সহজে প্রচুর টাকার মালিক হওয়ার ফাঁদে পড়ে হাঁসফাঁস করছে অনেক মানুষ। এখন টাকা ফেরত পেতে মিছিল প্রতিবাদ করছে। পুলিশের লাঠিপেটা খাচ্ছে। এসব দেখে মনে হয় সেই বিখ্যাত গানের কথা! আব্বাস উদ্দিনের কণ্ঠে সেই অবিস্মরণীয় গান- ‘ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে।’ সেই গানের এক জায়গায় আছে, ‘ফান্দ পাতাইছে ফান্দুয়া রে পুঁটি মাছ দিয়া।’ পুঁটি মাছ খাওয়ার লোভে বগার জীবনটাই চলে গেল।
ফাঁদে আঁটকে পড়া বগাকে দেখে বগি কাঁদছে। এটা তো শুধু গান নয় এ যেন জীবন থেকে পাওয়া জ্ঞান। এদেশের মানুষের ফাঁদে পড়ার বেদনাময় অভিজ্ঞতা হয়েছে যে কতবার। কিন্তু শিক্ষা পরিপূর্ণ হচ্ছে না বা চমকে প্রভাবিত হচ্ছে দ্রুত, তাই একের পর এক ফাঁদে ধরা পড়ছে বার বার।
পত্রিকার পাতা ভর্তি হয়ে আছে এরকম নানা প্রতারণার গল্পে। প্রতারণার ফাঁদে ফতুর হয়ে যাচ্ছে ভাগ্য ফেরানো বা সস্তায় জিনিস পাওয়ার প্রত্যাশায় টাকা বিনিয়োগ করা মানুষ। এমএলএম ও ই-কমার্সের নামে ৪০ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে বলে রিপোর্ট হয়েছে পত্রিকায়।
এদের মধ্যে ডেসটিনি ও যুবক নিয়েছে সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা, ইউনিপেটুইউ ৬ হাজার কোটি টাকা, এহসান গ্রুপ ১৭ হাজার কোটি, ই-অরেঞ্জ ১ হাজার ১০০ কোটি ও আইসিএল ৩ হাজার কোটি টাকা জনগণের কাছ থেকে নিয়েছে বলে প্রকাশিত। এসব ঘটনায় অতীতে অনেক মামলা হয়েছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে মালিক গ্রেপ্তার হয়েছে কিন্তু টাকা ফিরে পায়নি গ্রাহক। দ্রুত লাভের আশায় টাকা দিয়ে লাভ তো দূরের কথা, আসল টাকা ফিরে না পেয়ে লাখ লাখ মানুষ আক্ষরিক অর্থেই পথে বসেছে। আর বিস্ময়কর উত্থান ঘটেছে কিছু মানুষের।
প্রতারিত হওয়ার কত পথ যে খোলা আছে দেশবাসীর জন্য, তা হিসাব করে বলা মুশকিল। গণমানুষের সবচেয়ে নির্ভর করার জায়গা বা শেষ আশ্রয় হলো রাজনীতি। রাজনীতির মাধ্যমেই তো নির্ধারিত হয় একটা রাষ্ট্র বা সমাজ চলবে কীভাবে। রাজনীতিবিদদের আহবানে মানুষ সাড়া দেয়, সংগ্রামে নামে, জীবন দেয় একটা নতুন সম্ভাবনা বা সৃষ্টির আশায়। কিন্তু যখন সেই রাজনীতিতে সবচেয়ে বেশি প্রতারিত হয় তখন হতাশার সীমা থাকে না।
যদিও রাজনীতিতে প্রতারিত হলে তার ফল সুদূরপ্রসারী কিন্তু সাময়িক বা তাৎক্ষণিক প্রভাব সাধারণভাবে বোঝা যায় না। আবার যখন বুঝতে পারা যায় তখন করার তেমন কিছু থাকে না। তখন সেই আপ্তবাক্য বলতে থাকেন সবাই, রাজনীতি মানেই ঠকানো ভদ্র ভাষায় যাকে বলা হয় কৌশল। এই কৌশল চলছে অর্থনীতিতে সর্বস্বান্ত হচ্ছে মানুষ এবং হারিয়ে ফেলছে মানুষের ওপর আস্থা ও বিশ্বাস। প্রতারকরা তা বুঝতে পারে ভালোভাবেই। তাই নতুন কৌশলে নতুন ফাঁদ পাতে।
হুন্ডি কাজলের কথা মানুষ প্রায় ভুলেই গেছে। হাজার হাজার মানুষকে সর্বস্বান্ত করে প্রচার মাধ্যমে আলোড়ন তোলা সেই কাজলের কী হয়েছে? মানুষ কি তার টাকা ফেরত পেয়েছে? কিংবা নিকট অতীতে যুবক, ডেসটিনি, ইউনিপেটুইউ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান যে হাজার হাজার কোটি টাকা মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছিল, প্রায় দুই দশক তো পার হয়ে গেল, টাকা কি উদ্ধার হলো?
এসব প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় কীর্তি ভুক্তভোগী ছাড়া অন্যরা যখন ভুলেই গিয়েছে, তখন দেশে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে নতুন ধরনের প্রতারণা শুরু হয়। ই-কমার্স, অনলাইন মার্কেটিং ইত্যাদি ডিজিটাল ভাষা আর ভার্চুয়াল পদ্ধতি ব্যবহার করে নতুন কায়দায় প্রতারণার ব্যবসা ছড়িয়ে পড়েছে দেশের কেন্দ্র থেকে প্রান্ত পর্যন্ত।
কিছুদিন ধরে ভুক্তভোগীদের ক্ষোভ-বিক্ষোভ, আবেদন-নিবেদনের ফলে একের পর এক আলামত উদ্ঘাটিত হতে শুরু করেছে। পত্রিকার পাতায় প্রকাশিত সেসব খবরের কিছু যেমন : ‘ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জের মালিকপক্ষ প্রতারণামূলকভাবে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে।’ ‘অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে প্রতারণার মাধ্যমে অন্তত ৫৮৯ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ধামাকা শপিং নামের একটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান।’ দীর্ঘদিনের প্রতারণার পুঞ্জীভূত প্রকাশ ঘটছে প্রতিদিন।
রীতিমতো বিজ্ঞাপন দিয়েই নির্দিষ্ট পণ্য কিনলে ১০০ থেকে ১৫০ শতাংশ পর্যন্ত অস্বাভাবিক ‘ক্যাশব্যাক’ অফার দিয়ে ব্যবসা করছিল ডিজিটাল বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ইভ্যালি। বিজ্ঞাপন দিয়েছে সর্বত্র। আড়ালে থাকেনি ব্যবসা কিন্তু আড়ালে রেখেছিল তার ব্যবসাকৌশল।
অবিশ্বাস্য অফার, সস্তায় জিনিস কিনে লাভবান হওয়ার লোভে আকৃষ্ট হয়ে কত গ্রাহক যে পঙ্গপালের মতো ছুটেছে আর তাদের কী পরিমাণ টাকা আটকে ফেলেছে প্রতিষ্ঠানটি, তার কোনো সঠিক হিসাব এখনও পাওয়া যায়নি। এ প্রতারণা ব্যবসায় নতুনমাত্রা যুক্ত হয়েছে মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগানোর মাধ্যমে। শরিয়াহভিত্তিক সুদমুক্ত বিনিয়োগের কথা বলে এহসান গ্রুপ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ১০ হাজার ধর্মপ্রাণ গ্রাহকের কাছ থেকে ১৭ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে মামলা হয়েছে। ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন মূল হোতা।
বেরিয়ে আসছে ধর্মবিশ্বাসকে পুঁজি করে ব্যবসায়িক প্রতারণার ভয়াবহ নজির। সুদ খাওয়া হারাম তাই সুদ নয়, মুনাফার অংশ দেয়া হবে এবং পরিমাণে তা সাধারণ ব্যাংকের চেয়ে অনেক বেশি। শুধু মুনাফা পাবে তাই নয়, বেহেস্তে যাওয়াও সম্ভব হবে এখানে টাকা বিনিয়োগ করলে। এই কথা বলে বিশ্বাস করানোর জন্য ওয়াজ এবং ধর্মীয় সভায় পরিচিত মাওলানাদের নিয়ে গিয়েছে তারা। তাতে কেউ কেউ তাদের জমি বিক্রি করে, পেনশনের টাকা থেকে লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছে।
একটি দুটি নয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ ১৪টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে জনগণের অর্থ আত্মসাতের পর বিদেশে পাচারের অভিযোগ পেয়েছে।
দুই লাখ টাকা জমা রাখলে মাসে ১৬ কিংবা ১৮ হাজার টাকা মুনাফা দেয়ার অবিশ্বাস্য এসব অফার কীভাবে দেয়া হয়, একটু মাথা খাটালেই সেটা ধরে ফেলা যায়। দুই তিন মাস ১৫০–২০০ শতাংশ হারে মুনাফা দিয়ে পুরো টাকাটাই গায়েব করে দিলে টাকা দিতে সমস্যা কী? আর সদস্য বা গ্রাহকদের ওপর নতুন সদস্য জোগাড়ের ভার থাকলে নতুন সদস্যদের জমা করা টাকা থেকেই পুরোনোদের ‘কমিশন’ অথবা ‘উচ্চহারে’ মুনাফা দেয়া সম্ভব। খুব হিসেব করে চালাতেন তারা ব্যবসা।
নতুন সদস্যের আগমন বন্ধ হয়ে গেলে, অর্থাৎ ক্যাশ ফ্লো থেমে গেলেই সবকিছু গুটিয়ে উধাও হয়ে যান উদ্যোক্তারা। যেন ভোজবাজির মতো হাওয়া হয়ে যায়। পড়ে থাকে প্রতারিত গ্রাহক, যারা নিজের সম্বল বা ঋণ করে লাভের আশায় লোভের ফাঁদে পা দিয়েছিলেন।
একই ব্যাপার ঘটেছে অবিশ্বাস্য ছাড়ে পণ্য বিক্রির জন্য আগাম নেয়া টাকার ক্ষেত্রেও। নতুন গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে পুরোনোদের উচ্চহারের ক্যাশব্যাক এবং অস্বাভাবিক মূল্যছাড় দেয়া হয়। সুবিধা পেয়ে তারা আবার ব্যাপক প্রচার করে ফলে আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধবরা আগ্রহী হয়ে ওঠে।
এভাবেই চলে প্রতারণার নতুন বিস্তার। কিন্তু যদি নতুন গ্রাহকের সংখ্যা না বাড়ে কিংবা পণ্য উৎপাদক বাকি দিতে রাজি না হয়, তাহলে তো ঘোষিত দামে পণ্যটা আর দেয়া সম্ভব হয় না। এরকম ঘটনা ঘটেছে ইভ্যালি কিংবা ই-অরেঞ্জের বেলায়। সাধারণ অর্থনীতি যারা বোঝেন তারা তো জানেন যে, এ ধরনের প্রকল্প একসময় ধসে পড়তে বাধ্য। কারণ, এসব কোম্পানির প্রতিনিধির সংখ্যা যত বাড়তে থাকবে, বাজার তো তত বড় হবে না। ফলে কে আর কাকে গ্রাহক বানাবে?
কেন এসব প্রতিষ্ঠান মানুষের কাছ থেকে টাকা নিতে পারে? মানুষ না হয় লোভে পড়ে ভুল করছে, রাষ্ট্রের কি কোনো দায় নেই? দিনের পর দিন এই অর্থনৈতিক প্রতারণা চলছে কিন্তু নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর নজরদারি থাকবে না কেন? অবিশ্বাস্য অফারের বিজ্ঞাপন পত্রিকার পাতায় ছাপা হচ্ছে, সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ এদের পক্ষে কথা বলছেন, এসব দেখে সাধারণ মানুষ তো প্রভাবিত হতেই পারেন। প্রতারণার কবল থেকে মানুষকে বাঁচাতে রাষ্ট্র তার দায় পালন করবে কি?
লেখক: রাজনীতিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক