প্রায় দুই বছর বিশ্বব্যাপী করোনা সংক্রমণের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ জীবন-জীবিকার সব ক্ষেত্রই ভয়ানকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখন করোনা সংক্রমণ এদেশে ১ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করছে। জনজীবনে স্বস্তি ফিরে এসেছে। শুরু হয়েছে অর্থনৈতিকসহ অন্যসব কর্মকাণ্ড। এর একটা বড় ধরনের ইতিবাচক দিক যেমন রয়েছে, তেমনি নেতিবাচক প্রভাব থেকেও পুরোপুরি মুক্ত থাকা যাচ্ছে না।
বিশ্বব্যাপী ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগ ও যাতায়াত নতুনভাবে শুরু হয়েছে। ফলে সবক্ষেত্রেই বাড়তি চাপ লক্ষ করা যাচ্ছে। অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর অবস্থানে যতই পা ফেলতে শুরু করেছে, ততই এদেশে কয়েকটি অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয় সবার জীবনে প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। তবে অর্থনৈতিক এই নেতিবাচক প্রভাব সাময়িক সময়ের জন্য হতে পারে, যদি সরকার দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে। কারণ এটি এক ধরনের ছোটখাটো উত্তরণকালীন ব্যবস্থা।
কেননা, এখন বাজারে সবার উপরই ঘুরে দাঁড়ানোর চাপ পড়েছে যা সামাল দেয়া সাধারণ মানুষের পক্ষে বেশ কষ্টকর। আবার বিপুল সংখ্যক মানুষকে এখন দেশের বাইরে নানা কাজে যেতে হচ্ছে। ফলে সাধারণ সময়ের চাইতে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়ায়, বৈদেশিক মুদ্রার মান বেড়ে গেছে, অপরদিকে কমে গেছে বাংলাদেশি টাকার মান। মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার অবস্থা তৈরি হয়েছে। এটিও প্রান্তিক মানুষের জন্য মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হতে পারে। সুতরাং করোনা সংক্রমণ কমে যাওয়ার স্বস্তি বাজারে বড় ধরনের অস্বস্তি তৈরি করেছে। যা এখন প্রতিদিনই হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যাচ্ছে।
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বাড়ছে। অথচ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা আগের তুলনায় কমে গেছে। এক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদে মুদ্রাস্ফীতি হলে জনজীবনের ওপর যে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, এতে সন্দেহ নেই। সেক্ষেত্রে সাধারণ ও প্রান্তিক মানুষের সুষম খাদ্যের ঘাটতি তথা পুষ্টির অভাব বেড়ে যেতে পারে। এই বিষয়গুলো সরকারকে গুরত্বের সঙ্গে নিতে হবে। কেননা সাধারণ মানুষ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির দায় সরকারের ওপরই দেবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।
বর্তমান সময়টি সরকারের জন্য যতটা না স্বস্তির এর চাইতে বেশি অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন সরকারকেই বাজার অর্থনীতির লাগাম টেনে ধরতে হবে। কারণ পৌনে দুই বছর করোনার অতিমারিতে ব্যবসা-বাণিজ্যে বড় ধরনের ধস নেমেছিল। এখন সে ধস পুষিয়ে নেয়ার জন্য মনে হচ্ছে বাজারের সব কুশীলবই উঠে পড়ে লেগেছে। আমদানিকারকরা আমদানি মূল্যের বাড়তি লাভের ফন্দিফিকির করেই চলেছে, মজুতদারাও তাই। মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কত স্তরে বিভক্ত, কত প্রকার ও কী কী সেটি এখন নিরূপণ করাই কঠিন হয়ে পড়েছে। সব মধ্যস্বত্বভোগীরাও এখন করোনার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে মরিয়া।
বাজারের সাধারণ দোকানি, ফুটপাতের বিক্রেতা এমনকি নব্য বিক্রেতারাও দ্রব্যের দাম যে যার মতো বাড়িয়ে দিচ্ছে। পরিবহন খাতও এখন মওকা পাওয়ার দলে। এছাড়া পথে পথে যারা গোপনে চাঁদাবাজি করে তাদেরও যেন দুবছরের পাওনা এখনি পুষিয়ে নিতে হবে। বাজারে এই পুষিয়ে নেয়ার দৌরাত্ম্য বড় থেকে ছোট সব পণ্যের ওপর পড়েছে। আখেরে সেই চাপটি ভুগতে হচ্ছে ক্রেতা সাধারণের। তাই সবারই এখন চরম ভোগান্তি, উত্তেজনা আর বাজার মনিটরিং না করার অভিযোগ।
বাজার মনিটরিংয়ের জন্য পর্যাপ্ত লোকবল কোথায়? এদেশে বাজার তো সর্বত্রই বিস্তৃত। নামিদামি বিপণি বিতান থেকে শুরু করে সাধারণ দোকান, অলিগলি এবং ফুটপাত পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে। এক দোকান থেকে আরেক দোকানে একই পণ্যের দামে তারতম্য সহজেই দৃশ্যমান। সুতরাং বাজার নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা সরকারের হাতে নেই এটি সহজেই বোধগম্য। ফলে দ্রব্যমূল্য নিয়ে বাজারে চলছে নৈরাজ্য। উত্তরণকালে এমন নৈরাজ্য ঠেকায় কে? এরপরও সরকারের হাত গুটিয়ে থাকার সুযোগ নেই। সরবরাহ বাড়াতে হবে আমদানিকারক থেকে একেবারে খুচরা বিক্রেতা পর্যন্ত। এরপরেই কেবল পরিস্থিতির পরিবর্তন আশা করা যেতে পারে।
করোনা সংক্রমণ কমার লক্ষণ দেখে মানুষ আগের জীবনের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। কিন্তু পৌনে দুই বছরের করোনার অভিঘাত শুধু শরীর ও মনের মধ্যেই পড়েনি, সমাজের অভ্যন্তরেও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে গেছে। যা ধীরে ধীরে লক্ষ করা যাচ্ছে। মানুষের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার মতো কাজ দেশে এখনও সৃষ্টি হয়নি। করোনাকালে অনেকেই যে কাজ হারিয়েছে সেটি ফিরে পাওয়া তাদের জন্য সহজ হওয়ার কথা নয়।
করোনাকালে নিম্ন আয় ও প্রান্তিক মানুষের জীবনে টানাটানি পড়েছিল। এখন অনুকূল পরিবেশে সবাই কর্মসংস্থানের চেষ্টায় আছে। কারো কারো হচ্ছে, কেউ কেউ অপেক্ষায় আছে। এমন পরিস্থিতিতে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সবচাইতে বেশি বিপদে ফেলে দেয় স্বল্প আয় ও কর্মসংস্থানের আশায় যারা চেষ্টা করছে তাদের। বিশেষ করে খাদ্যদ্রব্যের মূল্য গত দুই থেকে তিন মাস যেভাবে বেড়ে চলছে তাতে স্বল্প আয় ও প্রান্তিক মানুষের জীবনকে অনেকটাই কষ্টে ফেলে দিয়েছে। অথচ দেশে ধান-চালের অভাব সরকারি পরিসংখ্যানে নেই।
গ্রামগঞ্জেও যে দৃশ্য দেখা যায় সেখানে ধানের অভাব রয়েছে এমনটি মনে হয় না। তবে যেটি বিস্ময়কর মনে হচ্ছে তা হলো- অধিক লাভের আশায় ধান-চাল মজুদ করার প্রবণতা অনেকের মধ্যেই বেড়ে গেছে। তারা অতিরিক্ত লাভের আশায় ধান-চাল বাজারে সরবরাহ সৃষ্টিতে নিজস্ব লাভের হিসাবে প্রাধান্য দিচ্ছে। ধান-চাল নিয়ে বড় মজুদদার, চাতালের মালিক, মধ্যস্বত্বভোগী এবং বড় বড় উৎপাদনকারীরাও এখন বাজারে ধান চালের সিন্ডিকেট তৈরি করেছে। সরকারকে বেকায়াদায় ফেলে চাল আমদানির ব্যবস্থা করেছে। শুধু তাই নয়, ট্যাক্স মওকুফে আমদানিকারকরা সরকারের ওপর প্রভাব ফেলছে। তবে এর সুবিধাটি সাধারণ ভোক্তাপর্যায়ে খুব একটা নেই।
অন্যদিকে পেঁয়াজ নিয়ে এবারও বাজার অস্থিতিশীল করার একটা বড় ধরনের চেষ্টা ব্যবসায়ীদের মধ্যে লক্ষ করা গেছে। অথচ পেঁয়াজের মূল্য এবার আগের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ার কোনো কারণ ছিল না। মাত্র তিন চার দিনের জন্য পূজা উপলক্ষে ট্রাক আসা বন্ধ ছিল। এতেই পেঁয়াজ ব্যবসায়ীরা করোনাকালের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে গোটা পেঁয়াজের বাজার দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেয়। এভাবে তেল, চিনি ও নিত্য প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য যে যেটি পেরেছে তাই আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য বৃদ্ধির অজুহাতে দেশের বাজারে বাড়িয়ে দিয়েছে।
বাজারে এবার ফল কেনা খুবই দায়। ফলের মূল্য এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে, মধ্যবিত্ত পরিবারও এখন নিয়মিত ফল কিনতে পারছে না। সবচাইতে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে বাজারে এখন যেকোনো জামাকাপড় ও পোশাক-পরিচ্ছদ ফুটপাতে কিনতে গেলেও আগের চাইতে দ্বিগুণ দাম হাঁকা হচ্ছে অথচ আমাদের দেশে কাপড়ের মূল্য এতটা বৃদ্ধি পাওয়ার কথা নয়। তবে ওই যে পুষিয়ে নেয়ার প্রবণতা! এটি পেয়ে বসেছে সব বিক্রেতাকেই।
করোনাকালে জামাকাপড় তেমন কিনতে হয়নি ঘরে থাকার কারণে। এখন কাজে-কর্মে কিংবা বাইরে যাওয়ার প্রয়োজনে ছোট বড় সবারই জামাকাপড়, জুতা-স্যান্ডেলসহ প্রয়োজনীয় কিছু না কিছু কিনতে হচ্ছে। এসময় দেখা যাচ্ছে দামে যেন আগুন লেগে গেছে।
কাঁচাবাজারের কথা বলতেই ভোক্তার চেহারা পেকে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে। কাঁচামরিচ এখন কতটা ঘরে আসছে তা বলা মুশকিল। কারণ দাম ১৫০ থেকে ২০০ টাকা কেজি হাঁকা হচ্ছে। তবে নিত্যদিনের তরকারির দাম আগের তুলনায় কমপক্ষে দ্বিগুণ হাঁকা হচ্ছে। দোকানিদের একই অজুহাত, বন্যা ও বৃষ্টিতে কাঁচা তরকারি নষ্ট হয়ে গেছে। তাই বাজারে সরবরাহে ঘাটতি পড়েছে। সেকারণে এখন প্রান্তিক ও সাধারণ ক্রেতাদের কাঁচা তরকারি কেনার পরিমাণ অর্ধেকের নিচে নেমেছে।
মধ্যবিত্তরা অর্ধেকে না নামালেও আগের সমান ব্যাগভর্তি বাজার করতে পারছে না। মাছ-মাংসের দামও ওঠা ছাড়া নামার লক্ষণ নেই। বাজারে এখন ব্রয়লার মুরগির দাম কেজিতে ১৮০ থেকে ১৯০ টাকার উপরে। অন্যগুলোর দামও একইভাবে দ্বিগুণ হাঁকা হচ্ছে। মুরগির উৎপাদনে করোনাকালে কিছুটা সংকট হয়েছিল। কিন্তু এর প্রভাব বাজারে এভাবে পড়বে ভাবা যায়নি। সেকারণে মাছ-মাংস কেনার ক্ষেত্রেও পকেটে টান লাগছে।
এই মুহূর্তে হঠাৎ করে ডলারের মূল্য ৮৪ থেকে ৮৮ টাকায় ব্যাংকগুলোতে লেনদেন হচ্ছে। বেসরকারি মানি চেঞ্জারে তা ৯০ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এর কারণ প্রচুর আমদানি বেড়ে যাওয়া। আবার চিকিৎসাসহ নানা কারণে বিদেশে যাওয়ার হিড়িক পড়ে গেছে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ না পড়ে উপায় নেই। এর ফলে মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ অবস্থাটি প্রলম্বিত যেন না হয় সেদিকে সরকারকে খেয়াল রাখতে হবে। বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখনও এতটা কমে যায়নি যে, ব্যাংকগুলো বর্ধিত চাহিদা পূরণ করতে পারছে না। সুতরাং সরকারকে এখানে হস্তক্ষেপ করতেই হবে।
সামগ্রিকভাবে বাজারে নৈরাজ্যের এই প্রবণতা টেনে ধরতেই হবে। নতুবা প্রান্তিক ও সাধারণ মানুষের মন সরকারের ওপর ভালো থাকার কোনো কারণ থাকবে না। করোনার স্বস্তিদায়ক সময়ে অস্বস্তির সব কারণ দূর করতে হবে। বিশেষত বাজারে করোনার ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার মনোবৃত্তি হ্রাস করার উদ্যোগ নিতেই হবে।
লেখক: গবেষক-অধ্যাপক।