রিমি আর রাশেদ। ভাই বোন। একই ক্লাসে পড়ে। বয়সে রিমি যদিও দেড় বছরের বড়। কিন্তু স্কুলে দুজনকে এক সঙ্গেই ভর্তি করানো হয়। আসলে রিমিকে স্কুলে ভর্তি করানোটা পরিবারের কারো কাছেই গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। রিমির লেখাপড়া নিয়ে কারো মাথাব্যথাও ছিল না। আর সে কারণে রিমি স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পেল বয়সে ছোট ভাই রাশেদের সঙ্গে।
ওদিকে রিমি পড়াশোনা করারও সুযোগ পায় কম। সন্ধের সময় পড়তে বসার পর পর বাবা আসেন। বাবাকে এটা ওটা এগিয়ে দেয়া, চা-নাশতা দেয়া, মায়ের ফুট ফরমায়েশ খাটা- এই করতে করতে সন্ধেটা পেরিয়ে যায়। ওই সময় রাশেদ থাকে পড়ার টেবিলে। রাশেদের তখন পড়ার টেবিল থেকে ওঠাও মানা। এমনকি রাশেদের নাশতাটা পর্যন্ত রিমি পড়ার টেবিলে দিয়ে আসে। সন্ধের নাশতা রাশেদ প্রতিদিন পেলেও, রিমি সবদিন পায় না। বিকেল থেকেই মায়ের চিন্তা, বিকেলে খেলাধুলা করে এসে রাশেদ কী খাবে!
অথচ রিমি সারাদিন মাকে সাহায্য করে। স্কুল থেকে ফিরেই মায়ের সঙ্গে ঘরোয়া কাজে সহযোগিতা করে। কিন্তু রিমির খাবার নিয়ে মাকে কখনও ভাবতে দেখেনি।
বিকেলে রাশেদ খেলতে চলে যায়। রিমি ঘরে থাকে। আগে বিকেল হলে রিমিও বাইরে বের হতে পারত। বান্ধবীদের সঙ্গে কুতকুত বা ওপেনটি বায়স্কোপ খেলে সময় কাটাত। কিন্তু হাইস্কুলে ওঠার পর থেকে বিকেলে রিমির ঘুরে বেড়ানো নিষেধ। বিকেলগুলোতে খুব খারাপ লাগত রিমির। এখন আর অতটা খারাপ লাগে না। বিকেলে এখন পড়ালেখা করেই কাটায় রিমি। তবু সব বিকেল পড়তে পারে না। রাশেদের জন্য সন্ধের নাশতা বানাতে মাকে সাহায্য করতে হয়।
একদিন হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল রিমিদের স্কুল। বন্ধ হয়ে গেল দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কোভিড-১৯ নামের মহামারি হানা দিল বিশ্বে। পুরো দুনিয়াটাই ওলট-পালট করে দিল। উপজেলা সদরে একটা শোরুমে চাকরি করতেন বাবা। করোনার কারণে বাবার চাকরিটাও চলে গেল।
রিমিদের পরিবারে শুরু হলো দুঃসহ সময়। কিছু জমিজমা আছে, কিন্তু ওটা দিয়ে পুরো পরিবারের খাবার জোটানো অসম্ভব। তবু চেষ্টা করে যেতে লাগলেন মা। রিমিকে নিয়ে শাক-সবজি লাগালেন। যত্ন-আত্তি করতে লাগলেন।
ওদিকে রাশেদের দিনগুলো কিন্তু বেশ আনন্দেই কাটছে। স্কুল নেই। পড়াশোনার কড়াকড়ি নেই। সারাদিন এ পাড়া ও পাড়া খেলাধুলা করে বেড়ায়। তারপর হঠাৎ একদিন জানা গেল অনলাইন ক্লাস শুরু হবে। অনলাইন ক্লাসের জন্য দরকার স্মার্টফোন বা কোনো ডিভাইস আর ইন্টারনেট কানেকশন।
কতদিন বইখাতা খুলেও দেখেনি রাশেদ। যেভাবেই হোক ওকে পড়াশোনায় ফেরাতে হবে। ইন্টারনেট কানেকশনের ব্যবস্থা করা হলো। বাবার স্মার্টফোন দিয়ে অনলাইন ক্লাস শুরু করল রাশেদ। কিন্তু রিমি?
ও তো মেয়ে! ওর আবার এতসব ঝক্কি-ঝামেলার মধ্যে অনলাইন ক্লাস করার কী দরকার? ওর কি অতো সময় আছে? ওকে তো এখন আগের চেয়ে আরও বেশি ঘরোয়া কাজ করতে হয়।
অনলাইন ক্লাস করেই ওই ক্লাস ডিঙিয়ে ওপরের ক্লাসে ওঠল রাশেদ। ওদিকে রিমি তো ঘরের আঙিনাই ডিঙাতে পারে না। ক্লাস ডিঙাবে কী করে?
কিন্তু একদিন, বাবার বাড়িটাই ডিঙাতে হলো রিমিকে। বাবার বাড়ি ডিঙিয়ে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার মতো বয়স যদিও ওর হয়নি। এটা ছিল রিমির কল্পনারও বাইরে। ইচ্ছে তো ছিলই না। ইচ্ছে ছিল লেখাপড়া করে কিছু একটা করবে। বাবা-মায়ের দুঃখ-কষ্ট ঘোচাবে। কিন্তু...
আমাদের সব রিমির সব ইচ্ছে পূরণ হয় না। এই রিমি তো আমাদেরই শিশু। তবে কন্যাশিশু। আর কন্যা হওয়াটাই অনেক শিশুর জন্য অভিশাপ!
উন্নয়নশীল দেশগুলোতে মেয়েশিশুরা বড়ই অযত্ন আর অবহেলার শিকার। মৌলিক চাহিদা থেকেও তারা বঞ্চিত। সঙ্গে যদি দরিদ্রতা থাকে, তাহলে বৈষম্যের কোপটা ওই কন্যাশিশুর ওপরই পড়ে প্রথম।
১৯৯৫ সালে চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ওই নারী সম্মেলনে দুনিয়ার মেয়েশিশুদের নানান প্রতিবন্ধকতা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়। কন্যাশিশুদের প্রতি রাষ্ট্র, সমাজ এবং পরিবারের গুরুত্ব তৈরির উদ্দেশে বছরের একটি দিন নির্দিষ্ট করা হয়।
২০১২ সাল থেকে ১১ অক্টোবর আর্ন্তজাতিক কন্যাশিশু দিবস হিসেবে পালনের ঘোষণা দেয় জাতিসংঘ। সে হিসেবে আজ আর্ন্তজাতিক কন্যাশিশু দিবস। এবারের কন্যাশিশু দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে- ডিজিটাল জেনারেশন। আওয়ার জেনারেশন। অর্থাৎ ডিজিটাল প্রজন্ম। আমাদের প্রজন্ম।
করোনাকালে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত কারা? নারীরা। নারীর প্রতি বেড়েছে সহিংসতা। বেড়েছে অযত্ন-অবহেলা। এ থেকে মুক্ত নয় কন্যাশিশুরাও। এমনিতেই বিশ্বজুড়ে কন্যাশিশুরা নানা বৈষম্যের শিকার। অতিমারিতে সে বৈষম্য চরম আকার ধারণ করেছে। বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে বাল্যবিবাহ একটি অভিশাপ হিসেবে সমাজ, পরিবার ও রাষ্ট্রকে ক্ষত-বিক্ষত করেই চলেছে। দীর্ঘসময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো টানা বন্ধ থাকায়, বাল্যবিবাহটাও মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়েছে গ্রাম বা শহর সব জায়গায়। করোনাকালীন দুঃসময় কাটিয়ে স্কুল খোলার পর দেখা গেল, ব্যাপকহারে মেয়ে শিক্ষার্থী অনুপস্থিত। অথচ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হলেও শিক্ষা কার্যক্রম কিন্তু বন্ধ ছিল না। অনলাইনের মাধ্যমে নিয়মিত কম-বেশি ক্লাস হতো। তাহলে কন্যাশিক্ষার্থীরা কোথায়?
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পরই সেটা টের পাওয়া গেল- অনলাইন ক্লাসের বেলায়ও কন্যাশিক্ষার্থীরা বৈষম্যের শিকার হয়েছে। দেখা যায়, প্রযুক্তি ব্যবহারে কন্যাশিশুদের গুরুত্ব অনেক ক্ষেত্রে নেই বললেই চলে। অথচ ছেলেশিশুর বেলায় অনেক পরিবার যেভাবেই হোক, অনলাইন ক্লাস চালিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছে। কন্যাশিশুর বেলায় সেটা ঘটেনি। বরং ঘরোয়া কাজে কিংবা বিয়ে দিয়ে পরিবারগুলো তাদের দায় সেরেছে।
বাল্যবিবাহের শিকার হওয়া কন্যাশিক্ষার্থীদের অনেকেই শিক্ষালয়ে ফিরেছে ঠিকই, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে শিশুর কোলে শিশু। বিয়ের পর অনেক কন্যাশিশু মা হয়ে গিয়েছে।
প্রযুক্তিতে দুনিয়া এতখানি অগ্রসর হয়েছে যে, ঘরে বসে শিক্ষার্থীরা ক্লাস করার সুযোগ পাচ্ছে। ঘরে-বাইরে প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে-কিন্তু এর সুফল কন্যাশিশুরা তেমন পাচ্ছে না। প্রযুক্তির সুফল থেকেও তারা বঞ্চিত। এছাড়া কিছু সমাজে প্রযুক্তি ব্যবহারে মেয়েদের রয়েছে কঠোর নিষেধাজ্ঞা। সামাজিক ও পারিবারিক বাধা ডিঙিয়ে এসব মেয়েরা প্রযুক্তির ধারে কাছেও ঘেঁষতে পারছে না। সুফল তো পরের কথা। এসব দিক বিবেচনা করেই ডিজিটাল সমতাকে গুরুত্ব দিয়ে এবারের আর্ন্তজাতিক কন্যা দিবসের থিম নির্ধারণ করা হয়েছে।
আজকের কন্যাশিশু কি কেবলই আগামী দিনের মা? জাতি গঠনে কি তাদের কোনো ভূমিকাই নেই? আছে। অনেক আছে। উদাহরণের কমতি হবে না। কিন্তু সুযোগ না পেলে কী করে তারা এই উন্নয়নের গতিকে চলমান রাখবে? জাতি গঠনে, জাতি উন্নয়নে, বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অন্য জাতি বা দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য প্রযুক্তিকে অবহেলা করার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু বিশ্বের এক শ’ দশ কোটি কন্যাশিশুকে বাদ দিয়ে পৃথিবীর অগ্রযাত্রা তো অসম্ভব বিষয়। সমাজের একটা অংশকে গুরুত্ব না দিয়ে, তাদের প্রতি বৈষম্যময় আচরণ করে, অজ্ঞতার মধ্যে রেখে সুন্দর ও সুস্থ সমাজ কীভাবে তৈরি হবে? রাষ্ট্র এগোবে কী করে? জাতি সমৃদ্ধ হবে কী করে?
এমনিতেই আমাদের কন্যাশিশুরা গড়পড়তায় ভালো নেই। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ১৫ ভাগ ও বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ১০ ভাগ হয়েও তারা নিরাপত্তাহীনতা আর অপুষ্টির শিকার। অবহেলা তো আছেই।
অনেক কন্যাশিশু বাবার বাড়িতে ঠিকমতো খাবারও পায় না। পরিবারে খাবারে টান পড়লে সেই টানটা কন্যার উপরই বর্তায়। ঠিক তেমনি বিয়ের পরও প্রয়োজনীয় খাবার পায় না। সুষম খাবার তো অকল্পনীয় বিষয়। ফলে নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে অপুষ্টির শিকার হওয়া কন্যাশিশুরা শারীরিক সমস্যায় ভোগে। জন্ম দেয় অপুষ্ট শিশু, রোগাক্রান্ত শিশু।
আর নিজের পরিবারে যেমন, স্বামীর পরিবারেও অবদমনের শিকার তারা। ফলে তাদের মানসিক সমস্যাও আশঙ্কাজনক। মানসিক ভারসাম্যহীন এক শিশু যখন আরেক শিশুর জন্ম দেয়, তখন নতুন জন্ম নেয়া সে শিশুর শারীরিক ও মানসিক গঠন কি স্বাভাবিক হবে? সে শিশু দেশ-জাতি, সমাজ-পরিবার এমনকি নিজের জন্যও উল্লেখ করার মতো ভূমিকা কি রাখতে পারবে? কন্যাশিশুর প্রতি অবহেলা, অবজ্ঞা করা মানে নিজেদের পায়ে নিজেদেরই কুড়াল মারা।
সবার স্বার্থেই কন্যাশিশুর প্রতি অবহেলা নয়, বরং তাকেও সমান সুযোগ দেয়া সবারই উচিত এবং কর্তব্য।
লেখক: শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক।