আগামী ফেব্রুয়ারিতে শেষ হচ্ছে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ। নতুন কমিশন গঠনপ্রক্রিয়া নিয়ে এরই মধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে। নির্বাচন কমিশন গঠনপ্রক্রিয়ার জন্য আমাদের দেশে কোনো সুনির্দিষ্ট আইন নেই। তাই কথা উঠেছে একটি আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা নিয়েও।
কমিশন গঠনের জন্য সংবিধানে মোটা দাগে কিছু সুনির্দিষ্ট নীতিমালা বা গাইডলাইন দেয়া আছে। পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশের সংবিধানেই এরকম কিছু নীতিমালার কথাই বলা থাকে। এর ভিত্তিতেই গঠিত হয় নির্বাচন কমিশন।
দেশের সংবিধানে আছে, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অনধিক চারজন নির্বাচন কমিশনার নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন হবে। রাষ্ট্রপতি এই পাঁচজন নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগ করবেন এ উদ্দ্যেশ্যে প্রণীত একটি আইনের মাধ্যমে। কিন্তু আজ অবধি আমরা ওই আইনটি হাতে পাইনি।
বাস্তবতা হচ্ছে আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্য এরকম একটি আইন করা কঠিনই বটে। তড়িঘড়ি করে যাচাই-বাছাই ছাড়া আইন প্রণয়ন করা যেতেই পারে, কিন্তু তাতে আইনের উদ্দেশ্য সফল হয় না। উল্টো আইন নিয়েই প্রশ্ন ওঠে। তবে গণতন্ত্র ও সুষ্ঠু নির্বাচনেরও যে কোনো বিকল্প নেই সে বিষয়টিও আমাদের ভাবতে হবে।
বর্তমান কমিশনের মতোই যদি একটি কমিশন গঠন করা হয়, তবে সেই কমিশনের ওপর সব দলের আস্থা থাকবে কি না সেটি প্রশ্নসাপেক্ষ। নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থা রাখতে পারা একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের পূর্বশর্ত। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে নবগঠিত এই নির্বাচন কমিশনের অধীনেই। কাজেই এই কমিশনের ওপর আস্থার বিষয়টি আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সরকার সার্চ কমিটি গঠন করে সে কমিটির সুপারিশ করা ব্যক্তিদের নিয়েই কমিশন গঠন করতে চায়। এর মাধ্যমে সরকার মূলত নিরপেক্ষভাবে কমিশন গঠনের একটি বার্তা দিতে চায়। সন্দেহ নেই এটি একটি শুভ উদ্যোগ।
কারণ, বর্তমান সংবিধানের অধীনে এরকম কোনো সার্চ কমিটি গঠনের সুযোগ নেই। তবে সার্চ কমিটি গঠন যে সংবিধানের লঙ্ঘন সেটিও নয়। আসলে এ বিষয়ে সংবিধানে কিছু বলা নেই। আইন প্রণয়ন হলে সেখানে হয়তো কমিশনারদের নিয়োগপ্রক্রিয়া নিয়ে বিস্তারিত উল্লেখ থাকত। যদিও ভারতে প্রণীত আইনে নিয়োগপ্রক্রিয়া নিয়ে কিছু বলা নেই।
বর্তমান কমিশনও সার্চ কমিটির বাছাইকৃতদের নিয়েই গঠিত হয়েছে। রাষ্ট্রপতি সব দলের কাছ থেকেই তাদের প্রস্তাবিত প্রধান নির্বাচন কমিশনারের নাম চেয়েছেন। বর্তমান কমিশনে বিএনপির মনোনীত একজন কমিশনারও আছেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে শুধু একজন নির্বাচন কমিশনার, অথবা প্রধান নির্বাচন কমিশনার অথবা এমনকি শুধু নির্বাচন কমিশনের একার পক্ষেই কি একটি নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা সম্ভব? অন্তত আমাদের বিদ্যমান রাজনৈতিক বাস্তবতায়? নিরপেক্ষতার বিষয়টি তো শুধু নির্বাচন কমিশনের একার বিষয় নয়। আর কমিশনের নিরপেক্ষতার সঙ্গে সঙ্গে এর দক্ষতা, যোগ্যতা ও সাহসিকতার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ।
এ মুহূর্তে সার্চ কমিটি ছাড়া অন্যকোনো বিকল্প আছে কি? যাচাই-বাছাই করে একটি কার্যকর আইন প্রণয়নের সময়ও হাতে নেই। আইনমন্ত্রী যদিও বলছেন কোভিড সিচুয়েশনের জন্য আইন করা সম্ভব নয়। তিনি বলেছেন,কোভিড সিচুয়েশন ইমপ্রুভ করলে পুরো সংসদে আমরা সাড়ে তিনশ’ সদস্য বসতে পারব, বসে এই রকম একটা গুরুত্বপূর্ণ আইন পাস করতে পারব।’
কিন্তু আইন করার জন্য সংসদে তিনশ’ সদস্যের উপস্থিতি লাগে না। আইন পাসের জন্য সর্বনিম্ন সংখ্যাগরিষ্ঠতাই যথেষ্ট। মূল বিষয়টি হচ্ছে একটি বাস্তবসম্মত ও কার্যকর আইন প্রণয়ন করার মতো সময় হাতে নেই। এ আলোচনাটা আরও আগেই শুরু হতে পারত।
রাষ্ট্রপতি সার্চ কমিটি গঠন করে গেজেট নোটিফিকেশন জারি করেন। সংবিধান অনুযায়ী ‘নোটিফিকেশন’ ও আইনের মর্যাদাসম্পন্ন (১৫২ অনুচ্ছেদ)। কিন্তু তারপরও সার্চ কমিটি গঠন করা আইনের বিকল্প নয়। হলে অন্যান্য দেশও সার্চ কমিটি গঠন করেই কমিশন গঠন করত। কেউ আর আইন প্রণয়ন করত না। এর বিপরীতেও বলা যায়, আইন প্রণয়ন করলেই কি একটি নিরপেক্ষ কমিশন গঠন করা যায়, বা নিরপেক্ষ নির্বাচন করা সম্ভব?
ভারত ১৯৯১ সালে আইন করেছে। ১৯৯১-এর আগে কি তারা নিরপেক্ষ নির্বাচন করেনি? এখনও পৃথিবীর অনেক দেশেই নির্বাচন কমিশনের কোনো আইন নেই, তারা কি নিরপেক্ষ নির্বাচন করছে না? কাজেই শুধু আইন প্রণয়ন করেই নিরপেক্ষ, যোগ্য ও দক্ষ কমিশন গঠন করা যায় না, যায় না নিরপেক্ষ নির্বাচন করাও। নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সব দলের সদিচ্ছা বিশেষ করে সরকারের সদিচ্ছা জরুরি। এটি শুধু বাংলাদেশের জন্যই নয়, অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
রাষ্ট্র চালায় নির্বাহী বিভাগ। নির্বাহী বিভাগের ইচ্ছা অনুযায়ীই রাষ্ট্রের সব কাজ পরিচালিত হয়। এটাই আমাদের সংবিধানের বিধান। সংবিধান অনুযায়ী দেশে সংসদীয় শাসন বিদ্যমান। রাষ্ট্রপতির এখানে কার্যত তেমন কোনো ক্ষমতা নেই। প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছাই রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা।
প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ছাড়া অন্য সব দায়িত্ব পালনে তিনি প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছাধীন। কাজেই যে সার্চ কমিটি গঠনের কথা বলা হচ্ছে, তাও তিনি প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছার বাইরে গিয়ে করতে পারবেন না। কমিশনার নিয়োগতো পরের কথা। প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি ছাড়া সার্চ কমিটির সদস্যদের ঠিক করার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির নেই। এটাই সংবিধানের বিধান।
সার্চ কমিটিতে কারা থাকবেন সেটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ তারা চাইলে যে কাউকেই (গ্রহণযোগ্য) সুপারিশ করতে পারেন। সে সুপারিশ মানা না মানা প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছাধীন রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার বিষয়। তবে সার্চ কমিটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করতেই পারে। আর রাষ্ট্রপতিও যৌক্তিক কারণেই কমিটির বাছাইকৃত ব্যক্তিদের থেকে কমিশনার নিয়োগ দেবেন। ফলে, অনেক সীমাবদ্ধতা থাকলেও সার্চ কমিটি নিরপেক্ষভাবে কাজ করলে একটি গ্রহনযোগ্য সুপারিশ এলেও আসতে পারে।
স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত ১২ জন প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ পেয়েছেন। তাদের মধ্যে ৭ জনই ছিলেন বিচারপতি। বিচারপতি ও পঞ্চম প্রধান নির্বাচন কমিশনারের অধীনে ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন থেকেই দেশে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে বিতর্কের শুরু।
যদিও নিরপেক্ষ নির্বাচনের বিতর্কটি এখানে আরও আগের। ৯০-এর আগের নির্বাচন বিতর্ক যতটা না নির্বাচনকেন্দ্রিক তারচেয়েও বেশি ছিল শাসনতান্ত্রিক। কারণ, তখন দেশে গণতন্ত্রেরই উত্তরণ ঘটেনি। নির্বাচন বিতর্কতো আরও পরের কথা। ’৯০-এর পরে বিচারপতি এ. কে. এম সাদেক, মোহাম্মদ আবু হেনা, এম এ সাঈদ-এর অধীনে আমরা কয়েকটি সুষ্ঠু নির্বাচন পেয়েছি। এ নির্বাচনগুলো ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। বিচারপতি এম এ আজিজ থেকে আবার শুরু হয় নির্বাচন কমিশন নিয়ে বিতর্ক। এর পর শামসুল হুদা কমিশনের অধীনে আমরা ২০০৮-এর নির্বাচন পেয়েছি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলুপ্ত হওয়ার পর গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে আমরা পেয়েছি রকিবুদ্দিন ও নুরুল হুদা কমিশন। এই দুই কমিশনের অধীনে ২০১৪ ও ২০১৮ সালে পর পর দুইটি নির্বাচন হয়েছে। এ দুটি নির্বাচনের প্রেক্ষাপট ও অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিয়েই নতুন কমিশন গঠনের বিষয়টি গুরুত্ব দিতে হবে। কমিশন ও সরকারের মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমেই একটি সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে। অতীতের সুষ্ঠু নির্বাচনের ইতিহাস সে কথাই জানান দেয়।
সাংবিধানিকভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আর নির্বাচন করার সুযোগ নেই। কাজেই দলীয় সরকারের অধীনেই আমাদের সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ খুঁজতে হবে। যোগ্য, দক্ষ ও সাহসী কমিশন হলে দলীয় সরকারের অধীনেও নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ নির্বাচনের চেষ্টা অন্তত করতে পারে।
বিচারপতি আব্দুস সাত্তার ১৯৭০-এর নির্বাচনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ছিলেন। তিনি আওয়ামী লীগকে পছন্দ না করলেও আইনের বাইরে গিয়ে কোনো ভূমিকা রাখেননি। ফলে স্বাধীন নির্বাচনের পথ ধরেই স্বাধীন বাংলাদেশ আমরা পেয়েছি।
সার্চ কমিটি হোক। সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনও হোক। সেটি সরকারের নির্বাহী বিভাগের এখতিয়ার ও ইচ্ছার বিষয়। তবে রাষ্ট্রের আইন বিভাগ একটি বাস্তবসম্মত ও কার্যকর আইন প্রণয়ন করার কাজটিও যুগপৎ করে যেতে পারে। স্বাধীনতার ৫০ বছরেও ১১৮ অনুচ্ছেদে উল্লিখিত সেই আইনটি আমরা পাইনি। এটি সংবিধানের প্রতিও এক ধরনের অবজ্ঞা। এক এগারোকালীন শামসুল হুদা কমিশন নির্বাচন কমিশন আইনটি করার উদ্যোগ নিয়েছিল বলে জানা যায়। কিন্তু সে আইনটি আজ অবধি আর আলোর মুখ দেখেনি। আইন থাকলে সরকারের দায়ভারও কমে। আইনানুযায়ী কমিশন গঠন হবে ও আইনানুযায়ী কমিশন কাজ করবে। তাদের যোগ্যতা, অযোগ্যতা ও কর্মপরিধি সবই আইনানুযায়ী চলবে।
কমিশনের ক্ষমতা ও জবাবদিহিও বাড়বে। তবে কমিশন যেভাবেই গঠিত হোক না কেন তাদের সবচেয়ে বড় রক্ষাকবচ হচ্ছে সংবিধানের ১১৮ (৪) অনুচ্ছেদ-যার মাধ্যমে তারা দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকবেন এবং কেবল সংবিধান ও আইনের অধীন হবেন।
লেখক: আইনজীবী ও কলাম লেখক