বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

প্রশ্নটা দুমুঠো ভাত নিয়ে

  •    
  • ৩০ অক্টোবর, ২০২১ ১৪:৫৮

মানুষকে ভাত কম খেতে বলা ভালো। কিন্তু প্রয়োজন চাল নিয়ে চালবাজি বন্ধ করা। দিনে দেশে ৮০ হাজার টন চাল প্রয়োজন। এর মধ্যে ৫০ হাজার টন চাল বাজারে কেনাবেচা হয়। বাজার কারসাজি করে কেজিতে ১০ টাকা বাড়তি মুনাফা করলে প্রতিদিন ৫০ কোটি টাকার মুনাফা আসে চালের বাজার থেকে।

দুনিয়ার অনেক দেশের তুলনায় আমরা ভাত বেশি খাই। আমরা মানে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ, শ্রমিক-কৃষক। আয় যাদের কম ভাত খায় তারা বেশি। দিনে নাকি ৪০০ গ্রাম চালের ভাত খাই। অনেক দেশে খায় দিনে ২০০ গ্রাম। যদি ভাত একটু কম খেত মানুষ, তাহলে চালের ঘাটতি হতো না। এ কথা শুনে প্রশ্ন জাগে না কত চাল উৎপাদন হয় আর কত চাল লাগে দেশে প্রতিবছর? ১৭ কোটি মানুষ ৪০০ গ্রাম চালের ভাত প্রতিদিন খেলে বছরে লাগে ২ কোটি ৪৮ লাখ টন চাল। আমাদের নাকি উৎপাদন হয়েছে ৪ কোটি ৫৩ লাখ টন ধান। চাল বানালে তার পরিমাণ হয় ৩ কোটি টনের বেশি। তাহলে?

ভেতো বাঙালি, হাভাতে বাঙালি! কত তকমা লাগানো হয় বাঙালির এই ভাত খাওয়া নিয়ে। আবার এই ভাতের জন্যই কত লড়াই। মা চারটা ভাত দেবেন বলে কাতর আবেদন সবই আমাদের ভূখণ্ডের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। ভাতের গন্ধ, ধোঁয়া ওঠা গরম ভাতের ছবি আমাদের মনের মধ্যে গাঁথা হয়ে আছে। তাই বিদেশ বিভুঁইয়ে কয়েকদিন ভাত খেতে না পেলে মনটা আকুলিবিকুলি করে ভাতের জন্য। দুটো টাকা রোজগারের জন্য মধ্যপ্রাচ্যের মরুতে বা ইউরোপের বরফপড়া শীতে যারা উদয়াস্ত পরিশ্রম করেন তাদেরও লক্ষ্য থাকে দেশে প্রিয়জন যেন ভাতের কষ্টে না থাকেন।

বাড়ি-গাড়ি, জায়গা-জমি যত কিছুই অর্জন করুক না কেন মানুষ বলে দুটো ভাতের জন্য এত কষ্ট করছি। আবার দায়িত্ব পালন না করে ক্ষমতা দেখালে তার প্রতি টিটকারি করে বলা হয়, ‘ভাত দেবার মুরোদ নাই, কিল মারার গোসাই’। ভাত তাই শুধু আমাদের প্রধান খাদ্য নয়, ভাতের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের সংস্কৃতি। প্রকৃতির আনুকূল্যে ধান উৎপাদন আর সামাজিক সংস্কৃতি হিসেবে ভাত- এই নিয়েই বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডের অধিবাসীদের অবস্থান। আর রাজনৈতিক স্লোগান হিসেবে তো বলা হতো ভোট ও ভাতের জন্য আমরা লড়ছি।

একেকটা দেশের খাদ্যাভ্যাস একেক রকম। পৃথিবীর বিরাট একটা অঞ্চলজুড়ে মানুষের প্রধান খাবার গম, কিছু দেশ আছে তাদের খাবার আলু, আর আমাদের ভাত। যে ভাত না হলে চলে না, হাত পড়তে যাচ্ছে এখন সেই ভাতের ওপর। আঘাত এসেছিল অনেক আগে থেকেই।

ধান উৎপাদন করে কৃষক ন্যায্য দাম তো দূরের কথা, সরকার-নির্ধারিত দাম পায় না আর সরকার-নির্ধারিত দামের চেয়ে অনেক বেশি দামে বাজারে চাল বিক্রি হয়। বর্তমানে মোটা চাল ৪৮–৫২ টাকা, মাঝারি চিকন চাল ৬০ টাকা এবং চিকন চাল ৭০ টাকার বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।

কৃষিবিদ দিবস উপলক্ষে ২০২১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি দেয়া বাণীতে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, বর্তমানে বিশ্বে ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ ৩য়, সবজি উৎপাদনে ৩য়, আলু উৎপাদনে ৭ম, আম উৎপাদনে ৭ম, পেয়ারা উৎপাদনে ৮ম স্থানে আছে বাংলাদেশ। তিনি উল্লেখ করেছিলেন, বর্তমানে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেড়ে হয়েছে ৪ কোটি ৫৩ লাখ ৪৪ হাজার টন। প্রধানমন্ত্রীর দেয়া তথ্য নিয়ে আপত্তি করার কোনো সুযোগ কি আছে? এ তথ্যকে চ্যালেঞ্জ করলে পাল্টা গ্রহণযোগ্য তথ্য দিতে হবে। ফলে সত্যি মনে না করার সুযোগ এবং সামর্থ্য কোনোটাই কারো নেই।

১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি এবং খাদ্য উৎপাদন ছিল ১ কোটি ১০ লাখ টন। ফলে অভাব ছিল। এখন জনসংখ্যা ১৭ কোটি আর খাদ্যশস্য উৎপাদন সাড়ে ৪ কোটি টনের বেশি। অর্থাৎ জনসংখ্যা বেড়েছে ২ গুণের একটু বেশি কিন্তু খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে ৪ গুণের বেশি। তাহলে খাদ্যঘাটতি কিংবা খাদ্য-আমদানি করার কথা কি যুক্তিসংগত?

বাস্তবে তা কিন্তু ঘটছে। এই তো সেদিন ১৭ লাখ টন চাল আমদানির জন্য ৪২৮ ব্যবসায়ীকে অনুমতি দেয়া হলো শুধু তাই নয়, ১২ আগস্ট ২০২১ চাল আমদানির শুল্ক ৬২.৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ করা হয়েছে। কিন্তু বাজারে তার প্রভাব নেই।

কিছু মানুষের খাদ্যাভ্যাস বদলে যাচ্ছে। এখন যাদের সামর্থ্য বেশি তারা ভাত খান কম। তারা তিনবেলা তো দূরের কথা একবেলাও ভাত খান না। কারণ তাদের খাওয়ার জিনিসের অভাব নেই। তারা দিনে কমপক্ষে ৭ বার খান। সকালে বেডটি সঙ্গে একটু খেজুর, বিস্কিট, ৮টায় নাশতা, ১১টায় হালকা স্ন্যাক্স, ১টায় লাঞ্চ, ৫টায় নাশতা, ৮টায় ডিনার, রাত ১০টায় হালকা কিছু।

এছাড়াও তাদের সামনে ফুলটাইম মৌসুমি ফল, আখরোট, কাজু বাদাম, স্যান্ডউইচ, বার্গার, পিৎজাসহ নানা ধরনের দেশি-বিদেশি খাবার এবং ওজন কমানোর জন্য গ্রিন টি ও ব্ল্যাক কফি তো থাকেই। তারা ভাত খান তবে তা স্ন্যাক্স আর ড্রিংকসের পাশাপাশি এক বা দুই বেলা এবং তা কয়েক চামচমাত্র। কিন্তু দেশে এ ধরনের মানুষের সংখ্যা কত? যারা মাঝারি থেকে উচ্চ আয় করেন এবং কায়িক পরিশ্রম কম করেন তাদের এই খাদ্য গ্রহণের সামর্থ্য এবং প্রয়োজন আছে। শহুরে মধ্যবিত্ত বলে যারা একটু আত্মসুখ অনুভব করেন তারাও কি এভাবে খাবার সংগ্রহের খরচ করে সংসার চালাতে পারবেন?

১৭ কোটি মানুষের দেশে এই ধরনের খাদ্যাভ্যাস মেনে জীবনযাপন করার মতো মানুষের সংখ্যা ধরুন মেরে কেটে ২০ লাখ। শতাংশের হিসেবে ১ শতাংশের কাছাকাছি। তারাই অবশ্য দেশের নীতিনির্ধারণ করেন। সে কারণে ৯০ ভাগের বেশি গরিব বা মধ্যবিত্তরা দুপুরে বা রাতে কী খায় তা ঠিক ধারণা করতে পারেন না।

কৃষক, রিকশাভ্যান ইজি বাইক চালক, নির্মাণ, পরিবহন শ্রমিক, গার্মেন্টস, লেদার, চা, রি রোলিং, জাহাজ ভাঙা, জাহাজনির্মাণ, দোকান কর্মচারী, হকারসহ প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রাতিষ্ঠানিক খাতের ৬ কোটি ৮২ লাখ শ্রমিক কত টাকা আয় করে আর কী খায় তারা? তাদের হাতের নাগালে স্যান্ডউইচ-বার্গার থাকলেও পকেটের সামর্থ্য থাকে না। তারা তিন বেলা ভাতই খান। পরিশ্রমের কাজ করলে দিনে ২৫০০ থেকে ৩০০০ কিলো ক্যালরি তাপ উৎপাদন করতে ভাতের বিকল্প কী?

কমপক্ষে ৫০০ গ্রাম চাল বা গম খেলে তারা ২০০০ কিলো ক্যালরি তাপ পাবেন, বাকিটা ডাল, তরকারি, মাছ, মাংস, ডিম কিংবা অন্য কিছু দিয়ে পূরণ করেন। ৫০ টাকা কেজির চাল কম খেয়ে ৮০০ টাকা কেজির বাদাম, বা ৮০ টাকা কেজির পেয়ারা, ১৯০ টাকা কেজির ব্রয়লার মুরগি, ৮০ টাকা লিটারের দুধ খেয়ে কি ভাতের অভাব পূরণ করা যাবে? আর যা ব্যয় হবে সেই খাদ্য ব্যয় কতজন মেটাতে পারবেন? তাদেরকে মোটা হয়ে যাওয়ার ভয় দেখিয়ে ভাত খাওয়া বন্ধ করা কি সম্ভব?

পৃথিবীর অনেক দেশের যে মানুষ দিনে ২০০ গ্রামও চাল খান না, কিন্তু তাদের প্রয়োজনীয় তাপ শক্তি তো বাতাস থেকে আসে না। তারা ভাত, রুটি, পাউরুটির বাইরে প্রচুর ফল, ভেজিটেবল সালাদ, মাছ-মাংস, দুধ, মাখন ও দুগ্ধজাত খাবার খান। ফাস্ট ফুড হিসেবে পিৎজা, স্যান্ডউইচ, বার্গার, হটডগ খান। কোক, পেপসি, বিয়ার, ওয়াইনসহ নানা খাবারের পাশাপাশি তারা যে ২০০ গ্রাম চালের ভাত খান, এটাই তো অবাক হওয়ার কথা। সে কারণেই স্থূলতা এখন তাদের জন্য বড় সমস্যা। ওদের সমস্যা মোটা হয়ে যাওয়া আর আমাদের শ্রমজীবীদের সমস্যা মোটা চালের ভাত খাওয়া।

ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচকে ১১৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৭৬ নম্বরে। ২০২০ সালে ছিল ৭৫ নম্বরে। তার মানে, দেশে ক্ষুধা এবং ক্ষুধার্ত মানুষের সংখা বেড়েছে।

জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি এবং বাংলাদেশ সরকারের করা যৌথ সমীক্ষায় বলা হয়েছে বাংলাদেশে এখনও ২ কোটি ১০ লাখ মানুষ অর্থাৎ প্রতি আটজনের মধ্যে একজনের পুষ্টিকর খাবার জোগাড়ের ক্ষমতা নেই। পুষ্টি জোগাড়ের ক্ষমতা না থাকলেও পেট ভরানোর প্রয়োজন তো আছে। সে ক্ষেত্রে সহজে পাওয়া ভাতের বিকল্প কী?

মানুষকে ভাত কম খেতে বলা ভালো। কিন্তু প্রয়োজন চাল নিয়ে চালবাজি বন্ধ করা। দিনে দেশে ৮০ হাজার টন চাল প্রয়োজন। এর মধ্যে ৫০ হাজার টন চাল বাজারে কেনাবেচা হয়। বাজার কারসাজি করে কেজিতে ১০ টাকা বাড়তি মুনাফা করলে প্রতিদিন ৫০ কোটি টাকার মুনাফা আসে চালের বাজার থেকে। বছরে কমপক্ষে ১৮ হাজার কোটি টাকার অতিরিক্ত মুনাফার এই চক্রের হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করার চাইতে খাওয়া কমানোর পরামর্শ দেয়া কি দায়িত্বশীলতার পরিচয় বহন করে?

লেখক: রাজনীতিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

এ বিভাগের আরো খবর