পাশ্চাত্য সমাজে নারীদেহের সূচিতার বিষয়টি প্রাসঙ্গিক নয়। মুসলিম অধ্যুষিত রাষ্ট্রে এবং মুসলিম সমাজে অবশ্য নারীদেহের শুচিতা একটি বড় বিষয়। একজন পুরুষ অনায়াসেই বহু নারীর সঙ্গে মেলামেশা করতে পারে। এতে সমাজের মূল স্রোতের সঙ্গে মিলতে তার কোনো সমস্যা হয় না। অথচ নারীর সামান্য পদস্খলনও সমাজ সহ্য করে না। পৃথিবীর ইতিহাসে নারীর সৌন্দর্যের পরিপ্রেক্ষিতে কী কী ঘটেছে এর অসংখ্য দৃষ্টান্ত আছে।
প্রাচীন ভারতীয় নগরবধূ আম্রপালি ছিলেন অসাধারণ সৌন্দর্য ও লাবণ্যে পরিপূর্ণ একজন নারী। বৈশালির রাজা মনুদেব আম্রপালির হবু স্বামী পুষ্পকুমারকে হত্যা করে এবং একটি সরকারি ঘোষণায় আম্রপালিকে বৈশালীর নগরবধূ হিসেবে ঘোষণা করে। এতে মনুদেবের রাজকোষ সমৃদ্ধ হয়।
ব্রিটেনের রাজা অষ্টম অ্যাডওয়ার্ড তার প্রেমিকা ওয়ালিস সিম্পসনের জন্য ১৯৩৭-এ সিংহাসন ত্যাগ করেন। মার্কিন পরিবারে জন্ম নেয়া ওয়ালিস সিম্পসন আকর্ষণীয় শারীরিক গঠন এবং ফ্যাশন সচেতন নারী ছিলেন। ‘স্বর্ণকেশী বোম্বশেল’ খ্যাত মেরিলিন মনরোর ভুবনমোহিনী সৌন্দর্যে বিমোহিত ছিলেন জন এফ কেনেডি। রীতিমত প্রণয় ছিল তাদের মধ্যে। কথিত আছে প্রেসিডেন্ট কেনেডি মাফিয়াদের প্রতি খড়গহস্ত হয়েছিলেন বলে, পরিকল্পিতভাবে তারা মেরিলিন মনরোকে খুন করে। এই নায়িকার হলিউডে পদার্পণ ছিল নিতান্ত আকস্মিক! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধচলাকালে একটি কারখানায় কাজ করার সময় মেরিলিন মনরো একজন ফাস্ট মোশন পিকচার ইউনিটের আলোকচিত্রীর ক্যামেরায় ধরা পড়েন এবং একজন পিন-আপ মডেল হিসেবে মনোনীত হন।
বাংলা সিনেমার সর্বকালের ধ্রুপদী সৌন্দর্যের অধিকারী নায়িকা সুচিত্রা সেন বিয়ের পর আর্থিক টানাপোড়েনের বেড়াজাল থেকে মুক্তি পেতে বাংলা সিনেমায় নাম লেখান। তিনি আজও বাঙালি নারী-পুরুষের অবচেতন মনে তার ব্যক্তিত্ব ও সৌন্দর্যের প্রদীপ জ্বালিয়ে রেখেছেন।
মাদক, অস্ত্র এবং নারী এক সূত্রে গাঁথা মালার মতো তিনটি শব্দ। এগুলো নিয়ন্ত্রণ করে আন্ডারওয়ার্ল্ড এবং মাফিয়াতন্ত্র। এসবের আমদানি হয় উন্নত বিশ্বের দেশগুলো থেকেই যখন তাদের গণতন্ত্র এবং জীবনযাত্রার মান বর্তমানের এই সুবেশী অবস্থায় ছিল না। পরে তা রপ্তানী হয় উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। আন্ডারওয়ার্ল্ডের সঙ্গে গোপন সম্পর্ক রেখেই বলিউডের সিনেমা জগৎ যাত্রা শুরু করে।
মাফিয়া ডন দাউদ ইব্রাহিম হাজি মস্তানকে হত্যা করে অপরাধ জগতের মুকুটহীন সম্রাট বনে যায়। একাধিক নায়িকার সঙ্গে তার সম্পর্ক নিয়ে নানা গুঞ্জন আছে। ‘রাম তেরি গঙ্গা মইলি’ খ্যাত মন্দাকিনীর সঙ্গে তাকে প্রকাশ্যে দেখা যায়। বলিউডে যারা পা রাখে তারা এসব বিষয়ে অবহিত হয়েই আসে। মমতা কুলকার্নি ড্রাগ মাফিয়া বিক্রম গোস্বামীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। হরর মুভি ‘ভিরানা’ খ্যাত নায়িকা জেসমিন ধুন্না দাউদ ইব্রাহিমের থাবা থেকে বাঁচতে সিনেমা জগৎ থেকেই অন্তর্হিত হন।
সম্প্রতি বলিউড বাদশা শাহরুখ খানের পুত্র আরিয়ানকে মাদক মামলায় গ্রেপ্তার করেছে ভারতের নারকোটিকস কন্ট্রোল ব্যুরো। বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে এবং একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে আজিজ মোহাম্মদ ভাই বাংলাদেশের সিনেমা জগতকে নিয়ন্ত্রণ করত। বহুগামীতা তার দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে একাকার হয়ে গিয়েছিল। মাফিয়া ডন দাউদ ইব্রাহিমের সঙ্গেও রয়েছে তার সখ্যতা। পরবর্তীকালে আজিজ মোহাম্মদ ভাই সপরিবারে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়।
আন্ডারওয়ার্ল্ড এবং মাফিয়াতন্ত্রে মদ, অস্ত্র এবং নারীকে পণ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সোনালী ত্রিভুজের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে নেশাজাতীয় দ্রব্যের যে চাষাবাদ, বিশ্বমোড়লদের সদিচ্ছা থাকলে এতদিনে তা নির্মূল হয়ে যেত। অস্ত্রের বিষয়ে বলতেই হয়- উন্নত বিশ্বের অনেক দেশের আয়ের প্রধান উৎস অস্ত্র বিক্রয়। অস্ত্র বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে তারা পরিকল্পিতভাবে পৃথিবীর নানা দেশে যুদ্ধ ও অস্থিরতা সৃষ্টি করে রাখে। আর আকর্ষণীয় নারীর উপস্থিতিতি মদ ও অস্ত্রের ব্যবসা সহজ করে তোলে।
বৈধ ও অবৈধ উপায়ে অর্থ এবং বিত্তের অধিকারী ব্যক্তিরা মদ ও নারীদেহের মধ্যে স্বর্গের সিঁড়ি খোঁজে। অসৎ উদ্দেশ্যে অনেকে উপঢৌকনও পাঠায়। সন্ত্রাসীরা মদ সেবন এবং অস্ত্র বেচাকেনার পাশাপাশি নারীসঙ্গও উপভোগ করে। এ আন্ডারওয়ার্ল্ডে যেসব নারী এবং পুরুষ একবার প্রবেশ করে তারা সাধারণত আর বের হতে পারে না।
অর্থ, খ্যাতি, বিদেশ ভ্রমণ এবং বিলাসী জীবনে এরা অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। এত সহজ পথে আত্মপ্রতিষ্ঠার ওল্টো পৃষ্ঠায় কোন বিভীষিকা অপেক্ষা করে তা ভাবার প্রয়োজন মনে করে না। যদি গত দুবছরের দিনলিপির সন্ধান করি তাতেই অনেক আলোকিত অন্ধকার আমাদের চোখমুখ ঢেকে দেবে।
পাপিয়া, সাবরিনা, সাহেদ, সম্রাট, জিকে শামীম, পদ্রীপ, পিয়াসা, মৌ, হেলেনা, রাজ, কাদের এবং পরীমনি প্রমুখ ব্যক্তিরা এ সমাজেই বেড়ে ওঠেছেন। বিশাল ছাতার নিচে হৃষ্টপুষ্ট হয়েছেন। হয়ত কোথাও কোনো অংক মেলেনি অথবা ক্ষণিকের কোনো ভুলে তারা পা ফসকে পড়ে গেছেন। পরীমনিকে মাদক মামলায় বার বার রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। উচ্চ আদালত রিমান্ড বিষয়ে নিম্ন আদালতের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছে। নানা দোলাচলের মাঝে আদালত পরীমনিকে স্থায়ী জামিন দিয়েছে এবং তার মামলাটি বিচারিক আদালতে পাঠানো হয়েছে।
লেডি দাবাং পাপিয়া যে অনৈতিক কার্যকলাপ বেশ কিছুদিন ধরে ওয়েস্টিন হোটেলে চালাচ্ছিল তা কি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা জানতেন না? শোনা যায় সেখানে সমাজের সব শ্রেণী-পেশার ব্যক্তিদের আনাগোনা ছিল। দুর্ভাগ্য যে তাদের বিষয়ে আমরা কোনোদিনই আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানতে পারব না।
বিত্ত, ক্ষমতা এবং পদবীর লেবাস শরীরে মুড়িয়ে তারা সদর্পে এ সমাজেই অবস্থান করছে এবং যে এ বিষয়ে সংবাদ পরিবেশন করে সেই ফটো সাংবাদিককে নিখোঁজ থাকতে হয়েছে, যেতে হয়েছে কারাগারে। কথিত মডেল পিয়াসা এবং মৌ গ্রেপ্তারের পর পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়- এরা ‘রাতের রানী’ নামে পরিচিত। প্রশ্ন জাগে- ‘রাতের রাজা’রা এখনও কেন গ্রীন রুমেই রয়ে গেল?
সম্প্রতি যেসব নারীকে মাদক, অস্ত্র এবং অন্যান্য অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয় এবং যাদের বিচার চলছে- তাদের পেছনে অদৃশ্য যে সুতোর টান আছে অর্থাৎ এই পুতুলদেরকে যারা নাচিয়েছে তাদের পরিচয় জানা এবং প্রকাশ করাটাও জরুরী। আসল হোতা এবং ভোক্তাদেরকে যদি শনাক্ত করা না হয় এবং তারা যদি আইনের ঊর্ধ্বাকাশে ওড়ে তবে এমন অনৈতিক কর্মকাণ্ড চলতেই থাকবে। নারীদের ‘স্কেপ গোট’ করে যারা বিত্ত এবং ক্ষমতার জোরে পার পেয়ে যাচ্ছে- তারা কি অপরাধী নয়? এটা অপরাধ দমনের পন্থা হতে পারে না। যেখানে আসল অপরাধীকে আড়াল করা হচ্ছে। অবশ্য দক্ষিণ এশিয়ার অপরাধমূলক রাজনৈতিক অর্থনীতিতে এটিই স্বাভাবিক।
ঠগবাজি করে অগাধ সম্পদের মালিক হয়ে এরা ক্ষমতার খুব কাছাকাছি পৌঁছে কেউকেটা বনে যায়। এরা যে বৃত্ত সৃষ্টি করে, সে বৃত্ত ভেদ করা মাঝেমধ্যে সরকারের পক্ষেও সম্ভব হয় না। আর কে না জানে কর্তৃত্ববাদী শাসনে অন্যায্য উচ্চাভিলাসী একটি গোষ্ঠিকে কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না। এ প্রসঙ্গে ফরাসী উপন্যাসিক বালজাকের উক্তিটি মনে পড়ছে- “আইন হচ্ছে মাকড়শার জালের মতো, ছোট কিছু পড়লে আটকে যায়, বড় কিছু পড়লে ছিঁড়ে বেরিয়ে যায়। আইন গরীবকে পিষে, আর ক্ষমতা আইনকে পিষে।”
যে কথাটি প্রায়ই শোনা যায়, ‘কেউই আইনের উর্ধ্বে নয়’। বাস্তবতা এই যে, সব নাগরিকের ক্ষেত্রে উপরোক্ত উক্তির বাস্তবায়ন দূর আকাশের তারার মতই অধরা রয়ে গেছে।
লেখক: শিক্ষক, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়।