বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

চুল শুধু চুল নয়

  • আহমেদ রিয়াজ   
  • ২ অক্টোবর, ২০২১ ১৫:৪৩

একসময় নারী-পুরুষ সবার মাথাতেই থাকত দীর্ঘ চুল। তখন বিশ্বাস ছিল দীর্ঘ চুল ক্ষমতা, শক্তি এবং এমনকি স্বাধীনতার প্রতীক। প্রাচীন গ্রিসের ভাস্কর্যগুলোর দিকে তাকালেই লম্বা চুলের বাহার চোখে পড়ে। শৈশবেই গ্রিক শিশুদের চুল কেটে দেয়া হতো, কিন্তু পরবর্তী সময়ে তারা চুল বড় রাখত। প্রাচীন অ্যাথেনা নগরীর পুরুষদের দীর্ঘ চুল রাখতেই হতো দাসপুরুষদের থেকে পার্থক্য বোঝার জন্য। সেসময় দাসদের চুল জোর করে কেটে ছোট রাখা হতো।

চুল কাটা নিয়ে তরুণরা এতটা ফুঁসে উঠবে, সেটা হয়ত ম্যাডাম ইয়াসমিন ভাবেননি। ২৬ সেপ্টেম্বর সিরাজগঞ্জের রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বাংলাদেশ অধ্যয়ন বিভাগের প্রথম বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষার হলে ঢোকার সময়কার ঘটনা। বিভাগের চেয়ারম্যান ও সহকারী প্রক্টর ফারহানা ইয়াসমিন বাতেন কাঁচি হাতে দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। হলে ঢোকার সময় ১৪ শিক্ষার্থীর মাথার চুল তার হাতের মুঠোর ফাঁক গলে বেরিয়ে গিয়েছিল, তাদের সামনের অংশের বেশ খানিকটা তিনি কেটে দেন।

বিষয়টাকে অপমানজনক ধরে নিয়ে প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন শিক্ষার্থীরা। এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় উত্তপ্ত। তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। ম্যাডাম তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছেন। সর্বশেষ খবর, ম্যাডামকে আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ে সাময়িক বরখাস্তও করা হয়েছে।

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে না হয় একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের চুলের ‘চুলোচুলি’ থামানো গেল। কিন্তু কথা হলো- শিক্ষার্থী তথা তরুণদের চুল নিয়ে অনেকের এত সমস্যা কেন? যদিও চুল নিয়ে কিছু ক্ষমতা দেখানেঅলাদের চুলবুলুনি নতুন নয়। বিশেষ করে তরুণদের বড় চুল দেখলেই তাদের চুলবুলুনি চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়। তাদের রাগ উগড়ে ওঠে। নাপিত না হয়েও তারা সেই রাগমোচন করেন চুল কেটে বা ছেঁটে দিয়ে। মনে আছে, তরুণদের বড়

চুলের প্রতি স্বৈরাচার হুসেইন মুহম্মদ এরশাদেরও ভীষণ গোস্বা ছিল। তখন বড় চুলের কোনো তরুণকে পেলেই রাস্তাঘাটে নানাভাবে হেয় করা হতো। এমনকি নির্যাতন পর্যন্ত। কেবল এরশাদ নয়, দুনিয়ার অনেক দেশের স্বৈরাচারই তরুণদের দীর্ঘ চুল কেটে দিয়ে তাদের কঠোর শাসনের নমুনা দেখিয়েছেন।

পুরুষের ছোট আর নারীর বড় চুলের প্রথা তো এই সেদিনের। একসময় নারী-পুরুষ সবার মাথাতেই থাকত দীর্ঘ চুল। তখন বিশ্বাস ছিল দীর্ঘ চুল ক্ষমতা, শক্তি এবং এমনকি স্বাধীনতার প্রতীক। প্রাচীন গ্রিসের ভাস্কর্যগুলোর দিকে তাকালেই লম্বা চুলের বাহার চোখে পড়ে।

শৈশবেই গ্রিক শিশুদের চুল কেটে দেয়া হতো, কিন্তু পরবর্তী সময়ে তারা চুল বড় রাখত। প্রাচীন অ্যাথেনা নগরীর পুরুষদের দীর্ঘ চুল রাখতেই হতো দাসপুরুষদের থেকে পার্থক্য বোঝার জন্য। সেসময় দাসদের চুল জোর করে কেটে ছোট রাখা হতো।

জুলিয়াস সিজারের আমল থেকে বদলে যেতে শুরু করে এই প্রথা। স্বৈরাচার সিজার তার সৈন্যদের চুল ছোট করে ফেলার আদেশ দিয়েছিলেন। তার ধারণা ছিল চুলের প্রতি মনোযোগ দিতে গিয়ে যুদ্ধের প্রতি সৈন্যদের মনোযোগ কমে যায়। ইউরোপের অন্য সৈন্যদের থেকে নিজের সৈন্যদের সহজে চেনার জন্যও সৈন্যদের চুল ছোট রাখার নির্দেশ দেয়াটাও আরেকটু কারণ।

তখন ইউরোপের অন্যদেশের সৈন্যদের চুল ছিল বড়। অনেক ঐতিহাসিকের মতে, সেই থেকে যোদ্ধা পুরুষের ছোট চুলের প্রচলন শুরু হয়। এদিকে উনিশ শতকের ইতালিতে একটা শব্দ প্রচলিত ছিল, ক্যাপিলাত্তি। শব্দটার অর্থ ‘দীর্ঘ চুলের পুরুষ’। কিন্তু পরবর্তীকালে এ রীতি বদলে যায়।

ইতিহাসবিদ রবার্ট বারলেটে জানিয়েছেন- ‘ক্যান্টারবারির গথিক আর্চবিশপ ‘মেয়েদের মতো’ দীর্ঘচুলের তরুণদের চুল কেটে না আসা পর্যন্ত আশীর্বাদ করতেন না। তার মানে তরুণদের দীর্ঘচুলের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করা মানুষ সে যুগে ইউরোপেও ছিল। তবে নানান ছবিতে প্রাচীন মায়া সভ্যতার পুরুষদের কিন্তু দীর্ঘ চুলেই দেখা যায়। মায়া সভ্যতায় নারী-পুরুষ সবার চুলকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবেই দেখা হতো। আর শাস্তি হিসেবে চুল কেটে দেয়ার রেওয়াজ ছিল। ভাইকিংরাও পুরুষদের দীর্ঘ চুলের কদর করত।

ওদিকে প্রচ্যেও একসময় পুরুষের দীর্ঘ চুলের কদর ছিল। নানা স্টাইলে বড় চুল রাখাই ছিল সাধারণ নারী ও পুরুষদের জন্য সাধারণ বিষয়। কিন্তু পুরুষের বড় চুলের শৈলীতে ধস নামল জাপানের এডো সাম্রাজ্যের সময়। ১৬০৩ থেকে ১৮৬৭ সাল পর্যন্ত তিনশ বছর ছিল জাপানে এডো বা টকুগাওয়া সাম্রাজ্যের সময়। এসময় নির্দেশই দেয়া হয়, পুরুষদের মাথা চুলহীন মানে টাক করে ফেলতে হবে। যাতে যুদ্ধের সময় শিরস্ত্রাণ বা হেলমেট পরতে কোনো ঝামেলা না হয়। তবে এতদিন পুরুষের ছোট আর নারীর লম্বা চুল রাখা না রাখার বিষয়টি নিতান্তই আঞ্চলিক শাসকের খেয়ালখুশির ওপর নির্ভর করত।

বিশাল পরিসরে এর চল শুরু হয় প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। যোদ্ধা পুরুষের চুল ছাঁটার প্রচলন তখন দেশে দেশে এমনিতেই শুরু হয়ে গেছে। এসময় ইউরোপ হয়ে উঠছিল শিল্পোন্নত। কলকারখানায় কাজ করা শ্রমিক পুরুষদের চুল ছোট রাখার নির্দেশ জারি হতে লাগল, যাতে যন্ত্রপাতিতে দীর্ঘ চুল আটকে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা না ঘটে। আর এভাবেই গড়পড়তায় পুরুষের ছোটচুলের রেওয়াজ চালু হয়ে গেল। চলল দীর্ঘদিন।

উনিশ শতকের ষাটের দশক থেকে শুরু হলো পুরুষের দীর্ঘ চুলের প্রতি ক্ষমতাবান গোষ্ঠীর বিরূপ আচরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও বিদ্রোহ। যার নেতৃত্ব দেয় বিখ্যাত সংগীত দল দ্য বিটলস এবং দ্য রোলিং স্টোন। লম্বা চুলের প্রতি প্রতিবাদ হোক আর স্টাইলের কারণেই হোক পশ্চিমা তরুণরা গা ভাসিয়ে দিল এই স্রোতে। লম্বা চুল রাখতে শুরু করল অনেক তরুণ। সেই ঢেউ ছড়িয়ে পড়ল বিশ্বের নানা জায়গায়। বাংলাদেশের বিখ্যাত ব্যান্ড গায়ক কিংবা বাউল গায়ক-অনেকেই লম্বা চুলধারী।

দুনিয়াখ্যাত মনীষী হিসেবে যাদের সঙ্গে তরুণদের পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়, যাদেরকে আদর্শ হিসেবে তরুণরা এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে তাদের অনেক পুরুষই দীর্ঘ চুলের অধিকারী। নিউটন থেকে আইনস্টাইন, শেক্সপিয়র থেকে দার্শনিক রজনিশ, ভাস্কর-আঁকিয়ে ও বিজ্ঞানী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি থেকে কবি জন মিল্টন, রবীন্দ্রনাথ-নজরুল থেকে গুণী এপিজে আবুল কালাম আজাদ, তবলা বাদক জাকির হুসেন, গায়ক জেমস-হাসানসহ আরও অনেকেই দীর্ঘ চুলধারী। এর অর্থ বিজ্ঞানী, দার্শনিক, কবিসহ অনেক জ্ঞানী-গুণীর মাথাভরা ঝাঁকড়া দীঘল চুল ছিল এবং আছে।

এমনকি বিভিন্ন ধর্মশাস্ত্রেও পুরুষের দীর্ঘ চুলের বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে। শিখ পুরুষদের চুল না কেটে আজীবন দীর্ঘচুল রাখার ঐতিহ্য রয়েছে। লম্বা চুল শিখদের জীবনীশক্তি বোঝায়। ইহুদিরা ছোট চুল রাখাকে দুঃখের প্রতীক হিসেবে ধরে। গৌতম বুদ্ধের মাথায়ও লম্বা চুল ছিল। বিভিন্ন হাদিস থেকে জানা যায়, হজরত মুহম্মদ (সা.)-এর চুল ছিল প্রায় কাঁধ পর্যন্ত।

চুল কি কেবলই সৌন্দর্য? না। ব্যক্তিত্ব ফুটিয়ে তোলে চুল। প্রকাশ করে চিন্তা, বুদ্ধিমত্তা ও শক্তি। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে চুল বড় হবেই। তবে বিজ্ঞানীদের মতে, চুল লম্বা হলে আমাদের মাথা প্রাকৃতিকভাবে আরও বেশি ফসফরাস, ক্যালসিয়াম আর ভিটামিন ডি ধারণ করতে পারে। এই ধারণ করা খনিজগুলো দুটো টিউবের মাধ্যমে আমাদের মগজে ঢুকে পড়ে। মানবমগজ হয়ে ওঠে আরও বেশি শক্তিশালী ও কার্যকর। আর এর ফলে মানব শরীর হয় আরও শক্তপোক্ত, আরও বেশি কষ্টসহিষ্ণু এবং সহনশীল।

একসময় মানুষের বিশ্বাস ছিল চুল কাটলে অতিরিক্ত শক্তি হারিয়ে যায়। হজমশক্তি কমে যায়। চুলকে মনে করা হয় শরীরের অ্যান্টেনা। এই অ্যান্টেনা সূর্য থেকে শক্তি সংগ্রহ করে মগজে চালান করে।

ভারতের প্রাচীন সন্ন্যাসীরা যে কারণে তাদের চুল রাখতেন লম্বা। শুধু তাই নয়, লম্বাচুল শক্ত করে মাথার উপর প্যাঁচিয়ে খোঁপা করে রাখতেন। মাথার উপরে থাকা এই চুলপিণ্ড মগজের মাঝখানের পাইনাল গ্রন্থিগুলোকে উদ্দীপ্ত করে। যার ফলে উচ্চ বুদ্ধিদীপ্ত কর্মতৎপরতা বেড়ে যায়।

শুধু তাই নয়, আন্তশারিরীক চৌম্বকশক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে চুল, যা জীবনীশক্তি ও কোনো কিছু বুঝতে পারার ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে। সুতরাং দীর্ঘচুলকে হেলাফেলা করা মোটেও ঠিক নয়। তাহলে প্রশ্ন, তরুণদের দীর্ঘ চুল নিয়ে ক্ষমতাবানদের এত চুলবুলুনি কেন?

চুল নিয়ে এই চুলবুলুনি এসেছে মূলত স্বৈরাচার শাসকগোষ্ঠীর তরফ থেকে। তারা কখনও মুক্তচিন্তা, স্বাধীন স্টাইল মেনে নিতে পারে না। আর আমাদের অনেকের মধ্যেই ভিন্নমত, ভিন্ন চিন্তাধারাকে মেনে নেয়ার ক্ষমতা নেই। স্বৈরাচার শাসকদের ক্ষমতা দেখানোর চর্চা থেকে আমরাও বের হতে পারছি না।

শিক্ষার্থীরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসে শিক্ষা নেয়ার জন্য। জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা করতে। চুল চুলকাতে নয়। আর যদি বড় চুল আদব-কায়দা, সব গিলে খায়, তবে এসব শেখানোর সময় তো ওটা নয়। এসব শেখাতে হয় স্কুলে ভর্তির আগে। যেটা এক সময় গ্রামের টোল থেকে শেখানো হতো। এখন টোলও নেই, আর আদব-কায়দারও বালাই নেই। তবে জাপানিরা কিন্তু স্কুলে ভর্তির আগে এসব শিখিয়ে নেয় তাদের শিশুদের। এমনকি রান্নাবান্না পর্যন্ত। শিক্ষাটা সেরকম না করে আমরা বড় চুল দেখলেই হামলে পড়ি।

বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা শিক্ষা নিতে যান, তারা কেউ অপ্রাপ্তবয়স্ক নন। সবার বয়সই আঠারোর বেশি। ব্যক্তিস্বাধীনতা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, ব্যক্তিচিন্তা-এসব কিছুর বিস্তার ঘটে এসময়। চুল নিয়ে চুলবুলুনির সময় কোথায়?

বাবড়ি চুলের কবি কাজী নজরুল ইসলাম ‘খালেদ’ শিরোনামের কবিতায় লিখেছেন-

“...বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে আমরা তখনও বসে

বিবি-তালাকের ফতোয়া খুঁজছি ফেকা ও হাদিস চষে!...”

বিশ্ব যখন জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চায় এগিয়ে গেছে অনেকখানি, আমরা তখনও চুল নিয়ে চুলবুলুনি চালিয়েই যাচ্ছি।

লম্বা চুলের বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘কণিকা’ কাব্যগ্রন্থের ‘প্রবীণ ও নবীন’ কবিতায় লিখেছেন-

“পাকা চুল মোর চেয়ে এত মান্য পায়,

কাঁচা চুল সেই দুঃখে করে হায় হায়।

পাকা চুল বলে, মান সব লও বাছা,

আমারে কেবল তুমি করে দাও কাঁচা।”

কিন্তু চুলই যদি না থাকে তাহলে পাকবে কী! আর মান্যটাইবা পাবে কে? আর সবচেয়ে বড় কথা হলো- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও কি জানতেন, তার নামে নামকরণ করা বিশ্ববিদ্যালয়ে চুল নিয়ে এরকম চুল কাটাকাটি হবে?

লেখক: শিশুসাহিত্যিক, প্রবন্ধকার।

এ বিভাগের আরো খবর