এবার অনেক আগেভাগেই জাতীয় নির্বাচন নিয়ে রাজনীতির মাঠ একটু গরম হয়ে গেল। বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে ২০২৪ সালের ৩০ জানুয়ারির পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে। সে অনুযায়ী ভোটের বাকি এখনও দুই বছরের বেশি। অথচ এখনই ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদকসহ একাধিক নেতা নির্বাচন নিয়ে নানারকম মন্তব্য করছেন। রাজনীতির মাঠে তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপিকেও নির্বাচনের প্রস্তুতি নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
যদিও বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থা যথেষ্ট টালমাটাল। দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া দুর্নীতি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত। যেহেতু তিনি ফৌজদারি অপরাধে দুই বছরের বেশি সাজাপ্রাপ্ত, ফলে তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। দলের দ্বিতীয় প্রধান, তার ছেলে তারেক রহমানও একাধিক ফৌজদারি মামলায় সাত বছর, দশ বছর এবং একটি মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত। অতএব, তিনিও বিদ্যমান সংবিধান ও আইনের আলোকে নির্বাচনে অযোগ্য বিবেচিত হবেন।
ফলে প্রশ্ন হলো- বিএনপি যদি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়, তাহলে তাদের দলের প্রতিনিধিত্ব করবেন কে? দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর? নাকি জিয়াউর রহমান অথবা খালেদা জিয়ার পরিবারের কেউ রাজনীতিতে অংশ নিয়ে, দলের গুরুত্বপূর্ণ কোনো পদে আসীন হয়ে তিনি বিএনপির প্রতিনিধিত্ব করবেন? কেননা, বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে পরিবারতন্ত্রের ইতিহাস ও পৌনঃপুনিকতা, সেখান থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসা কঠিন।
আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে সম্প্রতি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্যটি করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মানুষ বিএনপিকে কেন ভোট দেবে— সেই প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং যৌক্তিক প্রশ্ন। ২০০৭ সাল থেকে, অর্থাৎ ১৪ বছর ধরে দলটি ক্ষমতার বাইরে। এতটা লম্বা সময় ধরে একটি দল ক্ষমতার বাইরে, অপরদিকে দলের শীর্ষ দুই নেতা ফৌজদারি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত। এর মধ্যে আইনের দৃষ্টিতে ও ভাষায় তারেক রহমান ‘পলাতক আসামি’। বর্তমান সরকারের আমলে দেশে এলেই গ্রেপ্তার হবেন।
খালেদা জিয়ারও বয়স হয়েছে। শারীরিকভাবেও পুরোপুরি সুস্থ নন। তিনিও সাজাপ্রাপ্ত। যতটুকু শোনা যায়, তাতে বিএনপির হাইকমান্ডের ভেতরেও নানারকম অসন্তোষ আছে। গ্রুপিং আছে। শীর্ষ নেতৃত্ব নিয়ে দ্বিমত-ভিন্নমত এমনকি বিরোধও আছে। সুতরাং ভোট দেয়ার সুযোগ পেলে মানুষ আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে আবার ক্ষমতায় বসাবে নাকি বিএনপিকে ভোট দেবে— সে বিষয়ে এখনই উপসংহারে পৌঁছানো কঠিন।
মানুষ কাকে ভোট দেবে বা দেবে না— সেই প্রশ্নের চাইতে বড় কথা একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করা; যে ব্যবস্থাটি গত কয়েকটি নির্বাচনে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। দেশ-বিদেশে সমালোচিত হয়েছে।
আওয়ামী লীগ পর পর তিনবার ক্ষমতায় আসতে না পারলে দেশের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হতো কি না; পদ্মা সেতুর মতো বিরাট প্রকল্প নিজস্ব অর্থায়নে করা সম্ভব হতো কি না; এক্সপ্রেসওয়ের মতো স্বপ্নের প্রকল্প বাস্তবায়িত হতো কি না; করোনার অতিমারিতে বিশ্বের অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী অনেক দেশও যখন বিপর্যস্ত, তখন বাংলাদেশ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকতে পারত কি না— ইত্যাদি নানা প্রশ্ন তোলা যেতে পারে। কিন্তু এসব যুক্তিতে একটি নির্বাচনি ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা যায় না।
কারণ যে গণতন্ত্রের জন্য স্বয়ং জাতির পিতা সারা জীবন সংগ্রাম করেছেন, যে গণতন্ত্রকেই বলা হচ্ছে এখন পর্যন্ত উদ্ভাবিত পদ্ধতিগুলোর মধ্যে অপেক্ষাকৃত ভালো— সেই গণতন্ত্রের প্রথম শর্তই হলো জনগণের ক্ষমতায়ন। যে ক্ষমতায়নের একটি প্রধান উপায় হচ্ছে নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের প্রতিনিধির কাছে শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তর। সেটি স্থানীয় সরকার হোক, কিংবা জাতীয় সংসদ। কিন্তু মানুষ যদি ভোট দিতেই না পারে, সেই ভোট যদি নির্ধারিত সময়ের আগেই দেয়া হয়ে যায়; সেই ভোট যদি দেশ-বিদেশে সমালোচিত হয়, হয় প্রশ্নবিদ্ধ, গ্রহণযোগ্য না হয়—তাহলে সেটি গণতন্ত্রের জন্য অনুকূল নয়।
অতএব, ২০২৪ সালের ৩০ জানুয়ারির আগে যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে, সেটি বিদ্যমান সংবিধান ও আইনের মধ্যে থেকে কতটা অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করা যাবে— তা নিয়ে যেহেতু যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে এবং ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া যেহেতু একা নির্বাচন কমিশনের পক্ষে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা সম্ভব নয়, ফলে সরকার বা সরকারি দল আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে— সেটিও গুরুত্বপূর্ণ।
আবার যারা নির্বাচনের মতো একটি পবিত্র আমানতের রক্ষক— সেই নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব কারা পাচ্ছেন; যারা নির্বাচন কমিশনার হয়েছেন এবং হবেন—তারা কতটা নিরপেক্ষ তথা দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে দায়িত্ব পালন করছেন বা করতে পারবেন— সেটিও বড় প্রশ্ন। যে কারণে বার বারই নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য একটি আইন প্রণয়নের দাবি জানানো হয়। সংবিধানেও এ বিষয়ে নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, গত ৫০ বছরেও এই আইনটি করা হয়নি। আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতেই শেষ হচ্ছে বর্তমান হুদা কমিশনের মেয়াদ।
বলা হচ্ছে এবারও সার্চ কমিটির মাধ্যমে নতুন কমিশন গঠন করা হবে। একটি আধুনিক আইন হলে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য এবং রাজনৈতিক বিবেচনার ঊর্ধ্বে উঠে নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ দেয়াটা সহজ হতো— যা ভালো নির্বাচনের জন্য সহায়ক হতো। কিন্তু অতীতের কোনো সরকারই সম্ভবত ভালো নির্বাচনের তাগিদ অনুভব করেনি। যারা ক্ষমতায় গিয়েছে, তারাই পরবর্তী নির্বাচনে জয়লাভের জন্য পুরো নির্বাচনি ব্যবস্থাটাকে নিজেদের অনুকূলে রাখার চেষ্টা করেছে।
মানুষ কাকে ভোট দেবে— সেই সিদ্ধান্তটি জনগণের ওপরেই ছেড়ে দেয়া দরকার। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেশের যে উন্নয়ন হয়েছে; সারা বিশ্ব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে যেরকম একজন আন্তর্জাতিক নেতা হিসেবে চিনেছে; রোহিঙ্গা ও করোনা ইস্যুতে তিনি যেভাবে পুরো পরিস্থিতি সামাল দিয়েছেন— তাতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং প্রশাসনের সর্বত্র দলীয়করণ বাদ দিলে আওয়ামী লীগের প্রতি মানুষের গোস্বা হওয়ার কারণ খুব একটা বেশি নয়।
অপরদিকে এই দীর্ঘ সময়ে আওয়ামী লীগের বিকল্প হিসেবে বিএনপি দাঁড়াতে পারেনি। কেন পারেনি, সেটি অন্য তর্ক। দলের নেতারা এর পক্ষে অনেক যুক্তি দিয়ে থাকেন। কিন্তু মানুষ যুক্তির চেয়ে কাজের ফল দেখতে বেশি আগ্রহী। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয়ে বিএনপি এ পর্যন্ত বড় পরিসরে জনমত গঠনে ব্যর্থ হয়েছে।
এমনকি কোনো আন্দোলনও গড়ে তুলতে পারেনি। বলাই হয়, আন্দোলনের মাঠ যার দখলে, ভোটের ফলও তার ঘরে। অতএব, দেশ ও দেশের রাজনীতির এখন যা অবস্থা তাতে অবাধ, সুষ্ঠু ও প্রভাবমুক্ত নির্বাচন হলেই যে বিএনপি বিশাল ব্যবধানে জয়ী হয়ে আসবে— এমনটি ভেবে তারা পুলকিত হতেই পারে, কিন্তু সেই সমীকরণ বোধ হয় এত সহজ নয়।
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।