মহিবুল্লাহ’র হত্যার মধ্য দিয়ে কিছু আশঙ্কা এখন সত্যি হতে চলেছে। বাংলাদেশে আশ্রয় পাওয়া রোহিঙ্গাদের নিয়ে অনেক ধরনের প্রকাশ্য ও গোপন তৎপরতার আশঙ্কা করা হচ্ছিল দীর্ঘদিন থেকেই। বহু দল উপদলে কোন্দল, মায়ানমারে ফিরে যাওয়া না যাওয়া নিয়ে বিতর্ক, বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে প্রতিরোধ গড়ে তোলার বিভিন্ন কর্মকাণ্ড, বিদেশি রাষ্ট্রসমূহের নানামুখী তৎপরতা, মায়ানমারের অন্তর্ঘাতমূলক কার্যক্রমের আশঙ্কা, মৌলবাদী সংগঠনসমূহের নানান পদক্ষেপ, মাদক ও অস্ত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়া, স্থানীয় নানা সন্ত্রাসী গ্রুপের সঙ্গে সম্পর্কের নানা খবর প্রচার মাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরেই পাওয়া যাচ্ছিল। ক্যাম্পগুলোতে আইনশৃঙ্খলার অবনতিও বেশ উদ্বেগজনক। বিগত ৬ মাসে মাদক পাচার, অপহরণ ও ডাকাতির মামলা হয়েছে ৫৬৭টি। আর গত ৪৮ মাসে সংঘর্ষের ঘটনায় নিহত হয়েছে ২২৬, আহত ৩৫৪ জন।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় আট লাখ রোহিঙ্গা। এই রোহিঙ্গা ঢলের সময় মুহিবুল্লাহও বাংলাদেশে আশ্রয় নেন। তিনি গঠন করেন ‘আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইট’ (এআরএসপিএইচ)। তিনি এই সংগঠনের চেয়ারম্যান ছিলেন। আগে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হওয়া আরও তিন লাখসহ ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে মায়ানমারে ফিরিয়ে নেয়ার আন্দোলন ও জনমত গঠনে তার ভূমিকা ছিল।
রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহকে (৫০) পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন তার পরিবারের সদস্যরা। কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং লম্বাশিয়া আশ্রয়শিবিরে অস্ত্রধারীদের গুলিতে তিনি নিহত হন। বেশ কিছুদিন ধরেই মায়ানমারে প্রত্যাবাসন নিয়ে রোহিঙ্গাদের মধ্যে বিরোধ বেশ তীব্র হয়ে উঠেছে। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে গেলে যাদের বেশি ক্ষতি হবে এবং রোহিঙ্গাদেরকে বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে যারা রাখতে চায় তেমন একটি চক্র এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে থাকতে পারে বলেও মনে করছেন অনেকে।
মুহিবুল্লাহ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে থাকতে স্কুলে রোহিঙ্গা ছেলেমেয়েদের পড়াতেন। সবার প্রিয় শিক্ষক ছিলেন তিনি। ভালো ইংরেজি বলতে পারতেন। বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে তিনি চেষ্টা চালিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আলোচনায় আসেন মুহিবুল্লাহ। এ কারণে প্রত্যাবাসনবিরোধী রোহিঙ্গাদের রোষানলে পড়েন তিনি। তাকে নাকি প্রায়ই হুমকি-ধমকি দেয়া হতো।
এরই একপর্যায়ে গত বুধবার রাতে পাঁচটি গুলি করে মুহিবুল্লাহকে হত্যা করা হয়েছে। পরিবারের কথা অনুযায়ী এবং হুমকি দেয়ার কথা বিবেচনায় নিলে এবং অস্ত্রের ব্যবহার লক্ষ করলে এই হত্যাকাণ্ড পূর্বপরিকল্পিত বলে মনে করতে কারো দ্বিধাই থাকার কথা নয়। পত্রপত্রিকার সংবাদ অনুযায়ী স্থানীয় রোহিঙ্গাদের অনেকেই মনে করেন হামলাকারীরা আল-ইয়াকিন নামের একটি রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী দলের সদস্য। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, এই বাহিনীর প্রধান আবদুল হাকিম ওরফে ডাকাত হাকিম বেশ কয়েকবার মুহিবুল্লাকে হত্যার হুমকি দিয়েছিলেন।
মুহিবুল্লাহর ছোট ভাই হাবিবউল্লাহ প্রথমে বলেছিলেন, তার ভাইকে হত্যা করেছে আরসার লোকজন। তিনজনকে তিনি শনাক্ত করতে পেরেছেন। কিন্তু তিনি মামলা করেছেন ‘অজ্ঞাতনামা’ সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে। তিনি কি তাহলে ভয় পেয়েছেন নাকি এটা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হয়রানি করার প্রচেষ্টা সেটাও বিবেচনা করতে হবে। নানা উপদলীয় কোন্দলের যে আভাস পাওয়া যাচ্ছে এই অভিযোগ যে তার পালে বাতাস না দেয়।
পুলিশ ও স্থানীয় রোহিঙ্গারা জানায়, ২০১৯ সালে ২৫ আগস্ট উখিয়ার কুতুপালং শিবিরের ফুটবল মাঠে কয়েক লাখ রোহিঙ্গার উপস্থিতিতে গণহত্যাবিরোধী যে মহাসমাবেশ হয়েছিল, তা সংগঠিত করেছিলেন মুহিবুল্লাহ। ওই মহাসমাবেশে মুহিবুল্লাহ রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রদান, নিরাপত্তা, রাখাইনে ফেলে আসা জন্মভিটা ফেরতসহ সাত দফা পূরণ না হলে কোনো রোহিঙ্গা মিয়ানমারে ফিরে যাবে না বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। তার উত্থাপিত এই দাবি রোহিঙ্গাদের মধ্যে যেমন জনপ্রিয় হয়েছে, তেমনি এখনও সেই দাবিতে অনড় রোহিঙ্গাদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ।
কক্সবাজার শহর থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে উখিয়ার কুতুপালং বাজার। সেখান থেকে পশ্চিমদিকে ইটের কাঁচা রাস্তায় প্রায় তিন কিলোমিটার গেলে লাম্বাশিয়া রোহিঙ্গা শিবির। কয়েকটি পাহাড় নিয়ে গড়া এই আশ্রয়শিবিরে অন্তত ৭০ হাজার রোহিঙ্গার বসতি। আশপাশে থাকা আরও ২২টি শিবির নিয়ে গড়ে ওঠে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শরণার্থীর আশ্রয়শিবির ‘কুতুপালং মেগা ক্যাম্প’, যেখানে অন্তত ৯ লাখ রোহিঙ্গার বসবাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই লম্বাশিয়া শিবিরের রোহিঙ্গাদের অনেকের মতো ২৫ আগস্টের মহাসমাবেশের পর থেকে মুহিবুল্লাহ প্রত্যাবাসনবিরোধী দেশি-বিদেশি চক্রের রোষানলে পড়েন। মিয়ানমারে ফিরে যাওয়া যাদের পছন্দ নয়, তাদের পরোক্ষ ইন্ধনে এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়ে থাকতে পারে বলে অনেকেই মনে করছেন।
এর আগেও উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন আশ্রয়শিবিরে সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর মধ্যে সংঘাত, গোলাগুলিতে খুন হয়েছেন বহু রোহিঙ্গা। আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছেন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী। ক্যাম্পের অভ্যন্তরে খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, নারী-শিশু পাচার, ইয়াবা ও স্বর্ণের ব্যবসাও রমরমা। বিশেষ করে সন্ধ্যার পর আশ্রয়শিবিরগুলো থাকে অরক্ষিত, আতঙ্কে রাত কাটান সাধারণ রোহিঙ্গারা। মুহিবুল্লাহকে হত্যার পর এই আতঙ্ক আরও বেড়েছে। ক্যাম্পের বর্তমান পরিস্থিতি, আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা, সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর অপতৎপরতা, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন, স্থানীয় জনগণের অভিমতসহ নানা বিষয় এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।
মুহিবুল্লাহ’র মৃত্যু অনেকগুলো প্রশ্ন উত্তর পাওয়ার দাবি রাখে। যেমন- বলা হচ্ছে ১২-১৪টা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আছে। এসব গোষ্ঠীর কার্যক্রম চালানোর পদ্ধতি এবং টাকার উৎস কী? বাইরে থেকে সরবরাহ করা হচ্ছে নাকি ইয়াবা ও সোনার ব্যবসা থেকে টাকা জোগাড় হচ্ছে? ক্যাম্পে নাকি এই দুই ব্যবসা এখন অনেকটা প্রকাশ্য। কাঁটাতারের বেড়া আছে, তারপরও রোহিঙ্গারা ক্যাম্প ছেড়ে পালাচ্ছে কেন? ভাসানচরে যেসব রোহিঙ্গাকে স্থানান্তর করা হলো, সেখান থেকেও কিছু পালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় অথবা ক্যাম্পে ফিরে আসছে। মাঝে মধ্যেই খবর প্রকাশিত হচ্ছে যে, দালালের মাধ্যমে কিছু রোহিঙ্গা অবৈধভাবে নৌপথে মালয়েশিয়া চলে যাচ্ছে। বেশ কিছু সংখ্যক নারী–শিশু পাচার হচ্ছে। এগুলো নিয়ে স্থানীয়রা দুশ্চিন্তা, আতঙ্ক ও ভীতিকর পরিস্থিতিতে আছে।
রোহিঙ্গারা যেন কাঁটাতার ডিঙিয়ে বাইরে যেতে না পারে, সে ব্যাপারে আইনি তৎপরতা থাকলেও বাস্তবে বাইরে চলে আসার বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে। ক্যাম্পের ভেতরে রোহিঙ্গাদের বড় যে ১০ হাজারের অধিক দোকানপাট রয়েছে, তার কি কোনো অনুমতি আছে? শরণার্থীদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করছে সরকার, তাহলে দোকানপাটে কি কেনাবেচা হয়? তারা যখন ব্যবসা করছে তখন এই ব্যবসা ঘিরেই নানা সমস্যার জন্ম হচ্ছে। তারা ব্যবসা করছে মানেই টাকার প্রবাহ আছে। অভিযোগ আছে যে, এদের অনেকেই মাদক ও সোনার চোরাচালান করে চাহিদার অতিরিক্ত টাকা পাচ্ছে, এই টাকা কী কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে তা নিয়ে এখন ভাবার সময় এসেছে।
ভবিষ্যৎ নিয়ে তো যেকোনো মানুষই ভাবে। যখন কেউ তার কোনো সম্ভাবনা দেখে না তখন এমন কোনো কার্যকলাপ নেই, যা তারা করতে পারে না। অনিশ্চয়তা এবং অসহায়ত্ব মানুষকে বেপরোয়া করে তুলতে পারে তা পৃথিবীর সব দেশের শরণার্থী শিবিরগুলোর দিকে তাকালে বুঝতে পারা যায়। সেরকম আশঙ্কার কথা কি উড়িয়ে দেয়া যায়? বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের দীর্ঘ মেয়াদে রাখা হলে নানা ধরনের সমস্যার উদ্ভব হবে তা সবাই বলছেন। ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে থাকার জন্য যে জায়গা দেয়া হয়েছে, জনসংখ্যা বাড়লে সেখানে ধারণ করা সম্ভব হবে না।
পরবর্তী সময়ে তাদের বিভিন্ন জায়গা স্থানান্তর করতে হবে। তখন স্থানীয় জনগণের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের মেলামেশা, বিয়েশাদিসহ ব্যবসায়িক আর্থিক লেনদেন ও সামাজিক আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে উঠবে। ইতোমধ্যেই রোহিঙ্গারা ব্যবসা–বাণিজ্য করতে শুরু করেছে ভবিষ্যতে তা আরও বাড়বে। সারা দেশে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে পড়ার সুযোগ খুঁজছে ওরা এবং বেপরোয়া ও সাহসী বলে বিভিন্ন সন্ত্রাসী গ্রুপ তাদেরকে কাজে লাগাতে চাইবে। ফলে সবকিছু মিলিয়ে এই অঞ্চলের মানুষ নানা ধরনের ঝুঁকিতে পড়ে যাবে। জীবনযাত্রার মান এবং সামাজিক রাজনৈতিক কাজেও এর প্রভাব পড়বে।
নিজের দেশে কে না ফিরে যেতে চায়। সাধারণ রোহিঙ্গাদের ক্ষীণ হলেও মায়ানমারে ফিরে যাওয়ার আশা জাগিয়ে রেখেছিলেন মুহিবুল্লাহ। তার মৃত্যুতে দেশে প্রত্যাবাসন বিলম্বিত হতে পারে— এই দুশ্চিন্তা এখন ক্যাম্পের রোহিঙ্গাদের মনে। কারা মুহিবুল্লাহকে খুন করল, কেন খুন করল, রোহিঙ্গার প্রত্যাবাসন ভবিষ্যত কী হবে— এসব এখন রোহিঙ্গাদের ভাবনার প্রধান বিষয়। অনেকেই বলছেন, মুহিবুল্লাহর মতো নেতা রোহিঙ্গাদের মধ্যে এখন তো আর কাউকে তারা দেখছে না।
২০১৯ সালে ২৫ আগস্ট উখিয়ার কুতুপালং শিবিরের ফুটবল মাঠে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা গণহত্যাবিরোধী যে মহাসমাবেশটি হয়েছিল— তা সংগঠিত করেছিলেন মুহিবুল্লাহ। ওই মহাসমাবেশের পর থেকে মুহিবুল্লাহ প্রত্যাবাসনবিরোধী দেশি-বিদেশি চক্রের রোষানলে পড়েন। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে গেলে যাদের বেশি ক্ষতি হতে পারে, তাদের কোনো চক্রান্ত কি কাজ করেছে মুহিবুল্লাকে হত্যার পেছনে বিবেচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এই প্রশ্ন ঘুরছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কথাতেও তার কিছুটা ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তিনি বলেছেন, রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহর হত্যাকারীদের অবশ্যই বিচারের সম্মুখীন করা হবে। তিনি নিজদেশ মিয়ানমারে ফেরত যেতে চেয়েছিলেন, সেকারণে কিছু স্বার্থান্বেষী মহল তাকে হত্যা করেছে বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। এরকম কথা চালাচালি হয়তো অনেক হবে, দায় কার, দায়িত্ব কে নেবে সে আলোচনাও চলবে কিন্তু সংকট যেন দীর্ঘস্থায়ী না হয় সে বিষয়টা গুরুত্বের সঙ্গেই ভাবতে হবে।
লেখক: রাজনীতিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক।