বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

প্রধান বিচারপতির উদ্বেগ ও সাম্প্রদায়িকতা বিনাশে করণীয়

  • নাসির আহমেদ   
  • ২৪ অক্টোবর, ২০২১ ১৭:৩০

বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। এখানে অন্য ধর্মাবলম্বীদের ওপরে বিভিন্ন সময়ে হামলা এবং সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, এ কথা সত্য, কিন্তু তা সবসময়ই ঘটিয়েছে ধর্মান্ধ একটি চিহ্নিত চক্র। যারা মোট জনসংখ্যার অত্যন্ত সংখ্যালঘু একটি অংশ। এরা পাকিস্তান আমলেও সাম্প্রদায়িকতা আর ধর্মান্ধতাকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে, এখনও করছে। অপরাধীরা সংখ্যায় যত কমই হোক তারাই কিন্তু বড় বড় বিপর্যয় ঘটায়। সুতরাং ধর্মের রাজনীতি করা এই সংখ্যালঘু সাম্প্রদায়িকদের প্রতিরোধে সংঘবদ্ধ প্রয়াস জরুরি। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ ধর্মানুরাগী, তারা ধর্মান্ধ নয়। সংখ্যালঘু ধর্মান্ধরাই বিপদের কারণ।

দেশের বিভিন্ন স্থানে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক হামলা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন।

রোববার একটি মামলার শুনানিতে নিজের নেতৃত্বাধীন আপিল বেঞ্চে তিনি এই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। সাম্প্রদায়িক হামলার মামলায় ভুয়া অভিযোগ বিবেচনায় আসামিদের ছেড়ে দিলে কী অবস্থা দাঁড়াবে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন প্রধান বিচারপতি। তিনি বলেছেন- ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে এ ধরনের আসামিদের জামিন দিলে সমাজে নেতিবাচক বার্তা যাবে।’

ফরিদপুরের সালথায় ইউএনও অফিসে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় অভিযুক্ত আসামির জামিন শুনানিতে জামিন আবেদন নাকচ করে দিয়ে প্রধান বিচারপতি উল্লিখিত মন্তব্য করেন।

দেশের প্রধান বিচারপতির মতো একটি নিরপেক্ষ বিচার বিভাগের সর্বোচ্চ চেয়ার থেকে যে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিচারকদের দায়িত্বনিষ্ঠার বিষয়টিও তার উক্তির মধ্য দিয়ে পরিষ্কার হয়েছে। অতীতে অনেক মামলায় জঙ্গি ও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসীদের জামিন পেতে দেখেছি আমরা। প্রধান বিচারপতির এই উদ্বিগ্ন অভিমতের মধ্য দিয়ে বিষয়-সংশ্লিষ্ট সবাই আরও অধিকতর সতর্ক হবেন, এমন প্রত্যাশাই করতে চাই।

বাংলাদেশ আজ এক কঠিন ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। যেকোনো মূল্যে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা দমন করতেই হবে। আর সেজন্য চাই বিচার ও শাসন বিভাগের সমন্বিত প্রয়াস। একই সঙ্গে চাই দেশের প্রগতিশীল সব রাজনৈতিক দল, সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ প্রগতিপন্থিদের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ।

প্রধান বিচারপতির উদ্বেগ পর্যালোচনা করলে এসত্য বেরিয়ে আসে যে, অতীতে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিরুদ্ধে আইনি প্রতিরোধ ব্যবস্থা যদি কঠোরভাবে কার্যকর করা যায়নি। যদি যেত, তা হলে দেশে বর্তমানে যে অবাঞ্ছিত সাম্প্রদায়িকতার উগ্র পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তা এড়ানো যেত।

কারণ, এ সত্য আমাদের সকলেরই জানা- বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। এখানে অন্য ধর্মাবলম্বীদের ওপরে বিভিন্ন সময়ে হামলা এবং সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, এ কথা সত্য, কিন্তু তা সবসময়ই ঘটিয়েছে ধর্মান্ধ একটি চিহ্নিত চক্র। যারা মোট জনসংখ্যার অত্যন্ত সংখ্যালঘু একটি অংশ।

এরা পাকিস্তান আমলেও সাম্প্রদায়িকতা আর ধর্মান্ধতাকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে, এখনও করছে। অপরাধীরা সংখ্যায় যত কমই হোক তারাই কিন্তু বড় বড় বিপর্যয় ঘটায়। সুতরাং ধর্মের রাজনীতি করা এই সংখ্যালঘু সাম্প্রদায়িকদের প্রতিরোধে সংঘবদ্ধ প্রয়াস জরুরি। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ ধর্মানুরাগী, তারা ধর্মান্ধ নয়। সংখ্যালঘু ধর্মান্ধরাই বিপদের কারণ।

১৯৭১এর মহান মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর পর্যবেক্ষণ করলেও ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িকতা ছড়িয়ে দেয়া এই চক্রটির স্বরূপ উদঘাটন করা যায়। বঙ্গবন্ধুর জীবনব্যাপী সাধনায় মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা এই চক্রটিকে পরাজিত করেছিলাম। কিন্তু সেই পরাজয় চিরস্থায়ী করা গেল না।

তা ১৯৭৫ পর্যন্তই টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছিল রক্তার্জিত বাংলাদেশ। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ফিরে যায় আবারও সেই পাকিস্তান আমলের ধর্মান্ধ রাজনীতি তথা সাম্প্রদায়িকতায়!

বাংলাদেশের গত ৪৫ বছরের রাজনৈতিক লড়াই সে কারণেই নিরন্তর সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। আমাদের দুর্ভাগ্য এই যে, ৩০ লাখ শহিদের রক্তের বিনিময়ে এই সাম্প্রদায়িকতার অন্ধকার থেকেই প্রগতির আলোয় আলোকিত একটি রাষ্ট্র আমরা অর্জন করেও কুচক্রীমহলের চক্রান্তে ধরে রাখা গেল না! এর জন্য দায়ী কারা?

এ প্রশ্নের উত্তরও সচেতন মানুষমাত্রেরই জানা। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তকারীরা শুধু বাংলাদেশের সরকারপ্রধান বঙ্গবন্ধুকেই সপরিবার হত্যা করেনি, তারা হত্যা করেছে মূলত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দর্শনকেও।

এ প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গেলে অনিবার্যভাবে এসে যায় রাজনৈতিক ইতিহাস এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাধনা। পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের শোষণ-বঞ্চনার হাত থেকে বাংলার মানুষকে মুক্ত করতে বঙ্গবন্ধুর সংগ্রাম শুরু হয়েছিল সাতচল্লিশের আগস্টের পর থেকেই। অর্থনৈতিক শোষণ বঞ্চনার পাশাপাশি ধর্মের নামে অপরাজনীতিমুক্ত একটি প্রগতিশীল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাও তার স্বপ্ন ছিল। এর বহু দালিলিক প্রমাণও আছে।

বঙ্গবন্ধু তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে লিখেছেন-

“জনগণকে ইসলাম ও মুসলমানের নামে স্লোগান দিয়ে ধোঁকা দেওয়া যায় না। ধর্মপ্রাণ বাঙালি মুসলমানরা তাদের ধর্মকে ভালোবাসে কিন্তু ধর্মের নামে ধোঁকা দিয়ে রাজনৈতিক কার্যসিদ্ধি তারা করতে দিবে না।” (পৃষ্ঠা ২৫৮)

শুধু আত্মজীবনীতে নয়, জনসভায়, বক্তৃতা-বিবৃতিতেও তিনি সবসময় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পক্ষে কথা বলেছেন। অর্থনীতিবিদ ড. আতিউর রহমানের একটি বইয়ের নাম ‘শেখ মুজিব বাংলাদেশের আরেক নাম’। ওই গ্রন্থের ২১৯ পৃষ্ঠায় তিনি বঙ্গবন্ধুর ১৯৭১ সালের ৩১ ডিসেম্বর দেয়া এক বক্তৃতার উদ্ধৃতি দিয়েছেন, যেখানে বঙ্গবন্ধু সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছেন-

“এদেশে ইসলাম, মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবই থাকবে এবং বাংলাদেশও থাকবে। হিন্দু ও বৌদ্ধদের ওপর গত এক দশক যে অত্যাচার হয়েছে তার অবসান হবে।”

বঙ্গবন্ধুর লিখিত এই এক দশক ১৯৬০ থেকে ১৯৭০ সাল।

সব ধর্মের মানুষের জন্য নিরাপদ একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র বঙ্গবন্ধু এনে দিয়েছিলেন কিন্তু সেই চেতনার বাংলাদেশ তো আমরা ধরে রাখতে পারলাম না!

স্বাধীনতার ৫০ বছরে তথা সুবর্ণজয়ন্তীর এই গৌরবময় ২০২১ সালে বসে পেছনে ফিরে তাকালে অনুতাপই জাগে- এই বাংলাদেশ কি আমরা চেয়েছিলাম!

পঁচাত্তরের পর থেকে বাংলাদেশে দিনে দিনে সাম্প্রদায়িকতা চরম রূপ লাভ করেছে। জেনারেল জিয়ার সরকার থেকে বেগম খালেদা জিয়ার সরকার আমল পর্যন্ত দুই দফা সামরিক শাসন আর নিষিদ্ধ জামায়াতসহ ধর্মান্ধ রাজনৈতিক দলগুলোকে সহযোগিতা দিয়ে বিকশিত হবার সুযোগ-সুবিধাই দেয়া হয়েছে। আর এর মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বাংলাদেশকে ধ্বংসের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তারই বিষফল আজ ভোগ করছে বাংলাদেশ।

কুমিল্লার পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন রাখার চক্রান্তের স্বরূপ উদঘাটিত হতে চলেছে। কোরআন শরিফ রেখেছিল যে ইকবাল, তাকে গ্রেপ্তার করার পর আদালত তাকে রিমান্ডে দিয়েছে। কারা ইকবালকে দিয়ে এ কাজ করিয়েছে, তাদেরও চিহ্নিত করা হচ্ছে।

গতকাল সন্ধ্যায় রাজধানীর তেজগাঁও কলেজে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, ‘সাম্প্রদায়িক হামলায় জড়িত সবাই চিহ্নিত হয়েছে। তারা আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়েছে। কেন এই ঘটনা ঘটিয়েছে তার সবকিছু আপনাদের জানাতে সক্ষম হবো ইনশাআল্লাহ।’

এদিকে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, অন্য ধর্মের নাগরিকদের সুরক্ষার জন্য আইন প্রণয়নের কথা ভাবছে সরকার। সাম্প্রতিক হামলায় জড়িতদের বিচার বিশেষ ট্রাইব্যুনালে করার কথাও জানান তিনি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ইতোমধ্যেই কঠোর বার্তা দিয়েছেন সাম্প্রদায়িকতার বিষদাঁত উপড়ে ফেলার জন্য। তিনি দেশ-বিদেশে বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়ায় চালানো ষড়যন্ত্রমূলক অপপ্রচারের পরিস্থিতিও তুলে ধরেছেন।

এদিকে চট্টগ্রামে আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা রোববার সাম্প্রদায়িক হামলার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিল-সমাবেশ করেছেন। নিঃসন্দেহে এর সবকিছুই আমাদের মনে আশা জাগায়। কিন্তু সবচেয়ে বড় প্রয়োজন যেটা তা হলো আওয়ামী লীগের পাশাপাশি ধর্মান্ধ রাজনৈতিক দল ছাড়া সব প্রগতিশীল শক্তির ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করি।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দেশব্যাপী তৃণমূল পর্যায় থেকে জনসাধারণের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে জনমত গঠন- কার্যক্রম গ্রহণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। দেশের তৃণমূল পর্যায়ের সংস্কৃতি- কর্মীদেরকেও এ কাজে এক প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসা জরুরি। বাংলাদেশ যে সত্যিকার অর্থেই অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র, সেই সত্য চিরস্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠা করা ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর নেই।

সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে যারা দেশে সাম্প্রদায়িকতার আগুন ছড়িয়ে দিতে চায়, তাদের বিরুদ্ধে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করেই প্রতিরোধমূলক কার্যক্রম ক্ষমতাসীন দলকে দেশ-বিদেশে সক্রিয়ভাবে গ্রহণ করতে হবে। কারণ কাঁটা দিয়েই কাঁটা তুলতে হয়।

লেখক: কবি ও সিনিয়র সাংবাদিক, উপদেষ্টা সম্পাদক দৈনিক দেশের কণ্ঠ। সাবেক পরিচালক (বার্তা) বাংলাদেশ টেলিভিশন।

এ বিভাগের আরো খবর