বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস আজ : মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির সঙ্গে সার্বিক উন্নয়নও জড়িত

  • হীরেন পণ্ডিত   
  • ১০ অক্টোবর, ২০২১ ১৬:৪৫

মানসিক স্বাস্থ্য বাদ দিয়ে আমরা টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জন করতে পারব না। মানসিক স্বাস্থ্যসেবার বিকেন্দ্রীকরণ করে উপশহর, গ্রামীণ ও দুর্গম অঞ্চলে পৌঁছে দেয়ার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ।

টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের (এসডিজি) তিন নম্বর এজেন্ডায় সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণের কথা বিশেষভাবে বলা হয়েছে। মানসিক স্বাস্থ্য বাদ দিয়ে আমরা টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জন করতে পারব না। মানসিক স্বাস্থ্যসেবার বিকেন্দ্রীকরণ করে উপশহর, গ্রামীণ ও দুর্গম অঞ্চলে পৌঁছে দেয়ার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ।

প্রায় দেড় বছর ধরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণে বিশ্বজুড়ে আক্রান্ত হয়েছে ২৩ কোটি ৬২ লাখ ২৯ হাজার ৫০৩ জন, মৃত্যুবরণ করেছে ৪৮ লাখ ২৪ হাজার ৫২০ জন এবং সুস্থ হয়ে উঠেছেন ২১ কোটি ৩২ লাখ ৮৪ হাজার ৩৬৩ জন। বাংলাদেশে মৃত্যুর সংখ্যা ২৭ হাজার ৫৯১ জন (৫ অক্টোবর ২০২১ পর্যন্ত )।

কোভিড-১৯ একটি ভাইরাসজনিত রোগ কিন্তু এ রোগটির ব্যাপ্তি এতই বেশি যে, তা শারীরিক স্বাস্থ্যের বিপন্নতাকে অতিক্রম করে মানসিক, সামাজিক আর অর্থনৈতিকভাবেও আমাদের বিপর্যস্ত করে ফেলছে। এই সংকট সমস্যার সমাধান কবে হবে কেউ জানে না। কঠিন এই বাস্তবতায় কী হবে এই কঠিন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে। করোনার কারণে চাকরিচ্যুত হয়েছেন শতকরা ৩৬ জন। তিন শতাংশ মানুষের চাকরি থাকা সত্ত্বেও তারা বেতন-ভাতা পান না। এদের বেশির ভাগই মধ্যবিত্ত। তাহলে সংকট উত্তরণের কী উপায়?

করোনা সংক্রমণজনিত এ সংকটকালীন বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের সার্বিক সুরক্ষা ও জীবন-জীবিকা নির্বাহের জন্য উন্নয়ন কার্যক্রম এবং জনবান্ধব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে সরকার। এ সব পদক্ষেপ প্রায় স্থবির হয়ে পড়া অর্থনীতির চাকা চলমান রাখতে কিছুটা হলেও অবদান রাখছে।

করোনাকালে বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি মানুষই মানসিক চাপের মধ্যে রয়েছে। এর মধ্যে ৩৪ দশমিক ৯ শতাংশ যুব ও যুব নারী বিভিন্ন প্রকার মানসিক চাপে রয়েছেন। এ ধরনের মানসিক অস্থিরতায় ভুগে ৭০ দশমিক ৮ শতাংশ মানুষ শারীরিকভাবে নিজের ক্ষতি করছেন। মানসিক বিভিন্ন চাপের ফলে আত্মহত্যার প্রবণতাও দেখা যাচ্ছে। করোনাকালে এত বেশিসংখ্যক আত্মহত্যার ঘটনা উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে।

মূলত মানসিক স্বাস্থ্যসংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যা, আত্মহত্যার কারণ চিহ্নিত করা এবং তার সমাধানের উপায় খুঁজে বের করার জন্যই অনেকে কাজ করছেন। ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশে মোট ১৪ হাজার ৪৩৬টি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। ৩২২টি আত্মহত্যার কেসস্টাডির প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, যারা আত্মহত্যা করেছে তাদের ৪৯ শতাংশেরই বয়স ২০ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। আর এর ৫৭ শতাংশই নারী।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, তরুণদের মধ্যে অধিকাংশই মানসিক বিষণ্নতায় ভোগেন। অধিকাংশ সময় মন খারাপ থাকা, পছন্দের কাজ থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলা। অস্বাভাবিক কম বা বেশি ঘুম হওয়া, কাজে মনোযোগ হারিয়ে ফেলা, নিজেকে নিয়ে নেতিবাচক চিন্তা করা, সবকিছুতে সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগা।

এ সমস্যাগুলো তীব্র আকার ধারণ করলে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যায় বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। তাদের মানসিক অস্থিরতার বিষয়ে কারো সঙ্গে খোলামেলা কথা বলতে না পারাই মূল কারণ। মন খারাপ হলে বা বিষণ্ন হলে বন্ধুদের সঙ্গে, পরিবারের সঙ্গে এবং বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তা শেয়ার করা যেতে পারে।

অধিকাংশই প্রায় প্রতিদিন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যয় করেন, যা মানসিকভাবে তাদের বিপর্যস্ত করে তুলছে। অনেকেই দৈনিক ৬ ঘণ্টার বেশি সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সময় ব্যয় করেন। তাদের মানসিক স্বাস্থ্য তাদের দৈনন্দিন কাজগুলোকে বাধাগ্রস্ত করে। এর মধ্যে ৯১ দশমিক ৪ শতাংশই কখনও মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেননি।

করোনাকালে তরুণরা যে মানসিক চাপজনিত সমস্যাগুলোর সম্মুখীন হচ্ছে সেগুলো হচ্ছে- পড়াশোনা ও কাজে মনোযোগ হারানো, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া, একাকী অনুভব করা, অনাগ্রহ সত্ত্বেও পরিবার থেকে বিয়ের চাপ, আর্থিক সমস্যা, অতিরিক্ত চিন্তা করা, মোবাইল আসক্তি, আচরণগত সমস্যা, চাকরির অভাব, কাজের সুযোগ না পাওয়া, সেশনজট, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ এবং পরিবারের সদস্যদের মৃত্যু ইত্যাদি।

একাধিক গবেষণা বলছে, করোনায় সংক্রমিত মানুষের প্রতি পাঁচজনের একজনের মধ্যে করোনার সঙ্গে মানসিক সমস্যা যেমন বিষণ্নতা, উদ্বিগ্নতা, সাইকোসিস ইত্যাদি দেখা দেয় বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। আবার করোনায় আক্রান্ত নন, এমন ব্যক্তি এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে মানসিক চাপ উদ্বিগ্নতা, বিষণ্নতা, আতঙ্ক সৃষ্টির হার সাধারণ সময়ের চেয়ে বহুগুণ বেড়ে যায় বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। এমনকি করোনা থেকে সেরে উঠলেও মানসিক সমস্যার ঝুঁকি থেকে যায়।

মনে রাখতে হবে এই সংকটময় মুহূর্তে আতঙ্কিত হওয়া, মানসিক চাপে পড়া বা হতাশবোধ করাই স্বাভাবিক। পুরো বিশ্ব একটি অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মুখোমুখি। আতঙ্কিত হয়ে গেলে কিন্তু তার রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাবে সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যাবে, করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে আতঙ্ক আর মানসিক চাপ তার করোনাকে আরও জটিল করে তুলবে। তাই সবাইকে মানসিক চাপ মোকাবিলায় দক্ষতা বাড়াতে হবে।

সুস্বাস্থ্য হলো শারীরিক ও মানসিক অবস্থা সুস্থ বোঝায়। শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা দুটোই একে অপরের পরিপূরক। শারীরিক সুস্থতা ব্যতিরেকে মানসিক সুস্থতা অর্জন সম্ভব নয়। অপরপক্ষে মানসিক অসুস্থতা শারীরিক সুস্থতার ওপর প্রভাব ফেলে। শারীরিক অসুস্থতা দৃশ্যমান হলেও মানসিক অসুস্থতা প্রাথমিক পর্যায়ে দৃশ্যমান নয়। এটি দৃশ্যমান হয় যখন এটি মারাত্মক আকার ধারণ করে।

ব্যক্তিকেন্দ্রিক এ সমস্যা তার পারিবারিক ও সামাজিক সমস্যার কারণ হিসেবেও প্রতীয়মান হয়। মানসিক সসমস্যার মধ্যে আর একটি হচ্ছে ‘অ্যাংজাইটি অর্থাৎ দুশ্চিন্তা’। এ সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তি যেকোনো বিষয় নিয়ে অত্যধিক দুশ্চিন্তা করে। পরিবার পরিজন অথবা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হারানোর ভয় তাদের সর্বদা উদ্বিগ্ন করে রাখে। এমনকি একসময় অন্যের ওপর মারাত্মক সন্দেহপ্রবণতা কাজ করে। প্রাথমিক পর্যায়ে স্বাভাবিক মনে হলেও দীর্ঘদিন এ সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তির পরবর্তী সময়ে পারিবারিক ও সামাজিক জীবন যাপন ব্যাহত হতে পারে। মানসিক অসুস্থতার মধ্যে আরেকটি অবস্থা হচ্ছে ‘ডিপ্রেশন বা বিষণ্নতা’। এক জরিপে দেখা গেছে, বিশ্বে প্রায় ১৯ বিলিয়ন লোক বিষণ্নতাজনিত মানসিক সমস্যায় ভুগছে।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় উঠে এসেছে যে, ‘বাংলাদেশের ১২ দশমিক ৭ ভাগ মানুষ বিষণ্নতায় ভোগে। অর্থাৎ ১৬ কোটি মানুষের এই দেশে বিষণ্নতায় ভোগা রোগীর সংখ্যা দুই কোটির বেশি।’ চিকিৎসকদের মতে, বিষণ্নতা একই সঙ্গে মানসিক ও শারীরিক রোগ। এখন এ পরিসংখ্যানের সূত্র ধরেই প্রশ্ন জাগে, এ বিষণ্নতায় আক্রান্ত রোগী তথা মানসিক রোগীর জন্য দেশের পরিবেশ কতটুকু অনুকূল কিংবা আদৌ অনুকূল কি না?

পরিবেশ বলতে এখানে পারিবারিক-সামাজিক তথা গোটা জাতীয় পরিবেশকে বোঝানো হয়েছে। যেখানে মনোরোগ বললেই আমরা বুঝে থাকি কোনো এক লজ্জাজনক অসুখ। শরীরের অন্য সব অসুখের মতো মনেরও অসুখ হতে পারে, এ বিষয়গুলো আমাদের সমাজে সমভাবে স্পষ্টও নয়, গ্রহণযোগ্যও নয়। বরং যে মানুষটি এ সমস্যায় ভোগেন তাকে নিয়ে তার পরিবার সহজ হতে পারে না। পরিবার তাকে নিয়ে হীনন্মন্যতায় ভোগে। যার নানা কুপ্রভাব পড়ে ওই ব্যক্তির জীবনের ওপর। পরিবর্তিত মনস্তাত্ত্বিক অবস্থার মধ্য দিয়ে যাওয়া ওই মানুষটিকে নিয়ে সবসময় পরিবারের সবাই জড়সড় হয়ে থাকে।

২০১৩ সালে প্রতিবন্ধী অধিকার ও সুরক্ষা আইনের ৩ নং প্রতিবন্ধিতা হচ্ছে মানসিক অসুস্থতাজনিত প্রতিবন্ধিতা। অর্থাৎ দীর্ঘমেয়াদি মানসিক অসুস্থতার কারণে যদি ব্যক্তির ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক জীবন যাপন ব্যাহত হয় তাহলে তা মানসিক অসুস্থতাজনিত প্রতিবন্ধিতা বলে গণ্য হবে। মানসিক অসুস্থতার চিকিৎসা ও পুনর্বাসন: প্রাথমিক অবস্থায় মানসিক অসুস্থতা চিহ্নিত করে যদি চিকিৎসাসেবার আওতায় আনা যায়, তাহলে তা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।

আরেকটি জরুরি বিষয় হলো- দক্ষ জনবল তৈরিতে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে প্রশিক্ষণ দরকার। জেলা হাসপাতাল থেকে শুরু করে কমিউনিটি ক্লিনিক পর্যন্ত প্রশিক্ষণ দিতে হবে। মানসিক সমস্যার চিকিৎসাসমূহের মধ্যে রয়েছে মেডিসিন, সাইকোথেরাপি, কাউন্সেলিং ও অকুপেশনাল থেরাপি। অর্থাৎ মাল্টি ডিসিপ্লিনারি টিমের মাধ্যমে চিকিৎসা গ্রহণ করলে একজন মানসিক সমস্যাগ্রস্ত রোগী স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে। আমাদের সবাইকে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও রিসার্চ ফেলো বিএনএনআরসি

এ বিভাগের আরো খবর