গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোবাকো সার্ভে ২০১৭ অনুসারে- বাংলাদেশে ১৫ বছরের ঊর্দ্ধে ৩৫.৩% প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার করে। এর মধ্যে ৪৬% পুরুষ এবং ২৫.২% নারী। বিভিন্ন জনসমাগম ও পাবলিক পরিবহনে ধূমপান না করেও পরোক্ষভাবে ধূমপানের শিকার হচ্ছে বহু মানুষ। এই হার কর্মক্ষেত্রে ৪২.৭%, রেস্তোরায় ৪৯.৭%, সরকারি কার্যালয়ে ২১.৬%, হাসপাতাল বা ক্লিনিকে ১২.৭% এবং পাবলিক পরিবহনে ৪৪%।
বৈশ্বিকভাবে তামাকের ব্যবহার কমিয়ে আনার লক্ষ্যে ২০০৩-এর মে তে ৫৬তম বিশ্ব স্বাস্থ্য সম্মেলনে ফ্রেমওর্য়াক কনভেনশন অন টোবাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি) চুক্তি অনুমোদিত হয়। বাংলাদেশ এ চুক্তির প্রথম স্বাক্ষরকারী দেশ এবং ২০০৪-এ চুক্তিটিকে অনুসমর্থন করে। এর ধারাবাহিকতায় সরকার এফসিটিসির আলোকে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০০৫ (সংশোধিত ২০১৩) এবং ২০১৫ সালে এ সংক্রান্ত বিধিমালা প্রণয়ন করে।
৩০ থেকে ৩১ জানুয়ারী, ২০১৬ ঢাকায় অনুষ্ঠিত Summit on Achieving the Sustainable Development Goals শীর্ষক South Asian Speakers Summit এর সমাপনী অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০৪০-এর মধ্যে বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করার ঘোষণা দেন। দেশের ৭ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাতে এবং জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDG) এর স্বাস্থ্য সংক্রান্ত লক্ষ্য-৩ অর্জনে আন্তর্জাতিক চুক্তি এফসিটিসির বাস্তবায়ন ও তামাকজনিত ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় পদক্ষেপ গ্রহণের বাধ্যবাধকতা আছে।
মানীয় প্রধানমন্ত্রীর ২০৪০-এর মধ্যে দেশকে তামাকমুক্ত করার ঘোষণা বাস্তবায়ন কী স্বয়ংক্রিয়ভাবে হবে? নিশ্চয়ই তা নয়। কোনো সিদ্ধান্তই স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাস্তবায়িত হয় না। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ এবং আরও কিছু অনুসিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়।
এর আলোকেই তামাক বিরোধী সংস্থাগুলোর চেষ্টা এবং সরকারের স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের কার্যকর ভূমিকায় জানুয়ারী ২০২১-এ ‘স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন নির্দেশিকা’ প্রকাশিত হয়। স্থানীয় সরকার বিভাগের সব দপ্তর ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে (সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, জেলা পরিষদ, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ) নির্দেশিকাটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২মার্চ ২০২১-এ (স্মারক নং:৪৬.০০.০০০০.০৮৫.০৬.০৪২.২০১৮-১১৮) স্থানীয় সরকার বিভাগ কর্তৃক প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
তামাকজাত দ্রব্য যত্রতত্র ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ ও বিক্রয় সীমিতকরণে ‘স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন নির্দেশিকা’ একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। নির্দেশিকাটি ঠিকভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব হলে ২০৪০-এর মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ বাস্তবায়নে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন নির্দেশিকার ৮ এর ৮.১-এ বলা হয়েছে-
‘তামাকজাত দ্রব্যের বিক্রয়কেন্দ্র বা যেখানে তামাকজাত দ্রব্য ক্রয়-বিক্রয় হবে তার জন্য আবশ্যিকভাবে পৃথক ট্রেড লাইসেন্স প্রদান করা এবং প্রতি বছর নির্দিষ্ট ফি প্রদান সাপেক্ষে আবেদনের মাধ্যমে উক্ত ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন করা।’ লাইসেন্সিং ব্যবস্থা কার্যকর করার অর্থ শুধু বৈধতা প্রদান নয়। নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা।
বাংলাদেশে অনেক নিষিদ্ধ দ্রব্যের ক্ষেত্রে লাইসেন্সিং ব্যবস্থা চালু আছে যাতে সেগুলো নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকে। মদ বাংলাদেশে নিষিদ্ধ কিন্তু এর ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। সেকারণে এর নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের জন্য বিক্রেতা-ক্রেতা উভয়ের ক্ষেত্রে লাইসেন্স আরোপ করে সরকার। তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার একদিনেই বন্ধ করা সম্ভব নয় কিন্তু সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে চুড়ান্তভাবে অবশ্যই সম্ভব। যা বিশ্বের অনেক দেশ ইতোমধ্যে করে দেখিয়েছে। বাংলাদেশে সে সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্য এর ব্যবহার ও বিক্রি কমিয়ে আনতে হবে, আর সেজন্য অন্যতম পদক্ষেপ লাইসেন্সিং ব্যবস্থা।
বর্তমান অবস্থায় তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয়ে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। লাইসেন্সিং ব্যবস্থার উদ্যোগ এর বিক্রয়কে সীমিত করতে সাহায্য করবে। বিক্রয় সীমিত করা সম্ভব হলে ব্যবহারও কমে আসতে বাধ্য। লাইসেন্সিং এর বিষয়ে নির্দেশিকায় যেসব শর্তারোপ হয়েছে সেগুলোর প্রতিপালন যদি নিশ্চিত করা যায় তবে তামাকজাত দ্রব্যের (বিশেষ করে সিগারেট/বিড়ি) যত্রতত্র ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ ও বিক্রয় সীমিতকরণে সরাসরি প্রভাব পড়বে।
নির্দেশিকায় ৮-এর ৮.৪ এ বলা হয়েছে-
‘হোল্ডিং নাম্বার ব্যতীত কোনো প্রকার তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় কেন্দ্রকে লাইসেন্স প্রদান করা যাবে না। রাস্তার মোড়ে মোড়ে সিগারেট কোম্পানী কর্তৃক সরবরাহকৃত বক্স বসিয়ে, গলায় ঝুলিয়ে যারা সিগারেট বিক্রি করে সেটি আর করতে পারবে না। ফলে বিক্রয় কেন্দ্র সীমিত হয়ে আসবে, বিক্রি সীমিত হবে, সহজপ্রাপ্যতা বাধাগ্রস্থ হবে।’
নির্দেশিকায় ৮.৫-এ বলা হয়েছে-
‘সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের আশেপাশে ১০০ মিটারের মধ্যে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয়ের জন্য লাইসেন্স প্রদান করা যাবে না। তামাক কোম্পানীগুলোর অন্যতম টার্গেট থাকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আশেপাশে যাতে সিগারেট বিক্রি হয় সে ব্যবস্থা করা। তারা প্রধান ভোক্তা বানাতে চায় শিশু-কিশোর ও যুবকদের। কারণ তাদের একবার সিগারেট ধরিয়ে দিতে পারলে দীর্ঘমেয়াদী ভোক্তা তৈরি হয়ে যায়। গাইডলাইনের উল্লেখিত ধারা বাস্তবায়িত হলে তামাক কোম্পানীর এই অপতৎপরতাকে বাধাগ্রস্থ করা সম্ভব হবে।’
৮.৬ ধারা অনুযায়ী, জনসংখ্যার ঘনত্বের বিবেচনায় একটি এলাকায় লাইসেন্স ইস্যু করা হবে। এর মাধ্যমে বিক্রয় কেন্দ্র সীমিত হয়ে যাবে। বিক্রিও সীমিত হয়ে আসবে। সহজলভ্যতা অনেক হ্রাস পাবে।
লাইসেন্সিং ব্যবস্থা কার্যকরের মাধ্যমে একটি শহরে মোট কয়টি দোকানে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় হচ্ছে তার ডাটাবেজ তৈরি হয়ে যাবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে। ফলে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন কার্যকর করা সহজ হয়ে যাবে।
সাধারণ ট্রেড লাইসেন্স এবং পাশাপশি তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয়ের জন্য পৃথক লাইসেন্সিং ফি কার্যকর করার ফলে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয়ে বিক্রেতা নিরুৎসাহিত হবে। অর্জিত ফি’র অর্থ দ্বারা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান তামাক নিয়ন্ত্রণ অন্যান্য কার্যক্রম বাস্তবায়নে অর্থায়ন করতে পারবে।
তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয়ে লাইসেন্সিং ব্যবস্থা ইউরোপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারতের অনেক রাজ্য এবং নেপালেও অনেক আগে চালু হয়েছে। বর্তমানে ফিনল্যান্ড, হাঙ্গেরি, ফ্রান্স, ইতালী, স্পেন, অষ্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে লাইসেন্সিং ব্যবস্থা কার্যকর আছে। এর কার্যকারিতার প্রভাব ইতোমধ্যে এসব দেশে দেখা যাচ্ছে।
BMJ জার্নালে প্রকাশিত তথ্যানুসারে-
লাইসেন্সিং ব্যবস্থার কারণে ফিনল্যান্ডে পয়েন্ট অব সেলের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে ২৮%, ক্যালির্ফোনিয়া কাউন্টিতে ৩১% এবং হাঙ্গেরিতে ৮৩%। অস্ট্রেলিয়াতে লাইসেন্স ফি ১৩ ডলার থেকে বাড়িয়ে ২০০ ডলার করায় খুচরা বিক্রেতার সংখ্যা এক ধাক্কায় কমে গেছে ২৩.৭%। যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিসকোয় ৮% এবং ফিলাডেলফিয়ায় ৯.৮% হ্রাস পেয়েছে।
তামাকজাত দ্রব্যের বিক্রি সীমিতকরণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে লাইসেন্সিং ব্যবস্থা প্রভাব তৈরি করায় তামাক কোম্পানিগুলো বৈশ্বিকভাবে মরিয়া হয়ে নানা কূটকৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে। যাতে নতুন করে কোনো দেশে লাইসেন্সিং ব্যবস্থা কার্যকর না হতে পারে এবং যেসব দেশে কার্যকর হয়েছে সেখানে যাতে এটি কার্যকর না থাকতে পারে। ইউরোপের নরওয়ে ও স্কটল্যান্ডে লাইসেন্সিং ব্যবস্থা চালু করলেও কোম্পানীর কূটকৌশলে সেটি অকার্যকর হয়ে যায়।
বাংলাদেশেও তামাক কোম্পানী ইতোমধ্যে বিভিন্ন কূটকৌশল গ্রহণ করেছে। নীতিনির্ধারক মহলকে ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। তারা অনুধাবন করেছে লাইসেন্সিং ব্যবস্থা পরিপূর্ণভাবে কার্যকর হলে বিক্রি সীমিত হয়ে আসতে বাধ্য। কারণ দেশের বেশ কিছু পৌরসভায় লাইসেন্সিং কার্যক্রম শুরু হয়েছে এবং বিক্রি সীমিতকরণে যা ইতিবাচক প্রভাব তৈরি করছে। খুলনা বিভাগের সিটি কর্পোরেশনসহ ৯ টি জেলাসদর পৌরসভায় অসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান এইড ফাউন্ডেশনের তামাক নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পের সহায়তায় তামাক বিক্রেতাদের ডাটাবেজ তৈরি হয়েছে। এই তালিকা অনুসারে সংশ্লিষ্ট জেলার টাস্কফোর্স কমিটি তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন কার্যকর করার জন্য মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করছে। এটি সম্ভব হচ্ছে লাইসেন্সিং ব্যবস্থার কারণে।
স্থানীয় সরকার বিভাগের প্রতি আহ্বান, দেশের জনস্বাস্থ্য রক্ষায় এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা- ‘২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ’ বাস্তবায়নের জন্য তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয়ে লাইসেন্স ব্যবস্থাকে জোরদার করে তামাক কোম্পানীর কূটকৌশল প্রতিহত করতে হবে।
লেখক: উন্নয়ন কর্মী