেশ করতে পারবে।
দেশের সমবায় খাতের পুনরুজ্জীবন এবং এ খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতকরণে সমবায় কমিশন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবে। দারিদ্র্য বিমোচন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশ্বব্যাপী একটি পরীক্ষিত ও স্বীকৃত মাধ্যম হচ্ছে সমবায়। বর্তমানে অর্থনীতির প্রায় সব শাখায় সমবায়ের কার্যক্রম বিস্তৃত আছে। সরকারের নির্বাচনি অঙ্গীকার ও ‘রূপকল্প ২০২১’ বাস্তবায়নে সমবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বিশেষ করে আর্থিক ও সেবা খাতে নতুন কার্যক্রম গ্রহণ ও বিদ্যমান কার্যক্রমে গতিশীলতা আনয়নে সমবায় অধিদপ্তর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।
কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণ, দ্রব্যমূল্যের স্থিতিশীলতা আনয়ন, প্রশিক্ষণ ও সেবা প্রদানের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, অনগ্রসর ও পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীর জীবনমান এবং মানবসম্পদ উন্নয়ন; বিশেষত নারী উন্নয়নে সমবায় ভবিষ্যতে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে। পৃথিবীতে অনেক উন্নত রাষ্ট্রই সমবায়ের কৌশলকে অবলম্বন করে স্বাবলম্বী হয়েছে।
বাংলাদেশও সমবায়ী আদর্শে উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত হলে ড. আখতার হামিদ খানের প্রণীত পল্লি উন্নয়নের কৌশলকে কাজে লাগিয়ে দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। সমবায়ী চেতনায় মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে যেকোনো কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারে। সরকারের রূপকল্প ২০৪১ বাস্তবায়ন এবং বাংলাদেশকে বিশ্বদরবারে উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে সুনাম ও সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে সমবায় খাতের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার সুযোগ রয়েছে।
দুঃখের কথা হলো- সমবায় বর্তমানে মৃতপ্রায় সংগঠনে পরিণত হয়েছে। এর কার্যক্রম শুধু কাজের গরু কেতাবে পরিলক্ষিত হওয়ার বিষয়ে সীমাবদ্ধ। বাস্তবতা থেকে দূরে, সংকটের আবর্তে পতিত। এর পুনর্জাগরণ দরকার। বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করেছিলেন যে, সমবায়ের মাধ্যমে দেশ থেকে দারিদ্র্য দূরীকরণসহ স্বনির্ভরতা অর্জন করা সক্ষম। পৃথিবীর উন্নত দেশে সমবায় কাঠামো খুব মজবুত। তারা আধুনিক সমবায়ী ধারণাকে প্রাধান্য দিয়ে পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা লাভ করেছে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের পিছিয়ে থাকার কোনো সুযোগ নেই।
কেননা উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় অংশীদার সবাই। ২০৪১-এ টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করে উন্নত রাষ্ট্রের কাতারে আসীন হতে চায় বাংলাদেশ। এ ক্ষেত্রে সমবায় আদর্শকে পুরোপুরি জাতীয়করণ করে শক্ত নীতিনির্ধারণী কর্মপন্থা অনুশীলন করে সমবায়কে বাস্তবে রূপদান করা জরুরি। দুর্নীতিমুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে হবে। সর্বোপরি সুযোগ্য নেতৃত্ব ও আপসহীন মনমানসিকতায় সমবায়কে প্রাতিষ্ঠানিকতা দিতে এগিয়ে আসা প্রয়োজন। ত্যাগ, সততা, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতায় সমবায় গতি পাবে। তাই সমবায় সংস্কার কমিটি গঠনপূর্বক কমিশনের মতামত, সুপারিশ ও প্রস্তাবনার আলোকে সমবায়কে যুগোপযোগীকরণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।
লেখক: কলামিস্ট ও গবেষক