বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

পরীমনি, সমাজের দায় ও নারীমুক্তি আন্দোলনের গতি

  • লীনা পারভীন   
  • ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ১৭:৪৬

বর্তমানে নারী অধিকার নিয়ে কথা বলার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক প্ল্যাটফর্মের অভাবই মূলত এভাবে ভাবতে বাধ্য করছে। নারীরা সচেতন হচ্ছে কিন্তু সঠিক চেতনাটি গড়ে উঠছে কি? অধিকার মানেই স্বেচ্ছাচারিতার লাইসেন্স নয়। সে নারী হোক বা পুরুষ। এভাবে বিচ্ছিন্ন আলাপ দিয়ে প্রকৃত নারীমুক্তি আসবে না।

একটা প্রশ্ন দিয়েই লেখাটা শুরু করতে পারি। নারীমুক্তি আন্দোলন কোন পথে? যদি এই প্রশ্নের সরাসরি কোনো উত্তর চাওয়া হয় তাহলে মনে হয় না অনেকেই তা দিতে পারবে। বাংলাদেশে মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ৫০ ভাগ নারী। এই নারীরা কি সব রকমের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত? তারা কি তাদের সব নাগরিক ও মৌলিক অধিকার সমানভাবে ভোগ করতে পারছে?

উত্তর হচ্ছে ‘অ্যা বিগ নো’। তাদের পক্ষে কি কথা বলার মতো কোনো রাজনৈতিক বা সামাজিক দল, গোষ্ঠী কিংবা সংগঠন আছে? এর উত্তরও আমাদেরকে অনেক খুঁজে তারপর দিতে হবে। একটা সময় ছিল যখন এদেশে নারীদের বিভিন্ন ইস্যুতে সরব দেখা যেত কিছু সামাজিক সংগঠনকে। এদের মধ্যে বাংলাদেশ মহিলা সমিতির কথাই আগে আসবে যাদের কাজের বিস্তৃতি ছিল সারা দেশে এবং তৃণমূল পর্যায়ে। তারা বিভিন্ন সচেতনতামূলক কাজ করার পাশাপাশি নারীদের সংগঠিত করার কাজটিও করত। সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে বার্গেইনিং এজেন্ট হিসেবেও দেখা যেত সেসব নারী সংগঠনের প্রতিনিধির। এখন সেসবের কোনো উল্লেখযোগ্য চর্চা নেই। কিন্তু নারীর লড়াই কি থেমে গেছে? অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীদের অংশগ্রহণ কি সাবলীল হয়েছে? উত্তর হচ্ছে, না। হয়নি। তার মানে চাহিদা আছে কিন্তু এর পক্ষে লড়ার শক্তিগুলো নেই।

নারীমুক্তি বলতে একদম সাদামাটা কথায় আমি যা বুঝি তা হচ্ছে সমাজ, রাষ্ট্র বা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও সমানভাবে অংশ নেয়ার সুযোগ পাবে সেটির নিশ্চয়তা বিধান। এই অধিকার কি এমনি এমনি চলে আসবে? আসবে না। এর জন্য দরকার একটি শক্তিশালী ও সুসংগঠিত আন্দোলন বা সংগ্রাম। এই জায়গাটি বলতে গেলে শূন্য হয়ে গেছে আমাদের দেশে। না আছে কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন না আছে সামাজিক। আর সেজন্যই আমাদের আশাবাদী জনগণ কদিন পর পর কোনো ইস্যু এলেই সেখানে মুক্তির আলো খুঁজতে শুরু করে। সম্প্রতি আমরা দেখলাম যে, চিত্রনায়িকা পরীমনি ইস্যুতেও অনেকেই বিভ্রান্ত হয়ে গিয়েছি। আমাদের নারীবাদীরা পরীমনির বাহ্যিক আচার-আচরণ ও ভূমিকাকে মনে করতে থাকল পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে এক বিশাল চপেটাঘাত। আসলেই কি তাই?

‘ডোন্ট লাভ মি বিচ’ এই কথাটির মধ্যে অনেকেই বিপ্লবের সূচনার গন্ধ পেলেন। কেন? পরীমনি এই কথাটা কি কোনো সিস্টেমের বিরুদ্ধে বলেছে? একদম পরিষ্কার কথা হচ্ছে ‘না’। পরীমনি পুরুষতান্ত্রিক সমাজকে চ্যালেঞ্জ করেনি। সে এই মেসেজ দিতে চেয়েছে তার প্রেমিকদের উদ্দ্যেশ্যে। রূপের টানে যারা তার কাছে এসেছিল অথচ বিপদের সময়ে তাকে অস্বীকার করেছে বা ফাঁদে ফেলেছে এই মেসেজ ছিল সেসব মানুষের উদ্দেশ্যে।

এটাতো পরিষ্কার যে, পরীমনি ব্যক্তিগত জীবনে এক স্বেচ্ছাচারী মানুষ। এর পিছনে অনেক কারণ থাকতেই পারে। কিন্তু যে কারণই থাকুক না কেন, একজন স্বেচ্ছাচারী মানুষ কখনও অন্যের জন্য পথ তৈরি করতে পারে না। স্বেচ্ছাচারিতা তার ব্যক্তিগত রুচি বা পছন্দের বিষয়। কখনই সেটা একটি গোষ্ঠীর জন্য হতে পারে না। পরীমনির ব্যক্তিগত সাহসকে আমি শ্রদ্ধা জানাই, কিন্তু বুঝতে হবে- এই সাহস কি আদৌ সমাজ পরিবর্তনের জন্য সহায়ক হবে কি না। অবশ্য এ প্রশ্নও আসতে পারে যে, পরীমনি কি সমাজ পরিবর্তেনের কোনো দায় কাঁধে নিয়েছেন?

এখানে আলোচনার বিষয় হওয়া উচিত ছিল নাগরিক অধিকারের লঙ্ঘন। আইনের বরখেলাপ যা পরীমনির সঙ্গে করা হয়েছে। কারণ এই ইস্যুটি আলোচনায় আনা অত্যন্ত জরুরি। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে একজন নাগরিকের সঙ্গে এহেন আচরণ কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। অথচ আমরা এই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুটিকে পাশ কাটিয়ে পরীমনিকে বানিয়ে দিলাম নারী সমাজের আইকন! একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা দিয়ে সামগ্রিক সিদ্ধান্তে আসার প্রবণতা আখেরে নারী মুক্তি আন্দোলনকে কিছুই দেবে না।

বর্তমানে নারী অধিকার নিয়ে কথা বলার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক প্ল্যাটফর্মের অভাবই মূলত এভাবে ভাবতে বাধ্য করছে। নারীরা সচেতন হচ্ছে কিন্তু সঠিক চেতনাটি গড়ে উঠছে কি? অধিকার মানেই স্বেচ্ছাচারিতার লাইসেন্স নয়। সে নারী হোক বা পুরুষ। এভাবে বিচ্ছিন্ন আলাপ দিয়ে প্রকৃত নারীমুক্তি আসবে না। পুরুষতান্ত্রিক রাজনীতিকে মোকাবিলা করতে গেলে প্রয়োজন সম্মিলিত প্রচেষ্টা। অর্থনৈতিক অগ্রগতির একটি আউটকাম হিসেবেই কিন্তু আজকের নারীদের এগিয়ে আসার গল্প তৈরি হচ্ছে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে এবং সেই বাড়াটা হচ্ছে অর্গানিকভাবে। এখানে অর্গানিক বলতে বোঝাতে চাইছি, রাষ্ট্র তার প্রয়োজনে যতটা দরকার ঠিক ততটাই দিচ্ছে। কাঠামোগত বা বিশ্বাসের জায়গাতে কিন্তু কোনো পরিবর্তন আসছে না।

একদিকে যেমন নারীরা এগোচ্ছে অন্যদিকে নারীদের পিছিয়ে পড়ার গল্পও কম নয়। একটা সময় বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার স্পেশাল এজেন্ডা ছিল নারীদেরকে সচেতন করা ও নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানো। এখন সেগুলোও নেই। তাহলে আগামীর বাংলাদেশের নারীর অধিকার আদায়ের জন্য লড়াই করবে কারা? সেটি কি কেবল রাষ্ট্রের দয়ার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে?

এতদিনেও নারীর প্রতি মানসিকতার কোনো পরিবর্তন আসেইনি বরং দিনে দিনে মৌলবাদী চিন্তার প্রসার ঘটছে বিকটভাবে। নারীমুক্তির কথা বলতে গেলে লড়াইটা দরকার এই মানসিক পরিবর্তনের জায়গায়। সেই লড়াইটা কে কোথায় কেমন করে করছে? এমনকি পরীমনির সাহসিকতাকেও যদি ধরে নেই যে, সে পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ দিয়েছে তাহলেও সেখানে পরিবর্তনটা আসবে কি? বা একজন পরীমনি কজন নারীকে সাহসী করে তুলতে পারবে? আমরা যখন নারীমুক্তির কথা বলি বা কাউকে আইকন বানাতে চাই তখন কিন্তু বিস্তারিত আলোচনাকে সামনে আনতে হবে। বুঝতে হবে এর পুরোটাই। অন্যথায় সমাজে একটি ভুল বার্তা চলে যাবে এবং যার ফলে নারীর এগিয়ে যাবার সুযোগ কমতে সময় লাগবে না।

লেখক: প্রবন্ধকার।

এ বিভাগের আরো খবর