তেভাগা আন্দোলনের কিংবদন্তি নেত্রী বিপ্লবী ইলা মিত্রের মৃত্যুবার্ষিকী আজ ১৩ অক্টোবর। ১৯ বছর আগে অর্থাৎ ২০০২ সালের এদিনে কলকাতায় ইলা মিত্র পরলোকগমন করেন।
শুরুর দিকে এই বিপ্লবী নারীর মৃত্যুবার্ষিকীর কোনো আয়োজন নাচোলে হয়েছে কি না জানা নেই। তবে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ধারাবিহকভাবে ‘আলোচনা সভা ও কাঙালি ভোজ’-এর আয়োজন করে আসছে রানী ইলা মিত্র সংসদ। বিশেষ করে সংসদের সভাপতি শ্রী বিধান সিং এ আয়োজনে তৎপর ও উদ্যোক্তা।
জানা গেছে, প্রথমবার তিনি নিজের গরু বেচেই মৃত্যুবার্ষিকীর আয়োজন করেছিলেন। তাদের আয়োজনে সংখ্যাগরিষ্ঠভাবে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সদস্যদের উপস্থিতি থাকে বেশি। অতিথি বা আলোচক হিসেবে অনেকেই যোগ দিয়েছেন। উল্লেখ্য, রানী ইলা মিত্র সংসদটি চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নাচোল উপজেলার নেজামপুরে অবস্থিত।
নাচোলের তেভাগা আন্দোলন তথা ইলা মিত্র নিয়ে অনেক লেখা আছে দেশ-বিদেশে। এ বিষয়ে নতুন প্রজন্ম কতটুকু জানে তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। জাতীয় রাজনীতিতেও অনেকটা বিস্মৃত তেভাগা আন্দোলন ও ইলা মিত্র। এর আগে তেভাগা কী, সেটা বলে নেয়া দরকার। ‘তেভাগা’ কিংবা ‘সাত আড়ি জিন’ দুটোই সমার্থক। তেভাগা বাংলার প্রতিটি মানুষ বুঝত। আর সাত আড়ি জিন ছিল আঞ্চলিক শব্দ। নিয়মটা ছিল- বিশ আঁটি ধান কাটা-মাড়াই ও ঝাড়াই করে জোতদারের গোলায় তুলে দিতে হবে। বিনিময়ে কৃষক মজুরি হিসেবে পাবে তিন আঁটি ধান। এটাই ছিল জিন কাটা।
এই তিন আঁটিতে মজুরি পোষাত না বলেই অনেক আগে থেকেই নাচোলের কৃষকদের মধ্যে বিক্ষোভ দানা বাঁধতে শুরু করলেও তা প্রশমিত হতে পারেনি নেতৃত্বের কারণে। অর্থাৎ তাদেরকে নেতৃত্ব দেয়ার মতো কেউ ছিল না। পরে কমিউনিস্ট পার্টির কৃষক সংগঠন সেখানে গেলে কৃষকরা নতুন আশা নিয়ে বুক বাঁধে এবং সংগ্রাম কমিটির হয়ে আওয়াজ তোলে, সাত আঁটি জিন দেয়ার।
নাচোলের তেভাগা আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারীদের মধ্যে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ছিলেন বৃন্দাবন সাহা। তার নাম অনেক জায়গায় উল্লেখ থাকলেও তাকে সেভাবে গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরা হয়নি; হয়তোবা তার সম্পর্কে সেভাবে তথ্য প্রকাশ পায়নি বলে। গতবছর দেশের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সম্পাদিত ত্রৈমাসিক ‘নতুন দিগন্ত’ পত্রিকার দুটি সংখ্যায় বৃন্দাবন সাহার নিজের ধারাবাহিক লেখা প্রকাশ হয়। দুই পর্বের লেখার প্রথম পর্বে রয়েছে নাচোলের তেভাগা আন্দোলন; ইলা মিত্র ও তিনি গ্রেপ্তার হওয়ার আগ পর্যন্ত বর্ণনা। দ্বিতীয় পর্বে তার জেলজীবন।
বৃন্দাবন সাহার লেখা পড়ে নাচোলের তেভাগা আন্দোলন সম্পর্কে নতুন কিছু তথ্য জানা যায়। সেসব তথ্য গ্রহণযোগ্য বলেই মনে হয়েছে। নওগাঁর রানীনগরের বাসিন্দা ছিলেন বৃন্দাবন সাহা। পেশায় শিক্ষক, কমিউনিস্ট এ মানুষটি নাচোলের তেভাগা আন্দোলনে ছিলেন নেতৃত্ব পর্যায়ের একজন। ইলা মিত্রের সঙ্গে রহনপুর স্টেশনে তিনিও গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। দীর্ঘ কারাভোগের পর ১৯৬০ সালে ভারতে চলে যান তিনি। সেখানে পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ দিনাজপুরে স্থায়ী হয়েছিলেন এবং আমৃত্যু দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র নেতা ও সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে গেছেন। বৃন্দাবন সাহা ১৯৯৫ সালের ৮ মার্চ মারা যান।
বৃন্দাবন সাহা, ইলা মিত্র ছাড়াও নাচোলের তেভাগা আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ আরও কয়েকজন নেতা হলেন- ইলা মিত্রের স্বামী রমেন মিত্র, অনিমেষ লাহিড়ী, চিত্ত চ্যাটার্জি, শিবু প্রামাণিক ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার রামচন্দ্রপুরের আজাহার শেখ। যাকে রমেন মিত্রই পার্টিতে নিয়ে এসেছিলেন।
১৯৪৯ সালের ডিসেম্বর মাসে নাটোর থানার কোরামুদি পাড়ায় রাজশাহী জেলা কমিটির মিটিংয়ে মজুর শ্রেণির পার্টি হিসেবে আজাহার শেখকে সেক্রেটারি নির্বাচিত করা হয়। উল্লেখ্য, রমেন মিত্রের বাড়ি ছিল চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার রামচন্দ্রপুর গ্রামে।
নাচোলের চণ্ডিপুর গ্রামের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মাতলা মাঝি ছিলেন তেভাগা আন্দোলনের স্থানীয় গুরুত্বপূর্ণ নেতা। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর তিনিই একমাত্র কমিউনিস্ট সদস্য ছিলেন বলে জানা যায়। আর এদের সবার নেতা ছিলেন বৃন্দাবন সাহা।
চণ্ডিপুর গ্রামে সুকচাঁদ কর্মকারের বাড়িটিই ছিল পার্টির কেন্দ্রীয় অফিস এবং তেভাগা আন্দোলন পরিচালনার জন্য সেই সময় স্থানীয়ভাবে একটি সংগ্রাম কমিটিও গঠন করা হয়।
স্থানীয়দের মধ্যে তেভাগা আন্দোলনে সক্রিয় হিসেবে যাদের নাম পাওয়া যায়, তারা হলেন- রতু, খতু, জসিমুদ্দিন, সুকচাঁদ কর্মকার, হীরা সিং, উপেন সিং, সূর্য মাঝি, সুখু মাঝি, চুনু মাঝি, মংলি মাঝি, চূড়কা হেমরম, হরেক সিং, হাড়মা মাঝি, তারা মাঝি, লুৎরে মাঝি, বুধরাই মাঝিসহ আরও অনেকে। তবে আলাদা করে আরেকটি নামের কথা উল্লেখ করতে হয়, তিনি হলেন সুকচাঁদ কর্মকারের বোন মোক্ষদা কর্মকারিণী। কিছুটা লেখাপড়া জানতেন। নারী বাহিনী নিয়ে সবসময় মিছিলের অগ্রভাগে ইলা মিত্রের সঙ্গেই থাকতেন তিনি।
আন্দোলনের তোড়ে স্থানীয় কয়েকজন ভূস্বামী তেভাগা মেনে নেন এবং কৃষকদের পাওনা বুঝিয়ে দেন। সেই সঙ্গে আন্দোলনকারীদের লিখিত দেন- “আমি স্বেচ্ছায় তেভাগা মেনে নিলাম এবং বর্গাদারদের ন্যায্য পাওনা দিয়ে দিলাম।”
বৃন্দাবন সাহার লেখা পড়ে অনেক বিষয়ই স্পষ্ট হয়। এও স্পষ্ট যে, নাচোলের চণ্ডিপুরে পুলিশ মেরে ফেলাটা তার উৎসাহেই হয়েছে। তাছাড়া অন্য কারোরই, বিশেষ করে সেখানকার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর কেউই এটা চাননি। মাতলা মাঝি তো সরাসরি বৃন্দাবন সাহাকে কৈফিয়ত তলবের সুরেই বলেছেন- “তোরা কি করলি? কেন ওদের মেরে ফেললি?” যদিও এ প্রশ্নের জবাব দেবার মতো কোনো ভাষা ছিল না বৃন্দাবন সাহার কাছে।
সম্ভবত ১৯৫০ সালের ৫ জানুয়ারি গরুর গাড়িতে চড়ে নাচোল থানার দারোগা তিনজন সেপাইকে নিয়ে ঘাসুড়া গ্রামে গিয়ে হাজির হন। গাড়োয়ানের নাম ছিল লালু। চারজন পুলিশ সদস্যের দুজনকে মেরে ফেলে এবং দুজনকে মাটিতে জীবন্ত পুঁতে ফেলা হয়; ওই দিনই সূর্যাস্তের আগে।
ওই দিনই স্থানীয় সুকচাঁদের জামাই সুষ্ঠিকে নিয়ে রমেন মিত্র কলকাতা রওনা হন পার্টিকে রিপোর্ট দিতে। তেভাগা আন্দোলনের আরও দুজন নেতা আজাহার শেখ ও অনিমেষ লাহিড়ী ওই দিনই রাতের অন্ধকারে গোপন আশ্রয়ের জন্য রামচন্দ্রপুর চলে যান। কিন্তু চণ্ডিপুর গ্রামের কয়েকজন ব্যক্তি এই দুজনকে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেয়।
এতদিন তথ্য-উপাত্তে চণ্ডিপুর গ্রামে পুলিশ-কনস্টেবল যাওয়ার উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু বৃন্দাবন সাহার লেখায় জানা যায়, ওই দিন আরও দুজন লোক সেখানে গিয়েছিলেন। এদের একজন ফুড ইন্সপেক্টর, আরেকজন পিয়ন। তাদেরও পাকড়াও করা হয়েছিল এবং তাদেরকেও খতম করার কথা ভাবা হলে শেষ পর্যন্ত তাদের একটি ঘরে আটকে রাখা হয়। কিন্তু রাতে পাহারাদার ঘুমিয়ে যাওয়ায় তারা পালাতে সক্ষম হন।
পরদিন ৬ জানুয়ারি পুলিশ ফৌজরা চণ্ডিপুরের আশপাশের কয়েকটি গ্রামে ব্যাপক জ্বালাও-পোড়াও চালিয়েছিল। এরপর নিপীড়িত স্থানীয়রা প্রাণভয়ে এলাকা ছেড়ে পাড়ি দিয়েছিলেন ভারতের উদ্দেশ্যে। অনেকে ধরাও পড়েছিলেন পুলিশের হাতে।
এর আগে নাচোলের তেভাগা আন্দোলন সম্পর্কে পুলিশ হত্যার পর ব্যাপক নির্যাতন-নিপীড়ন সম্পর্কে লেখা হলেও নির্যাতনে কেউ মারা গিয়েছিল কি না, সে সম্পর্কে তথ্য চোখে পড়েনি। বৃন্দাবন সাহার লেখায় সেটা চোখে পড়েছে। ১৯৫০ সালের ৬ জানুয়ারি পুলিশ ফৌজরা স্থানীয় জামলা মাঝিকে বন্দুকের বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে মেরে ফেলে। নাচোলের তেভাগা আন্দোলনে এই শহিদের নাম পাওয়া যায়। পরবর্তী সময়ে নবাবগঞ্জ থানায় পুলিশের অকথ্য নির্যাতনে আরেকজন মৃত্যুবরণ করেছিলেন, তিনি হলেন নাচোলের তেভাগা আন্দোলনের একনিষ্ঠকর্মী হরেক সিং।
রহনপুর স্টেশনে ইলা মিত্রের ধরা পড়া নিয়ে দুটো মতবাদ প্রচলিত ছিল। একটি হলো- পথ ভুল করে ইলা মিত্র রহনপুর স্টেশনে পৌঁছান। অন্যটি হলো- তিনি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নারীর বেশ ধরে গিয়েছিলেন। কেউ বলেন যে, টিকেট কাউন্টারে ইংরেজি বলায় ধরা পড়েছিলেন; আবার কেউবা বলেন যে, হাতে ঘড়ি থাকার কারণে তিনি ধরা পড়েন।
বৃন্দাবন সাহার লেখা পড়ে জানা গেল, ইলা মিত্র রামচন্দ্রপুরের দিকে যেতে রাজি ছিলেন না। তিনি রহনপুর স্টেশন হয়ে কলকাতা যেতে চেয়েছিলেন। যদিও তার মতের সঙ্গে একমত ছিলেন না বৃন্দাবন সাহা। তিনি রামচন্দ্রপুরের দিকেই যেতে চেয়েছিলেন গ্রেপ্তার এড়াতে; কিন্তু ইলা মিত্রের কারণেই রহনপুর স্টেশনে গিয়ে কলকাতার ট্রেন ধরার বিষয়টি মেনে নিয়েছিলেন। তিনি চাইলেই ইলা মিত্রকে একা ফেলে পালিয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু একজন নেত্রীকে ফেলে রেখে পার্টির কাছে গিয়ে তিনি কী কৈফিয়ত দিতেন? এ কারণেই পারেননি।
পরে দুজনেই ১৯৫০ সালের ৭ জানুয়ারি রহনপুর রেলস্টেশনে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। এরপর তাদেরকে নাচোল থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর নবাবগঞ্জে। থানায় থাকাকালে তাদের ওপর চরম নির্যাতন-নিপীড়ন চালানো হয়। বিশেষ করে ইলা মিত্রের ওপর চালানো হয় শারীরিক নির্যাতন ।
নাচোলের তেভাগা আন্দোলনের সঙ্গে ইলা মিত্র জড়িয়েছিলেন ১৯৪৬-৪৭ সালের দিকে; এটাও প্রচলিত। তবে বৃন্দাবন সাহা তার লেখা শুরু করছেন ১৯৪৯ সালের ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত নাটোরের মিটিং থেকে। পরের বছরই ৭ জানুয়ারি ইলা মিত্র ও তিনি পুলিশের হাতে রহনপুর স্টেশনে ধরা পড়েন।
তার তথ্যানুযায়ী, নাচোলের তেভাগা আন্দোলনের বিস্ফোরণটা ঘটেছিল অল্প কয়েকদিনের মধ্যে। বড়জোর ২৫-৩০ দিনের মধ্যেই। তার লেখায় রমেন মিত্র ও ইলা মিত্র নাচোলে আগে থেকেই কৃষকদের সঙ্গে নিয়ে কাজ করে যাচ্ছিলেন- এ সম্পর্কিত কোনো তথ্যও নেই। এটা কী কারণে, তা বোধগম্য নয়।
এটা সত্য যে, তেভাগা আন্দোলনের দুটি পর্যায়। একটি পর্যায় হচ্ছে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট অর্থাৎ ভারত ভাগ হওয়ার আগের দিন পর্যন্ত। আর পরের পর্যায়টি হচ্ছে এই বঙ্গের অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান বর্তমান বাংলাদেশে। এটা অনস্বীকার্য যে, ভারত ভাগ হওয়ার পর তেভাগা আন্দোলনের গতিতে ভাটা পড়ে দুই বঙ্গেই- ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ও আমাদের এ পূর্ববঙ্গে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান)।
বেশিরভাগ বইপুস্তক এবং লেখায় তেভাগা আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়টি কমই উঠে এসেছে; অর্থাৎ নাচোলে তেভাগা আন্দোলন সংগঠিত হওয়া নিয়ে। ঠিক কী কারণে নাচোলের তেভাগা আন্দোলনটি রাজনৈতিকভাবে উপেক্ষিত, সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া ভার।
লেখক: সাংবাদিক।