বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

গণমুখী বিরোধী দল চাই

  • রণেশ মৈত্র   
  • ৭ অক্টোবর, ২০২১ ১৬:৩৮

বাংলাদেশে বিরোধী দল হিসেবে যে দলটি পরিচিত, সেটি হলো- বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি। দলটি মুক্তিযুদ্ধের অনেক পরে গঠিত। এতে ঠাঁই পায় মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী কিছু উগ্র সাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ। এ জাতীয় শক্তির সঙ্গেও বিএনপি জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে জিতে জামায়াতে ইসলামীর দুই শীর্ষ নেতাকে মন্ত্রিত্বের আসন দিয়ে ‘মহিমান্বিত’ করে। নড়বড়ে ওই জোটটির নাম ২০-দলীয় জোট। তাদের পূর্বসূরি এবং দলটির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান স্বয়ং জামায়াতে ইসলামীসহ ধর্মাশ্রয়ী দলগুলোকে অসাংবিধানিক পন্থায় বৈধতা দেন। তাদের উত্তরসূরী অপর সামরিক শাসক এরশাদ রাষ্ট্রধর্ম সংযোজন করে একই পন্থায়।

বাংলাদেশে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা এখন ৪৪টি। এটি নির্বাচন কমিশনের হিসাব, এর বাইরেও বেশ কিছু দলের অস্তিত্ব আছে। সেগুলো কমবেশি জনগণকে সঙ্গে নিয়ে তাদের স্বার্থে সাধ্য অনুযায়ী মাঠে-ময়দানে কাজ করছে। বেশকিছু দল নির্বাচন কমিশনের কাছে নিবন্ধনের আবেদনও করেছে। কিন্তু নিয়ম ও আইন-কানুনের কারণে সেগুলোকে নিবন্ধন করা যাচ্ছে না।

বাংলাদেশের আকৃতি অনুপাতে এতগুলো রাজনৈতিক দলের মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী ১৪ দল ব্যতীত বাদবাকি সবগুলোই বিরোধী দল। অথচ তাদের অস্তিত্ব ও কর্মকাণ্ড জনগণের কাছে স্পষ্ট নয়।

সরকারি দল ও তার জোটে যে দলগুলোর অস্তিত্ব তালিকাভুক্ত আছে এর মধ্যেও কিছু সংখ্যক অনিবন্ধিত। এভাবে যদি সরকার-সংশ্লিষ্ট নিবন্ধিত দলের সংখ্যা ১০টিও হয় তবু এর বাইরে আরও প্রায় ৩০টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব অন্তত খাতা-কলমে থাকার কথা। এ কয়টি দলকে বিরোধী দল হিসেবে আখ্যায়িত করা যেতে পারে। কিন্তু এগুলোকে সরকারবিরোধী বা সরকারের পক্ষে কোনো ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়?

আজকাল ফেসবুক হয়ে দাঁড়িয়েছে অনেক বিরোধী দলের ক্রিয়াকলাপ প্রচারের প্রধান মাধ্যম। সেখানে এদের বিজ্ঞপ্তি, আলোচনা-সমালোচনা, মানববন্ধনের ছবি দেখা যায়। কিন্তু সংসদে কোনো স্থান নেই। তবে নিকট অতীতেও ছিল। বিগত প্রায় দুটি দশক ধরে সেখানে এদের আসনের অস্তিত্ব না থাকায় এবং করোনার কারণে ময়দানে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ হওয়ায় সরকারি বা বিরোধী, কোনো দলকেই বিগত দেড় বছর মানুষ জমায়েত করতে দেখা যাচ্ছে না। প্রশ্ন হলো, এর আগে কি বিরোধী দলগুলোর সরব অস্তিত্ব জনগণের মধ্যে, মাঠে-ময়দানে খুঁজে পাওয়া যেত? উত্তর হলো ‘না’।

বাংলাদেশ গড়ে উঠেছে বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্র, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শের ওপর ভিত্তি করে। তাই এ দেশের মাটিতে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী, ধর্মান্ধ ও সাম্প্রদায়িক দলের অস্তিত্ব ঐতিহাসিক বাহাত্তরের মূল সংবিধানের পরিপন্থি। সে হিসেবে সরকারি দলকে যেমন বাহাত্তরে সংবিধানে বর্ণিত মূল চার নীতি অর্থাৎ গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্রের নিষ্ঠাবান সমর্থক হতে হবে তেমনই বিরোধী দলগুলোকেও হাঁটতে হবে একই পথে। এভাবেই রাজনৈতিক অঙ্গন হয়ে উঠবে একাত্তরের চেতনাসমৃদ্ধ গণতান্ত্রিক, সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী ও সমাজতন্ত্রের অনুসারী।

গণতান্ত্রিক অধিকারের নাম করে বা এর সুযোগ নিয়ে মুষ্টিমেয় মানুষের স্বার্থ রক্ষাকারী পুঁজিবাদের সমর্থক হলে সে বা তারা হবে সংখ্যারিষ্ঠ মানুষের স্বার্থবিরোধী এবং বাহাত্তরের মূল সংবিধানের চার মূলনীতির পরিপন্থি।

রাজনীতি কোনো রাজা-গজার স্বার্থে নয়। গণতন্ত্রও তেমন স্বার্থবাদীদের জন্য না। তাকে হতে হবে মানুষের স্বার্থে। এক্ষেত্রে সামান্য বিচ্যুতি ঘটানোর সুযোগ নেই।

জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা যে দলের প্রতীক নিয়েই নির্বাচিত হয়ে সংসদে যাক না কেন, তাদেরকে বাহাত্তরের মূল সংবিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কথা বলতে হবে, কাজও করতে হবে সেভাবে। সরকারি দলও এর পরিপন্থি কোনো কাজ করলে, বিরোধী দল সমালোচনায় উচ্চকণ্ঠ হবে সংসদে।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বাহাত্তরের সংবিধানে ধর্মাশ্রয়ী সব দল ও সংগঠনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল কিন্তু জিয়া আর এরশাদই শুধু তার বিপরীত কাজ করে- তা পূর্ণাঙ্গ সত্য নয়। যেমন, ওই বিধান পঞ্চম ও অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে সম্পূর্ণ সংবিধান পরিপন্থি। সে হিসেবে উচিত ছিল ধর্মাশ্রয়ী দলগুলো নিষিদ্ধ ঘোষণা করা এবং রাষ্ট্রধর্ম নামে যে সংশোধনী এরশাদ তার ব্যক্তিগত ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার জন্য করে তাকেও নির্দ্বিধায় বাতিল করা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, তা করা হয়নি।

সংসদে যারা বিরোধী দল হিসেবে কাজ করছে তারা এই মৌলিক বিষয়ে সরকারি দলের ভূমিকার কোনো সমালোচনা করছে না। জাসদ, ওয়ার্কাস পার্টি ও গণফোরামের প্রতিনিধিত্ব রয়েছে আমাদের সংসদে- এরা সবাই বাম গণতান্ত্রিক দল বলে পরিচিত হলেও জামায়াত ও হেফাজতে ইসলামের মতো উগ্র ধর্মান্ধ দলগুলোকে নিষিদ্ধ করার দাবি তোলা থেকে অজ্ঞাত কারণে বিরত থাকছে।

রাষ্ট্রধর্ম অথবা পঞ্চদশ সংশোধনী, পঞ্চম ও অষ্টম সংশোধনীসহ বাতিলের দাবি তোলা থেকেও তারা বিরত। তাই এদেরকে আদতেই বিরোধী দল বলে বিবেচনা করা যেতে পারে না। এর মধ্যে জাসদ ও ওয়াকার্স পার্টি ১৪ দলের অন্তর্ভুক্ত থাকায় এদের চুপ থাকার একটি যুক্তি পাওয়া যায়। কিন্তু গণফোরাম? এ দলটি তো ১৪ দলে নেই। এ দলটির মেনিফেস্টোতে স্পষ্ট বাহাত্তরের সংবিধান অবিকল পুনরুদ্ধারে দাবি লিখিত থাকলেও সংসদীয় ভূমিকায় এর কোনো প্রমাণ মেলে না। সংসদের বাইরেও এরা কোনো আন্দোলন গড়ে তুলছে না। ফলে, বঙ্গবন্ধুপ্রণীত বাহাত্তরের সংবিধান আজ কার্যত আড়ালে।

বাংলাদেশে বিরোধী দল হিসেবে যে দলটি পরিচিত, সেটি হলো- বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি। দলটি মুক্তিযুদ্ধের অনেক পরে গঠিত। এতে ঠাঁই পায় মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী কিছু উগ্র সাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ। এ জাতীয় শক্তির সঙ্গেও বিএনপি জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে জিতে জামায়াতে ইসলামীর দুই শীর্ষ নেতাকে মন্ত্রিত্বের আসন দিয়ে ‘মহিমান্বিত’ করে। নড়বড়ে ওই জোটটির নাম ২০-দলীয় জোট। তাদের পূর্বসূরি এবং দলটির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান স্বয়ং জামায়াতে ইসলামীসহ ধর্মাশ্রয়ী দলগুলোকে অসাংবিধানিক পন্থায় বৈধতা দেন। তাদের উত্তরসূরী অপর সামরিক শাসক এরশাদ রাষ্ট্রধর্ম সংযোজন করে একই পন্থায়।

হাইকোর্ট, সুপ্রিমকোর্ট জিয়া ও এরশাদের অসাংবিধানিক পন্থায় ক্ষমতা গ্রহণকে অবৈধ ঘোষণা করে। পঞ্চম ও অষ্টম সংশোধনী দুটিকেও সংবিধানবিরোধী, অকার্যকর ও বেআইনি ঘোষণা করার পর ২০১৪ সালে আনীত পঞ্চদশ সংশোধনীতে সর্বোচ্চ আদালতের রায়কে পাশ কাটিয়ে বৈধতা এবং স্থায়ীরূপ দেয় বর্তমান সংসদের আগের সংসদ। তাই দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল এবং প্রধান বিরোধী দল হিসেবে স্বীকৃত বিএনপিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাশ্রয়ী দল বলে বিবেচনা করা রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে অসম্ভব।

এটা পরিষ্কার যে, দেশকে বাঁচানোর স্বার্থে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শকে বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে সরকারি দলের ব্যর্থতা ও বিচ্যুতির কঠোর সমালোচনা করার মতো জনগণের আস্থাশীল কোনো বিরোধী দলের অস্তিত্ব নেই। বাংলাদেশের রাজনীতির মূল সংকটটা এখানেই। আর এ সংকট আমাদের বহুদলীয় সংসদীয় ব্যবস্থাকে সব দিক থেকেই পঙ্গু ও বিবর্ণ করে তুলেছে। ফলে মানুষ ধীরে ধীরে রাজনীতিবিমুখ হয়ে উঠেছে।

এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর আদর্শকেও অম্লান রাখতে হবে। পুনরায় বহাল করতে হবে বঙ্গবন্ধুপ্রণীত বাহাত্তরের সংবিধান। ওই সংবিধানে বর্ণিত চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতিকে বাংলাদেশের সংবিধানে অবিকৃতভাবে সংযোজনও করতে হবে।

লেখক: রাজনীতিক, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক।

এ বিভাগের আরো খবর