বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ছোট সংখ্যার ভয়

  • খান মো. রবিউল আলম   
  • ২৪ অক্টোবর, ২০২১ ১২:৫৪

শ্রেষ্ঠত্বের অনুভব ব্যক্তিকে সহিংস করে তোলে, তাকে করে তোলে একরৈখিক। একরৈখিকতা এক ধরনের প্রতিবন্ধিতা। কারণ, যুক্তির বিপরীতে যিনি বিশ্বাসের ঘরে বসত গাড়েন তিনি মূলত পার্থিব ও অপার্থিব পুরস্কারের সাধনা করেন। এ লোভ তাকে হীন করে। এ হীনতা বা নীচুতা খুব নিম্নস্তরের বিষয় সেটি বোঝার বুদ্ধিবৃক্তিক সক্ষমতা তার থাকে না। সুকৌশলে সেই শক্তিটা লোপ করে দেয়া হয়। কড়া বিশ্বাসের রসায়নে মস্তিষ্ক প্রক্ষলিত করা হয়। এ ধরনের মস্তিষ্ক প্রক্ষালনের বিষয় হিরক রাজার দেশে সত্যজিৎ রায় দেখিয়েছেন।

অর্জুন আপ্পাদুরাই গ্লোবাল স্টাডিজের বিশ্বখ্যাত তাত্ত্বিক। তিনি ভারতীয় বংশোদ্ভূত। পড়ান নিউইয়ার্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে। আপ্পাদুরাইয়ের Fear of Small Numbers অর্থাৎ ছোট সংখ্যার ভয় শিরোনামে একটি অসাধারণ বই রয়েছে। খুব ধারালো বই, পরিচ্ছন্ন চিন্তার স্মারক। ছোট সংখ্যা কীভাবে আমাদের তাড়িয়ে বেড়ায় তাই এ বইয়ের অন্যতম উপজীব্য।

আপ্পাদুরাইয়ের বিশ্লেষণ দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দেয়ার মতো। তিনি খুব সহজ করে বলেছেন- মানুষ মূলত ছোট সংখ্যা দেখে ভয় পায়। ছোট সংখ্যা বড়দের ভয়ের অন্যতম কারণ। বড় সংখ্যা কেবল বড় সংখ্যা দেখে ভয় পায় না, ছোটদের দেখেও ভয় পায়।

মনে রাখতে হবে কেউ ভয় না পেলে অন্যকে ভয় দেখায় না। ভয়ের সংস্কৃতির ভেতর রয়েছে আরেকটি ভয়ের দীর্ঘ ছায়া। ভয় প্রর্দশন ও ভয়-সংস্কৃতির পেছনে কাজ করে বিশেষ রাজনীতি।

এ রাজনীতি হলো একক হওয়ার রাজনীতি। হয় মুসলিম, না হয় হিন্দু না হয় বৌদ্ধ। অন্যদের নিশ্চিহ্ন করে এক বিশ্বাস, এক দৃষ্টিভঙ্গি, এক ধর্ম ও সংস্কার প্রতিষ্ঠা বা সুপ্রিমেসি দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে ঘৃণ্য তৎপরতা।

নিজের ধর্ম, নিজের বর্ণ, নিজের রাজনৈতিক বিশ্বাস, নিজ কমিউনিটি, নিজপেশা এবং নিজদেশ শ্রেষ্ঠ আর বাকিগুলো অপাঙক্তেয় বা অগ্রহণযোগ্য এমন বিশ্বাসের চেয়ে অশ্লীল মনোভঙ্গি আর কিছু হতে পারে না।

শ্রেষ্ঠত্বের অনুভব ব্যক্তিকে সহিংস করে তোলে, তাকে করে তোলে একরৈখিক। একরৈখিকতা এক ধরনের প্রতিবন্ধিতা। কারণ, যুক্তির বিপরীতে যিনি বিশ্বাসের ঘরে বসত গাড়েন তিনি মূলত পার্থিব ও অপার্থিব পুরস্কারের সাধনা করেন। এ লোভ তাকে হীন করে।

এ হীনতা বা নীচুতা খুব নিম্নস্তরের বিষয় সেটি বোঝার বুদ্ধিবৃক্তিক সক্ষমতা তার থাকে না। সুকৌশলে সেই শক্তিটা লোপ করে দেয়া হয়। কড়া বিশ্বাসের রসায়নে মস্তিষ্ক প্রক্ষলিত করা হয়। এ ধরনের মস্তিষ্ক প্রক্ষালনের বিষয় হিরক রাজার দেশে সত্যজিৎ রায় দেখিয়েছেন।

আজ দেশজুড়ে শ্রেষ্ঠ বিশ্বাসের বীজ বোনা হচ্ছে। যে বীজ বোনা হবে তার তো চারা গজাবে। এটাই স্বাভাবিক। সহাবস্থানের জন্য দরকার বহুমুখী ও বৈচিত্র্যময় দৃষ্টিভঙ্গি। কী দিয়ে তৈরি হবে দৃষ্টিভঙ্গি। কার মধ্যে রয়েছে সেই অন্তর্ভুক্তিমূলক দৃষ্টিভঙ্গি নির্মাণের মহৌষধ।

শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতি সমন্বয়ে গড়ে ওঠা গ্রহণোন্মুক্ত এক সংকর সংস্কৃতির মধ্যে। কিন্তু সেই পথ তো আজ মসৃণ নয়। নানাভাবে তা সংকুচিত। প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চশিক্ষার সর্বস্তরে নেই বৈচিত্র্যের কোনো সুগন্ধিচন্দন।

কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের ভাষায়- আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা হয়ে উঠেছে গল্পের দানবের মতো। এর ভেতরের খোলসটা এতো বড় যে মুখ দিয়ে ঢুকে সারা পেট ঘুরে আসলে কোথাও স্পর্শ হবে না।

আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাও ঠিক এমনই- শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পার হয়ে যাবে কিন্তু শিক্ষা কী সেই বিষয়টি স্পর্শ করবে না। শিক্ষালয়গুলো হয়ে উঠছে বৈচিত্র্য নির্মাণের পরিবর্তে বিশ্বাস উৎপাদনের কারখানা। কেবল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয় গোটা সামাজিক ব্যবস্থা দাঁড়িয়েছে বিশ্বাসের পক্ষে।

যেকোনো বিশ্বাসের মূল সমীবদ্ধতা হলো এর ভেতর অন্য বিশ্বাস বাস করতে পারে না, বা শ্রদ্ধান্বিত হতে পারে না। বিশ্বাস মানেই একক ব্যাপার। আবার বিশ্বাস মানেই বিভক্তি। বিশ্বাসের একটি বিশেষ দিক হলো- পিওর বিশ্বাস বলে কিছু নেই। ব্যক্তি একটি বিশ্বাসের সাধারণ স্কিমে বিশ্বাস করে আবার তার মধ্যে অনেক ধরনের ছোট ছোট ভিন্ন ধরনের বিশ্বাস ও সংস্কার থাকে।

বিশ্বাস মানেই যে এক নিরাপদ শীতল ছায়া তা নয়। যেমন কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতি আনুগত্য শেষ কথা নয়। কে কার গ্রুপের অনুসারী পরবর্তী পর্যায়ে তা মুখ্য ওঠে। একক ধর্মীয় বিশ্বাস শেষ কথা নয়। এরপর প্রশ্ন আসে কে কোন তরিকা বা মাযহাবের। বিশ্বাসের ভেতর রয়েছে বিযুক্তির গাঢ় রসদ যা মূলত নিশ্চিহ্নকরণ প্রক্রিয়ার মূল জ্বালানি। বিশ্বাস মানেই বদ্ধতা।

বিশ্বাস অপ্রয়োজনীয় প্রদর্শনবাদ উৎসাহিত করে। আর এজন্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্প্রসারণ ও শ্রীবৃদ্ধিতে তথাকথিত বিশ্বাসীদের বিশেষ তৎপরতা লক্ষ্ করা যায়। প্রখ্যাত সাংবাদিক এবিএম মূসা জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সেমিনারে দুঃখ করে বলেছিলেন- যেখানকার প্রেসক্লাবের শ্রী যত সুন্দর সেখানকার সাংবাদিকতার মান তত নিম্ন।

জনগণ আদর্শিক অর্থে যথেষ্ট ধার্মিক না হলেও ধর্মকে কেন্দ্র করে দেখানোর ব্যাপারে সে খুব তৎপর। ধর্মের আচারসর্বস্ব ব্যাপারকে সে বেশ অগ্রাধিকার দিচ্ছে। সংস্কৃতি অধ্যয়নের পণ্ডিত জেমস ডাব্লিউ ক্যারে তার Communication as Culture-বইতে যোগাযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এ প্রবণতার ব্যাখ্যা করেছেন। একে তিনি বলেছেন- যোগাযোগের ট্রান্সমিশন অ্যান্ড রিচুয়ালভিউ। জনগণ আজ ধর্মের স্পিরিচুয়াল দিকের চেয়ে আচারসর্বস্ব দিকের প্রতি অধিক মনোযোগী হয়ে উঠছে, যা তাকে সহিংস হতে প্রণোদনাও জোগাচ্ছে।

বিশ্বাসের বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছে যুক্তি। যুক্তি হলো বহুমাত্রিক ব্যাপার। যুক্তি মানেই সংযুক্তি। গ্রহণোন্মুক্ত এক মনোভঙ্গি। বিশ্বাসের বিপরীতে যুক্তিনির্ভর আধুনিক জনমানস আমরা গড়তে পারিনি। সমালোচনাত্মক মনোভঙ্গিসম্পূর্ণ জনসমাজ নেই। বাংলাদেশ বিশ্বাসের ঘনগ্রাম।

বাঙালির সংস্কৃতিতে সব মত ও পথের যে সম্মিলনশক্তি ছিল তা লোকজগায়ক, চিন্তক ও সাধকেরা লালন ও ধারণ করতেন তা ক্ষীণ হতে হতে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। সবাই মিলে এক বিশ্বাস ও এক দৃষ্টিভঙ্গি নির্মাণের প্রকল্পে ঝাঁপিয়ে পড়েছি। যার মূল প্রেরণা কেবল সংখ্যাধিক্যেরা থাকবে, ছোট সংখ্যা নয়।

মোট জনসংখ্যার ৫-১০ ভাগ ভিন্ন জাতিগোষ্ঠী ও ভিন্ন ধর্মের। এ সংখ্যা নিয়ে আজ বড় সংখ্যার ভয়ের শেষ নেই। অনেকে এ সংখ্যাটিকে মানচিত্র থেকে তুলে দিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ সংখ্যা বানাতে চায়। অর্থাৎ একশ হতে চান। ছোট সংখ্যা বড়র মধ্যে নানারকম অস্বস্তি তৈরি করে। এর পেছনে রয়েছে বড় সংখ্যার অসম্পূর্ণতার অনুভব। অর্থাৎ সংখ্যাধ্যিকের ধর্ম, বিশ্বাস এবং ভাষা এবং মূল্যবোধই কেবল বেঁচে থাকবে।

অন্যদের উপস্থিতি তা যত নগণ্য হোক থাকবে না। বড় সংখ্যারা এভাবে ছোটদের দ্বারা তাড়িত হচ্ছে। বড় সংখ্যাই মূলত ভীত হয়ে পড়ছে। ছোট সংখ্যার উপস্থিতি তাকে অস্থির করে তুলছে। এ বড়করণ সংস্কৃতির আরেক নাম প্রান্তিকীকরণ। অর্থাৎ ঠেলতে ঠেলতে একেবারে কোণায় চেপে ধরা। যেখানে সহনশীল শাসন থাকে না কর্তৃত্ববাদী বা লোকরঞ্জনবাদী কাঠামো বিদ্যমান, সেখানে এ ধারা প্রবল হবে এটাই বাস্তবতা।

এমন কর্তৃত্ববাদী কাঠামোয় যেসব প্রতিষ্ঠান ছোটদের গিলে ফেলার অপচর্চাকে মদদ দেয় রাষ্ট্র তার মধ্যে অন্যতম। রাষ্ট্রীয় মেশিনারিজ ব্যবহার করে স্বার্থবাদী কায়েমি গোষ্ঠী কখনও সজোরে কখনওবা নীরবে ছোটদের খেয়ে ফেলার চেষ্টা করে।

Laurent Gayer & Chirstophe Jaffrelot-এর যৌথ সম্পাদনায় Muslims in Indian Cities: Trajectories of Marginalisation বইয়ে শুরুর অধ্যায়ে জাস্টিস রানজিনদার সাচারের একটি উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছেন যার বাংলা অর্থ হলো- “একটি রাষ্ট্র কতটুকু সভ্য তা যাচাইয়ের অন্যতম মাপকাঠি হলো সেই রাষ্ট্র ক্ষুদ্রজাতি সত্তাকে কতটুকু বিশ্বাস ও আস্থার সঙ্গে নিতে পারে।”

ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং জাস্টিস রানজিনদার সাচারের নেতৃত্বে ভারতের মুসলিমদের প্রান্তিকীকরণ চিত্র বোঝার জন্য একটি কমিশন গঠন করেন। ভারতীয় মুসলিমদের প্রান্তিকীকরণের যে চিত্র কমিশন উন্মোচন করেছে তা কেবল বেদনাদায়ক নয়; নির্মমও বটে।

ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে একটি সম্প্রদায়কে ঠেলতে ঠেলতে কোন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যায় সাচার কমিশন তা নিষ্ঠার সঙ্গে তুলে ধরেছে। সালমান খুরশিদের At Home in India: The Muslim Saga বইতেও একইধরনের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।

বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে একইচিত্র লক্ষ করা যায়। কেবল হিন্দু সম্প্রদায় নয়, সমতল ও পাহাড়ের আদিবাসীদের প্রান্তিকীকরণে তৈরি হয়েছে অনন্য নজির।

গত বছর দুয়েক আগে রাঙ্গামাটিতে এক প্রশিক্ষণে গিয়ে নতুন অভিজ্ঞতা হয়েছে। একজন আদিবাসী নারী প্রশিক্ষণের একপর্যায়ে বললেন, তারা যথেষ্ট সুন্দর নয়। গণমাধ্যমে তারা যে মডেল দেখছেন তাতে তাদের নিজেদের আর সুন্দর মনে হচ্ছে না। ‘আমি যথেষ্ট সুন্দর নেই’ এমন বোধ জাগিয়ে তুলে পরিচয়ের ক্ষেত্রে নতুন সংকট তৈরি করা হচ্ছে যা মূলত সমরূপী সমাজ নির্মাণ প্রক্রিয়াকেই ত্বরান্বিত করবে।

যেখানে কোনো বৈচিত্র্য থাকবে না। দোকানে সাজানো পণ্যসমাহার দেখে বনরূপা বাজারকে রাজশাহীর সাহেব বাজার মনে হয়েছে। পণ্য কেবল পণ্য নয় মূল্যবোধের প্রতিনিধি। জনপরিসরে বড় সংখ্যার অপ্রয়োজনীয় বৃহৎ উপস্থিতিও চোখে পড়ে, সচরাচর পড়ল। বৃহৎ অথচ অপ্রয়োজনীয় বড়দের এ উপস্থিতি ছোটদের মনে ভয় জাগায়। একলাকরণ প্রক্রিয়াকে গতিশীল করে।

সমকালীন রাজনীতির ইতিহাস হলো ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রান্তিকীকরণের ইতিহাস। চার্লস ডারউইন সেই বিখ্যাত উক্তি, Survival of the Fittest অর্থাৎ যোগ্যরাই টিকে থাকবে মানে সংখ্যাধিক্য, শক্তি ও ক্ষমতা টিকে থাকবে; মানে ছোট সংখ্যা, শক্তি ও ক্ষমতাহীনরা টিকে থাকবে না?

সমকালীন বিবর্তনবাদী জীববিজ্ঞানী রিচার্ড ডওকিন বলছেন, পরার্থবোধ এ জগৎ-সংসার টিকিয়ে রেখেছে, মানুষকে বেঁচে থাকতে হলে পারস্পরিক সহযোগিতা প্রযোজন, প্রয়োজন সহাবস্থানের যূথবদ্ধ চেতনা। ‘লাইফ অব পাই’ মুভির শেষ উক্তি ডোন্ট লুজ হোপ অর্থাৎ আশা হারাবেন না। ছোট সংখ্যা কারো অনুগ্রহে নয়, বেঁচে থাকবে তাদের সৌন্দর্য ও জীবনীশক্তি নিয়ে। আর তা না হলে পৃথিবীর যে মৌলিক চরিত্র বৈচিত্র্য তা তো পড়বে গভীর সংকটে।

ছোট ও বড় সংখ্যার সহাবস্থানের জন্য মানবিক, জনকল্যাণমূলক ও কার্যকর রাষ্ট্রের ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না।

লেখক: যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ, প্রাবন্ধিক।

এ বিভাগের আরো খবর