গতকাল ২০ অক্টোবর ছিল লক্ষ্মীপূজা, ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী, প্রবারণা পূর্ণিমা; একদিনেই। এই একদিনে তিনটি ধর্মীয় উৎসব পালন এদেশেই সম্ভব। কেননা, তিন ধর্মের মানুষ যুগ যুগ ধরে এদেশে সহাবস্থান করছে। এর চেয়ে অসাম্প্রদায়িক চেতনা আর কী হতে পারে! আমরা সবাই একসঙ্গে মিলে উৎসব পালন করছি। তবে এবার বড় বেদনাহত হয়ে আমরা দুর্গোৎসব পালন করেছি। দেশের ‘সংখ্যালঘু’ হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন ভীতসন্ত্রস্ত।
আমরা বীরের জাতি। বাঙালি জাতি কোনো সাম্প্রদায়িক শক্তিকে ভয় পায় না। কুমিল্লার নানুয়ার দীঘির পাড়ে পূজামণ্ডপে কোরআন শরিফ রাখা নিয়ে যে ঘটনা ঘটেছে, আমি হতবাক হয়েছি। আমি ভয় পেয়েছি। আমার ভয়টা অন্য জায়গায়। আবার না জানি কার বাড়ি-ঘরে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে! কোন মায়ের বুক খালি হবে। মায়ের আর্তচিৎকারে জন্মভূমি কেঁপে উঠবে। এখন ভয় নিত্যদিনের সঙ্গী হয়েছে।
পত্রিকায় দেখলাম, মানুষ সবকিছু হরিয়ে কপালে হাত দিয়ে বসে আছে। রংপুরের পীরগঞ্জে চারদিকে পোড়া গন্ধ। মাটি পুড়ে লাল হয়ে গেছে। কিন্তু পোড়েনি সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর হৃদয়। বাচ্চারা ভাতের অভাবে তাকিয়ে আছে। কিন্তু মন গলেনি সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর। বরং সাম্প্রদায়িক শক্তির বীভৎস রূপ ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। হিন্দুদের মণ্ডপ, বাড়ি-ঘর, নারী ও লুটপাট এখন তাদের টার্গেট।
এরাই জামায়াত-বিএনপি আমলে মা-মেয়েকে ধর্ষণ করেছে। মায়ের সামনে মেয়েকে অপমান করেছে। সুখের সংসারে আগুন জ্বালিয়ে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে অনেক পরিবারকে। কিন্তু কান্না শোনার যেন কেউ নেই।
গত ১৩ অক্টোবর কুমিল্লার নানুয়ার দীঘির পাড়ে পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন অবমাননার অভিযোগে এনে হামলার ঘটনাকে ধিক্কার জানানোরও ভাষা নেই। শুধু হামলা নয়, ভাঙচুর, খুন, লুটপাটসহ এমন কোনো ঘটনা নেই, যা ঘটেনি। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকজন কী করছিলেন? সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা রয়েছে। এই সংস্থাগুলো কী করছিল?
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা কী করছিলেন জানি না। তারা যদি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি বুকে নয়, মুখে বলে তাহলে কিছু বলার আছে। কিন্তু যদি অসাম্প্রদায়িক চেতনার কথা বলেন। আর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় মুখ বুজে পড়ে থাকেন, তাহলে আপত্তি আছে। তার মানে বুঝতে হবে চেতনায় মরিচা ধরেছে। এতো গেল কুমিল্লার ঘটনা। কিন্তু পরে নোয়াখালীর ঘটনাকে আরও বেশি নাড়া দিয়েছে। অন্তত সরকার ও প্রশাসনের সজাগ থাকলে এমন পরিস্থিতি হতো না। এখানে সরকারের গাফলতি রয়েছে। রয়েছে প্রশাসনের উদাসীনতা।
নোয়াখালী মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যতম ঘাঁটি। অনেক বড় মানুষের জন্ম। তাদের সন্তানরা আজকে স্থানীয় প্রতিনিধি সেখানে এমন ঘটনা কীভাবে ঘটল সেটা বোধগম্য নয়। যেখানে ত্যাগী আওয়ামী লীগের নেতারা রয়েছেন। তাদের ত্যাগ-তিতিক্ষাকে কেন্দ্র করে আজ সেখানে আওয়ামী লীগ বিভক্ত। আপনারা বিভক্ত হন, আর অবিভক্ত থাকেন, সেটা বড় কথা নয়। কিন্তু তার চেয়ে বড় কথা, আপনারা অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাস করেন। তাহলে নোয়াখালীতে এমন দুঃখজনক ফটনা ঘটে কীভাবে?
রংপুরের পীরগঞ্জ। জানা মতে, শান্তিপ্রিয় এলাকা। এলাকায় জেলেপল্লিতে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। গোয়ালের পশু পর্যন্ত রেহাই পায়নি। মানুষের গোলার ধান, ঘরের টিনসহ সব কিছু পুড়ে ছাই হয়েছে। আর সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী তালি দিয়েছে। প্রশাসন ঘটনা শেষ হওয়ার পর সেখানে যাচ্ছে। প্রশাসনকে জানানোর পরেও তারা ঘটনার অনেক পর সেখানে উপস্থিত হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তাহলে কি প্রশাসনের মধ্যেও গলদ আছে?
গত ১৩ বছর ধরে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায়। কিন্তু এই ১৩ বছরেও প্রশাসন অসাম্প্রদায়িক কি না প্রশ্নসাপেক্ষ। সেখানে অজ্ঞাত অসংখ্য মানুষের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ইতোমধ্যে অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ জন্য সরকারকে ধন্যবাদ জানাই। কিন্তু এতদিনে হিন্দুদের ওপর যতগুলো হামলা হয়েছে, তার কটির বিচার মানুষ দেখতে পেয়েছে? হয়নি বললেই চলে।
মামলা হয়। গ্রেপ্তার হয়। কদিন পর জামিনে বেরিয়ে আসে। কিন্তু ভুক্তভোগী বা ক্ষতিগ্রস্তরা বিচার পায় না। এবারও মামলা হয়েছে। গ্রেপ্তার হয়েছে। কদিন পর হয়তো ছেড়ে দেয়া হবে। বিচার হবে কি না সেট আরও দূরের বিষয়। কারণ সরকারের ইচ্ছে থাকলেও প্রশাসনসহ বিচারকাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত প্রতিটি জায়গায় সাম্প্রদায়িক শক্তি রয়েছে। যেখান থেকে সরকার চাইলেও বের হয়ে আসতে পারছে না কেন সেটা উদঘাটন জরুরি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর কন্যা। তাই এদেশের মানুষের তার প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা অনেক বেশি। এই বিশ্বাস ও আস্থা যেন উবে না যায়। এদেশের ‘সংখ্যালঘু’রা সব সরকারের আমলেই মার খায়। কিন্তু শেখ হাসিনার আমলে মার খাবে, এটা ভাবতে অবাক লাগে।
গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার পার্শ্ববর্তী এলাকা আগৈলঝাড়া, গৌরনদী। সেখানে হিন্দুদের বাড়িতে হামলা করা হয়েছিল। মায়ের সামনে মেয়েকে ধর্ষণ করা হয়েছিল। মন্দিরে হামলা ভাঙচুর করা হয়। কিন্তু তার কতটুকু বিচার হয়েছে আজও জানি না। সেটা ছিল বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমল। বিএনপির সঙ্গে ছিল জামায়াতে ইসলামী। কিন্তু আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার। ফলে জনগণ আশার আলো একটু বেশি দেখতে চাইবে, এটিই স্বভাবিক। কিন্তু সেই ‘গুড়ে যদি বালি’ পড়ে, এর চেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে!
যুগে যুগে ‘সংখ্যালঘু’রা মার খাবে, এটা হতে পারে না। অপরাধীদের এমন শাস্তি দিতে হবে যাতে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে।
লেখক: সাংবাদিক