ইরানের পরমাণু বোমার উদ্ভাবক ও বিজ্ঞানী মহসেন ফাখিরজাদেহ নভেম্বর ২০২০ সালে খুন হওয়ার পর বর্তমানে বিষয়টি বিশ্ব মিডিয়ায় নতুনভাবে আলোচিত হচ্ছে। ওই সময় ইরান তথা বিশ্ব সংবাদের বরাতে জানা যায়, পরমাণু বিজ্ঞানী ফাখিরজাদেহ নিরাপত্তা রক্ষীদের গুলিতে নিহত হন। ইরানি গোয়েন্দা সংস্থার এমন প্রতিবেদনে সন্তুষ্ট থাকতে পারেননি দেশটির সুপ্রিম লিডার সৈয়দ আলী হোসেইনী খামেনী। কদিন পর খবর প্রকাশিত হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মদদে তাকে খুন করে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ।
উপযুক্ত তথ্য-প্রমাণের অভাবে তেল-আবিবের দিকে আঙুল তুললেও চুপ থাকে তেহরান প্রশাসন। যদিও গত ৭০ বছরে মোসাদের পরিচালনায় ২৭০০ কিলিং অপারেশন পরিচালিত হয়।
ইরানে সামরিক অভিযান না চালিয়েও তেল-আবিবের নির্দেশে ৭ জন পরমাণু বিজ্ঞানীকে হত্যা করে মোসাদ। এ তালিকায় আছেন ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাতও। ইসরায়েলের জাতীয় দৈনিক ইয়েদিওত আহরোনোথের গোয়েন্দা বিষয়ক প্রতিনিধি রোনেন বার্গম্যান তার লেখা বই ‘রাইজ অ্যান্ড কিল ফার্স্ট: দি সিক্রেট হিস্টরি অফ ইসরায়েলস টার্গেটেড অ্যাসাসিনেশনস’-এ এমনটাই উল্লেখ করেন।
বছরের শুরুতে ৩ জানুয়ারি ২০২০ সালে ইসরায়েলের সহযোগিতায় জেনারেল কাশেম সোলাইমানীকে খুন করে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন। বিশ্ব মিডিয়ায় এমন খবর অনেক এসেছে। সোলাইমানী ছিলেন ইরানি সমরনায়ক, ইসলামি বিপ্লবী রক্ষীবাহিনীর একজন দক্ষ মেজর জেনারেল। বলা যায়, রেভ্যুলেশন গার্ডের প্রাণ। জেনারেলকে হারানো ইরানের জন্য সহজ ছিল না। এমন ক্ষতি মেনে নিতে পারেননি দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি। প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠেন তিনি।
মোসাদ সে সুযোগ কাজে লাগাতে ২০২০-এর জানুয়ারি মাসে ইসরায়েল সরকারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে বৈঠকে বসেন তৎকালীন মোসাদ প্রধান ইয়োসি কোহেন। ২০০৯-এর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে ধারাবাহিক বৈঠকে পরবর্তী সময়ে আরও যুক্ত হন ডোনাল্ড ট্রাম্প, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও এবং সিআইএর প্রথম নারী প্রধান জিনা হ্যাসপেল।
মোসাদের যথাযথ সুযোগের অভাবে বার বার বেঁচে যান ইমাম হোসাইন বিশ্ববিদ্যালইয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ফাখরিজাদেহ।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ২০২০-এর নভেম্বরে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী অত্যাধুনিক আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে হত্যা করা হয় এই বিজ্ঞানীকে। একই তথ্য দৈনিক ইসরায়েল টাইমসে প্রকাশিত হলে এর সত্যতার জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। থাকে না সন্দেহের অবকাশ।
কশেম সোলাইমানী ছিলেন ইরানের গার্ড অব রেভ্যুলেশন তথা সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যের অতন্দ্রপ্রহরী। তেল-আবিব ও ওয়াশিংটন বুঝতে পারে পথ থেকে কাঁটা সরাতে হবে। সোলাইমানীর কারণেই সতর্কতামূলক অবস্থানে যায় জার্মান, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য।
যেহেতু এক সোলাইমানীর ওপর ভর করেই ইরান অপ্রতিরোধ্য হতে চায়। তাই মোসাদের সহযোগিতায় সোলাইমানীকে হত্যা করে তেহরানকে বার্তা পাঠায় যুক্তরাষ্ট্র। যদিও এর পেছনে ইসরায়েলের বড় ধরনের স্বার্থ জড়িত ছিল।
নভেম্বর ২০২০-এ ট্রাম্পের পরাজয় ও জো বাইডেনের ক্ষমতায় আসায় এক প্রকার পরিষ্কার হয়ে যায়, বাইডেন প্রশাসন মধ্যপ্রাচ্যে ট্রাম্পের জামাতা জেরার্ড কুশনারের আধিপত্যের ইতি ঘটাবে। আর ইরানের সঙ্গে ২০১৫ সালের চুক্তিতে ফিরতে পারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তখন দখলদার ইসরায়েলের টিকে থাকা হবে এক ধরনের চ্যালেঞ্জ। হত্যা করতে হবে ইরানের পরমাণু অস্ত্রের গবেষক ফাখিরজাদেহকে।
নেতানিয়াহুর ধারণা ছিল, এর ফলে ২০১৫ সালের পরমাণুনীতি ও চুক্তিতে আগ্রহী হবে না ওয়াশিংটন। ইরানও আগ্রহ দেখাবে না। মূলত এখান থেকেই শুরু হয় মোসাদের ফাখিরজাদেহ হত্যাপরিকল্পনা।
ষাট বছর বয়সী ফাখিরজাদেহকে হত্যা করতে ব্যবহৃত হয় বেলজিয়ামের তৈরি এফএনএমজি। মেশিনটি রোবটিক যন্ত্রাংশের সঙ্গে যুক্ত করা ছিল। যা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত। এর ওজন ছিল প্রায় ১ টন। বিশাল এ সরঞ্জাম ইরানে নিয়ে আসা মোসাদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। মোসাদের সদস্যরা চোরাগোপ্তাপন্থা অবলম্বন করে। ভিন্ন ভিন্ন ট্রাকে বিভিন্ন পথে যন্ত্রটি তেহরানে প্রবেশ করে। পরবর্তী সময়ে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রগুলো স্থাপন করা হয় পিকআপ ভ্যানে। যা তেহরানের রাস্তায় সচরাচর দেখা যায়। ফলে সন্দেহমুক্ত থাকে পরিকল্পনাকারীরা। আক্রমণ পরিচালনার জন্য পিকআপ ভ্যানটি রাস্তার ইউটার্নে বসানো হয়। আর এটি পর্যবেক্ষণের জন্য স্থাপন করে অসংখ্য ক্যামেরা। হত্যাকাণ্ডের পর পিকআপ উড়িয়ে দিতে রাখা হয় বিস্ফোরক।
অধ্যাপক ফাখিরজাদেহ ঘটনার দিন সস্ত্রীক নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করে অবকাশে যাচ্ছিলেন। সামনে-পেছনে ছিল নিরাপত্তা রক্ষীদের গাড়ি। অবকাশে যেতে বার বার নিষেধ করে ইরানের গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তারা। ফাখরিজাদেহ বলেন, এত নিষেধাজ্ঞা শুনছি ও মানছি ২০০৯ সাল থেকে। এখনও মানতে হবে!
বছরের পর বছর ধরে এমন সব হুমকি তার কাছে ছিল মামুলি ব্যাপার। আগেও এ বিজ্ঞানী ২০০৯, ২০১১, ২০১৩, ২০১৫ ও ২০১৬-সহ বেশ কবার মোসাদের সম্ভাব্য হত্যাপরিকল্পনা থেকে রক্ষা পান।
অবকাশ যাপনের বাড়িটিতে প্রবেশের আগে ফাখরিজাদেহর সামনে থাকা নিরাপত্তা রক্ষীদের গাড়ি বাড়িটি আগে পর্যবেক্ষণের জন্য গেটের ভেতরে চলে যায়। ফলে ফাখরিজাদেহের গাড়িটি পুরো উন্মুক্ত হয়ে যায় আর পার্ক করা ট্রাকের আগে থাকা স্পিডব্রেকারের কারণে নিরাপত্তাকর্মীদের অন্য গাড়িগুলোরও গতি কম থাকে। এতে, হামলাকারীদের সামনে ড্রাইভিং সিটে থাকা ফাখরিজাদেহকে গুলি করতে কোনো বাধা পোহাতে হয়।
গাড়ি ইউটার্ন নিলে গুলি ছুড়তে কালবিলম্ব করে না কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত বেলজিয়ামের তৈরি এফএনএমজি মেশিনটি। উইন্ডশিল্ডের নিচে গুলি এসে আঘাত হানে। প্রথম গুলিতেই গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন ফাখরিজাদেহ। মাথা বের করেন গাড়ির পাশে। এতে হামলাকারীদের জন্য কাজটা আরও সহজ হয়। মৃত্যু নিশ্চিত হতে উপর্যুপরি গুলি ছোড়া হয়। তিনটি গুলি এসে আঘাত করে মেরুদণ্ড বরাবর। দেহরক্ষী ছুটে এসে আশপাশে কাউকে দেখতে না পেয়ে বিস্মিত হয়!
সেসময় বিস্ফোরিত হয় পাশে থাকা পিকআপটি। যদিও অস্ত্র ও যন্ত্রপাতি অক্ষত থেকে যায়। পুরো পরিকল্পনা বিপত্তিহীন বাস্তবায়িত হলেও বিস্ফোরণের বেলায় সে পরিকল্পনা নষ্ট হয়ে যায় মোসাদের। ৬০ সেকেন্ড সময়ে মোট পনেরোটি গুলি ছোড়ে মোসাদ এ তথ্যও জানায় নিউইয়র্ক টাইমস।
এবার একটু পিছনে ফেরা যাক। ১৯৭৯-এ ইরান বিপ্লবের পর ক্ষমতায় আসেন আয়াতুল্লাহ খোমেনী। ফলে সেখানে বাড়তে থাকে ধর্মীয় নেতাদের প্রভাব। তারা আগের প্রথম পাহলভি শাসক রেজা শাহ পাহলভীর অধিকাংশ আইন বাতিল ঘোষণা করে। অস্বীকার করে ইসরায়েলকে দেয়া ইরানের স্বীকৃতি। তেহরান পরিষ্কার জানিয়ে দেয়, অবৈধভাবে মুসলমানদের ভূমি দখল করা ইসরায়েল দখলদার জাতিগোষ্ঠী।
এদিকে ইসরায়েল অস্তিত্বের জন্য হুমকি হিসেবে দেখতে শুরু করে ইরানকে। তেল-আবিব বলে আসছে ইরানের পরমাণু অস্ত্র থাকা উচিত হবে না। তেহরান শুনছে না কারো কথা, এতে উদ্বিগ্ন ইসরায়েলি নেতারা। শুধু তাই নয়, তাদের আরও ভয়ের কারণ হলো- ইরানসমর্থক সংগঠন ফিলিস্তিনের হামাস, লেবাননের হিজবুল্লাহ, সিরিয়ার বাশার আল আসাদ সর্বদা অস্ত্র তাক করে থাকে তেল-আবিবের দিকে। ফলে চর্তুমুখী সংকট নিয়ে তেল-আবিব হাঁটতে শুরু করে গুপ্তহত্যার দিকে।
কখনও ইরানের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের হত্যা করে, কখনও ধ্বংস করে ইরানের পরমাণু কেন্দ্র। এর পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থাকা ইসরায়েলের জন্য ক্ষতিকর ব্যক্তিদেরকেও ছাড়ে না মোসাদ। প্রশ্ন আসতে পারে, চতুর্মুখী সংকট নিয়ে ইসরায়েলের এতটা প্রভাব খাটানো সম্ভব? সম্ভব এ জন্য যে, তাদের হাতে আছে শক্তিশালী ও চৌকস সামরিক বাহিনী এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাত্মক সহযোগিতা।
লেখক: কলাম লেখক