বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

চালের বাজার চড়া কাদের কারসাজিতে

  •    
  • ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ১৪:১৮

দেশে প্রতিদিন কমবেশি ৮০ হাজার টন চাল প্রয়োজন। এর মধ্যে প্রায় ৫০ হাজার টন চাল বাজারে কেনা বেচা হয়। কেজিতে ৫ টাকা দাম বাড়লে ক্রেতাদের পকেট থেকে দিনে ২৫ কোটি টাকা অতিরিক্ত বেরিয়ে যায়। অর্থাৎ বছরে ৯ হাজার কোটি টাকা। এ এক নিশ্চিত মুনাফার জগত। দেশে কিছু বড় চালের ব্যবসায়ী আছেন। বাজার তাদের নিয়ন্ত্রণে কিন্তু তারা তা স্বীকার করে না।

মানুষ সাধারণত বলে থাকে, অর্থনীতি খুব জটিল বিষয়, ওসব বুঝে কাজ নেই। কিন্তু অর্থনীতি এমন এক বিষয় যা বুঝুন বা না বুঝুন সে তার প্রভাব জীবনে ফেলবেই। সাধারণত ধরে নেয়া হয় কোনো দ্রব্যের সরবরাহ বাড়লে দাম কমে, সরবরাহ কমলে দাম বাড়ে, দাম কমলে তার চাহিদা বাড়ে, দাম বাড়লে চাহিদা কমে, চাহিদা কমলে দাম কমে আবার চাহিদা বাড়লে দামও বাড়ে। বেশ গোলমেলে ব্যাপার মনে হচ্ছে। কিন্তু এর মধ্যেও একটা নিয়ম কাজ করে। এই সাধারণ নিয়ম যেন চালের বাজারে প্রযোজ্য হচ্ছে না।

দাম বাড়লেও মানুষ ভাত খাওয়া কমাবে না আবার চালের দাম কমলে মানুষ বেশি বেশি ভাত খাবে না। মানে চালের চাহিদার একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ আছে যার খুব একটা হেরফের হয় না। এর সুযোগ নিয়ে থাকে ব্যবসায়ীরা তাদের মধ্যে একটা বোঝাপড়া করে নিয়ে। দাম কতটা বাড়াবে, কখন বাজারে চাল ছাড়বে কখন উধাও করে দেবে তা তারা নিজেরা ঠিক করে নেয়। আর ক্রেতারা অসহায় হয়ে পড়ে। যেমন, আউশ ধানের মৌসুমেও বাজারে বেড়েই চলেছে চালের দাম। মোটা চাল কিনতে গেলেও তার দাম ৫০ টাকা কেজি।

গত কয়েক বছরের মধ্যে এ বছর সবচেয়ে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে চাল। ফলে বাড়ছে জীবনযাত্রার ব্যয়। অন্য ব্যয়ের তুলনায় চালের দাম বৃদ্ধির প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ে সাধারণ মানুষের জীবনে। কিন্তু পরিস্থিতি দেখে মনে হয়, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়ে বাড়ুক, জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ে বাড়ুক তাতে কার কী আসে যায়! বাতাসে হতাশা মেশানো প্রশ্ন ভেসে বেড়ায়, বাজার নিয়ন্ত্রণ করা আর জনগণের দুর্দশা দেখার কি কেউ নেই?

বাংলাদেশের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার বাস্তবতা আছে এবং স্বয়ং সম্পূর্ণ এ কথা শুনছেও মানুষ বেশ কয়েকবছর ধরে। এক বছর বহু আড়ম্বর করে শ্রীলঙ্কায় ৫০ হাজার টন চাল রপ্তানি করার কথাও হয়েছিল। কিন্তু আবার পরের বছর থেকেই দেখা গেল চালের দাম বাড়ছে, দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে চালের দাম সবচেয়ে বেশি এবং বছরে ২০–২৫ লাখ টন চাল আমদানি করা হচ্ছে। একটা বিষয় লক্ষণীয় যে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চাল আমদানি করার সময় আমদানি শুল্ক কমানো হয় কিন্তু চালের দাম কমে না। আর ভারত থেকে চাল আমদানি করা হয় ধান কাটার মৌসুমে।

ভারত, মায়ানমার, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া প্রভৃতি দেশ থেকে চাল আমদানির হিড়িক পড়ে যায় যখন তখন কৃষক ধান কেটে ঘরে তোলে। কৃষক ধান বিক্রি করে সংসারের খরচ মেটাতে চায়, দেনা পরিশোধ করতে চায় কিন্তু বাজারে দাম কমে যায় ধানের।

সরকারের কৃষি বিভাগ অনেক হিসেব করে ধানের দাম নির্ধারণ করে কিন্তু কৃষক সে দামে ধান বিক্রি করতে পারে না। যেমন বোরো মৌসুমে সরকার নির্ধারিত ধানের মূল্য ছিল ২৭ টাকা কেজি অর্থাৎ ধানের মণ ১০৮০ টাকা। আর চালের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছিল সিদ্ধ চাল ৪০ এবং আতপ চাল ৩৯ টাকা কেজি। সাধারণ মানুষ যারা মোটা চালের ভাত খান তারা কি এই দামে চাল কিনতে পেরেছিলেন কখনও, কোথাও? আর কৃষক কি মৌসুমে সরকার নির্ধারিত দামে ধান বিক্রি করতে পারে?

খাদ্যগুদামে যথেষ্ট চাল আছে এবং দেশে চালের কোনো ঘাটতি নেই এ কথা সরকারের পক্ষ থেকে জোরের সঙ্গেই বলা হচ্ছে। বোরো মৌসুমেও বাম্পার ফলন হয়েছিল। এখন আউশ ধান কাটা শুরু হয়েছে।

কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে যে এবার আউশের ফলন ভালো হবে। যশোর এবং টাঙ্গাইলের কৃষকদের মুখে হাসি। ধানের ফলন ভালো, কৃষি বিভাগ সহায়তা করেছে বীজ, সার এবং পরামর্শ দিয়ে। চাষিরা বিআর-২৬, ব্রি-২৮, ব্রি-৪৮, ব্রি-৮২, বিনাধান-১৯, হীরা, স্বর্ণ, সুভলতা, এগ্রো ১৪ সহ বিভিন্ন জাতের ধানের চাষ করেছে। ইতোমধ্যে যতটুকু এলাকায় ধান কাটা হয়েছে সব জায়গাতেই বলা হয়েছে ধানের ফলন বেশ ভালো হয়েছে। খরাসহিষ্ণু আউশ ধানে উৎপাদন খরচ কম, বোরো ধানের প্রায় অর্ধেক।

আউশ বিক্রি শুরু হয়েছে। বাজারে মোটা ধানের দাম ৯০০ থেকে ৯৫০ টাকা এবং চিকন ধান ১০০০ টাকা থেকে ১০৫০ টাকা পর্যন্ত। ইতোমধ্যে আমন ধান লাগানো হয়েছে, এবং আউশ ধান কেটে অনেকেই আবার সেই জমিতে একটু দেরি করে আমন লাগাবেন। আমন, আউশ, বোরো মিলে ধানের মৌসুম তিনটা। সবচেয়ে বেশি আবাদ হয় বোরো মৌসুমে, তারপর আমন এবং সবচেয়ে কম হয় আউশ মৌসুমে। বাংলাদেশের মোট চাহিদার ১০-১২ শতাংশ পূরণ হয় আউশ ধান থেকে। ধান উৎপাদন হয় পৃথিবীর এমন অনেক দেশে বছরে তিনবার ধান চাষ হয় না। বাংলাদেশের আবহাওয়া সেদিক থেকে ধান চাষের জন্য অত্যন্ত অনুকূল। কিন্তু ধান চালের বাজার না চাষি না ভোক্তা কারো জন্যেই অনুকূল নয় বরং প্রতিকূল।

দেশে ধান ও চাল উৎপাদন নিয়ে সরকারের দেয়া হিসাব ও বাস্তবতার মিল থাকে না কেন? এই প্রশ্নের উত্তর দেয়া সহজ নয়। দেশে মোট আবাদি জমির পরিমাণ ৭৯ লাখ হেক্টরের বেশি। এর মধ্যে এক ফসলি জমি ২২.৫ লাখ হেক্টর, দুই ফসলি জমি ৩৯ লাখ হেক্টর, তিন ফসলি জমি ১৭.৬৩ লাখ হেক্টর এবং কিছু পরিমাণ জমি আছে চার ফসলি। ফসলের নিবিড়তা ১৯৪ শতাংশ অর্থাৎ একই জমিতে বছরে গড়ে দুবার ফসল উৎপাদন করা হয়। ধান আমাদের প্রধান ফসল এবং কৃষি বিভাগের মতে এর গড় উৎপাদন প্রতি হেক্টরে ৬ টন। এর উন্নতি ঘটানো সম্ভব এবং পরিকল্পিত চাষাবাদ করলে দেশে ১০ কোটি টনের বেশি ধান উৎপাদন করা সম্ভব।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি বিভাগ, আমেরিকান কৃষি বিভাগের হিসাব অনুযায়ী দেশে তিন মৌসুমে ধান উৎপাদন হয়েছে ৫ কোটি ২৬ লাখ টন ধান। আমেরিকান কৃষি বিভাগ সারা দুনিয়ার কৃষি ফসল উৎপাদনের হাঁড়ির খবর বের করতে সদা তৎপর। কারণ খাদ্য ব্যবসা এবং খাদ্যকে অস্ত্রের মতো ব্যবহার করার সুযোগ পেলে তারা ছাড়ে না। তারা হিসেব করে দেখিয়েছে বাংলাদেশের চাল উৎপাদন তিন কোটি ৫৩ লাখ টন। সেই হিসাবে ইন্দোনেশিয়াকে পিছনে ফেলে বাংলাদেশ এখন পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম চাল উৎপাদনকারী দেশ।

প্রথম চীন প্রায় ১৫ কোটি টন, দ্বিতীয় ভারত প্রায় ১২ কোটি টন, তৃতীয় বাংলাদেশ এবং চতুর্থ ইন্দোনেশিয়া। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ব্যুরো অফ স্টাটিস্টিক্স বা বিবিএসের হিসাব অনুযায়ী চাল উৎপাদন আরও বেশি। তিন কোটি ৬৬ লাখ টন। দেশে চালের চাহিদা কত?

সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯১ লাখ। ধরে নেয়া যাক জনসংখ্যা ১৭ কোটি। প্রতিদিন ৫০০ গ্রাম বা আধা কেজি চালের প্রয়োজন বললে অনেকে না না করে উঠবেন। কারণ বাচ্চারা ভাত কম খায়, নারীরা কম খায়, বৃদ্ধরাও কম খায়। তারপরও গড়ে আধা কেজি ধরলে বছরে চালের প্রয়োজন হয় ৩ কোটি ১০ লাখ টন। অর্থাৎ ৪০ থেকে ৫০ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকার কথা। কারণ সব হিসাবেই তো চালের উৎপাদন বার্ষিক চাহিদার চেয়ে বেশি। তাহলে আমদানি করার প্রয়োজন কেন? একটা উত্তর পাওয়া গেছে।

করোনাকালে মানুষ ঘরে থাকছেন তাই নাকি তাদের ভাত খাওয়ার পরিমাণ বেড়েছে। এই উত্তরে অনেকে রেগে গেলেও করার কিছু নেই বরং চুপ করে থাকাই নিরাপদ। প্রতিবাদ করতে গেলে বিপদের আশঙ্কা আছে। যদিও সরকারের হিসাব বলছে মাথাপিছু দৈনিক চাল গ্রহণের পরিমাণ ৩৭৬ গ্রাম। সে হিসাবে চালের প্রয়োজন তো আরও কম হওয়ার কথা। তাহলে ঘাটতি এবং আমদানি কেন?

চালের ঘাটতি দূর করতে, মজুদ বাড়াতে ইতোমধ্যে ৪২৮টি প্রতিষ্ঠানকে ১৭ লাখ ২ হাজার টন চাল আমদানি করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। আর আমদানি শুল্ক ৬২.৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ করা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে শুল্ক আরও কমবে এবং অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে আশঙ্কা আছে যে শুল্ক যতই কমুক বাজারে চালের দাম কমার ক্ষেত্রে তার প্রভাব পড়বে খুব সামান্য বরং চাল আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীদের মুনাফা নিশ্চিত হবে। কারণ চাল এমন একটি পণ্য যার দাম বাড়লেও একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ চাল পরিবারগুলোকে কিনতেই হবে।

দেশে প্রতিদিন কমবেশি ৮০ হাজার টন চাল প্রয়োজন। এর মধ্যে প্রায় ৫০ হাজার টন চাল বাজারে কেনা বেচা হয়। কেজিতে ৫ টাকা দাম বাড়লে ক্রেতাদের পকেট থেকে দিনে ২৫ কোটি টাকা অতিরিক্ত বেরিয়ে যায়। অর্থাৎ বছরে ৯ হাজার কোটি টাকা। এ এক নিশ্চিত মুনাফার জগত। দেশে কিছু বড় চালের ব্যবসায়ী আছেন। বাজার তাদের নিয়ন্ত্রণে কিন্তু তারা তা স্বীকার করে না। আড়তদারদের ওপর দোষ চাপান, আড়তদার বলে দোষ চালকল মালিকদের আর চালকল মালিকেরা বলেন, মৌসুমি ব্যবসায়ীরা ধান কিনে বাজার গরম করে রেখেছে। দোষ আসলে কারো নয়। কেউ দায় নিচ্ছেন না, শেষ পর্যন্ত দায়টা ওই ভাত খাওয়া সাধারণ মানুষের।

টিসিবি হিসাব করে দেখিয়েছে গত এক বছরে চালের দাম বেড়েছে মোটা চালের ক্ষেত্রে ১৩ শতাংশ, আর চিকন চালের ক্ষেত্রে ১৪.২৯ শতাংশ। ২০১৭ সালের পর চালের দাম বৃদ্ধিতে এটাই সর্বোচ্চ হার। এক মাসের ব্যবধানেই দাম বেড়েছে ৫ শতাংশ। মোটা চাল পাইজাম, স্বর্ণা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৫০-৫২ টাকা কেজি, বিআর-২৮ বিক্রি হচ্ছে ৫৪ টাকা দরে।

চিকন চাল যেমন নাজিরশাইল ৬৬-৭০ টাকা কেজি দামে বিক্রি হচ্ছে। যদিও মিনিকেট নামে কোনো ধানের অস্তিত্ব কৃষি বিভাগ, কৃষি গবেষণা কেন্দ্র এবং ধান গবেষণা কেন্দ্র স্বীকার করে না; তারপরও বাজারে মিনিকেট চালের ছড়াছড়ি। একটু চিকন এই চাল বিক্রি হচ্ছে ৬০-৬৫ টাকা কেজি দামে। বাজারে চালের এত দাম বাড়ায় কর্তাব্যক্তিরা বিস্মিত। তাদের অনেকেই বলছেন, চালের এই মুল্য বৃদ্ধি মেনে নেয়া যায় না। কিন্তু সাধারণ মানুষ তো মেনে নিতে বাধ্য।

ধান উৎপাদকরা দাম না পেলেও মিল মালিক, আড়তদার, পাইকারি ব্যবসায়ী, খুচরা বিক্রেতা মিলে এমন এক চক্র যা ভাঙা সাধারণ ক্রেতার পক্ষে সম্ভব নয়। চালের মূল্যবৃদ্ধির কারণ কী এবং দায় কে নেবে তা নিয়ে চলছে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য। কিন্তু বাজারে চালের দাম কমছে না বরং বাড়ছেই। একদিকে করোনায় সাধারণ মানুষের আয় কমেছে অপরদিকে নিত্য প্রয়োজনীয় সব জিনিসের দাম বাড়ছে। দাম কেন বাড়ছে তার ব্যাখ্যা না জানলেও চালের চড়া দামের জন্য সাধারণ মানুষকে জীবনের অন্য প্রয়োজনগুলো সংকুচিত করতে হচ্ছে। চালসহ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির চড়া মূল্য ভোক্তাদেরকে কি দিয়ে যেতেই হবে? উৎপাদন বেড়েছে, গুদামে মজুদ আছে, নতুন ধান উঠছে তারপরও চালের বাজার চড়া। এই প্রশ্নের জবাব কে দেবে?

লেখক: রাজনীতিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

এ বিভাগের আরো খবর