বাংলাদেশের চট্টগ্রামের ‘এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন’-এ ২০২১ সাল অবধি আফগান ছাত্রী অধ্যয়নরত আছে ১৩১ জন। মূলত বাংলাদেশিদের পর আফগান মেয়েদের সংখ্যাই বেশি এই ইউনিভার্সিটিতে মোট ১৫টি এথনিক গ্রুপের মেয়েদের মধ্যে। আফগানিস্তানের এই ১৩১ জনের মধ্যে আফগান দুর্গম গ্রামের এথনিক গ্রুপ হাজেরা গ্রুপের মেয়ে লতিফা ও হাকিমার মতো আফগানিস্তানের আরও অনেক দুর্গম এলাকার এমনি ছোট ছোট এথনিক গ্রুপের মেয়েরাও আছে। এই মেয়েদের পরে নতুন করে আর আফগানিস্তানের মেয়েরা এ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসতে পারবে বলে আশা করা কষ্টকর। কারণ, আফগান তালেবানরা বলছে, তারা তাদের দেশের মেয়েদের কাজ ও পড়াশোনা করতে দেবে। তবে ইসলামি শরিয়াহ আইন বলবৎ রেখে তা কতখানি বাস্তবায়িত হবে, এ প্রশ্ন বিশ্বের প্রতিটি সচেতন মানুষের। তা ছাড়া মেয়েরাওবা সেখানে কতটা সাহস করে এগিয়ে আসতে পারবে? যেহেতু তালেবানরা মেয়েদের বেশি সময় ঘরে থাকার জন্য বলেছে, কারণ, তাদের সব সদস্য একই রকম নয়, তাই তারা কে কখন মেয়েদের ওপর কী ব্যবহার করে এর হাত থেকে বাঁচার জন্য!
আফগানিস্তানে তালেবানদের এই বিজয়ের পরে নারীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার অনেক মুসলিম দেশ। তালেবানদের বিজয়ের পরে সিরিয়ার ‘হায়াত তাহরির আল স্যাম’ (এইচটিএস) তালেবানকে বিজয়ী অভিনন্দন জানিয়েছে। এইচটিএস-এর সঙ্গে আল-কায়েদাদেরও গভীর সম্পর্ক। এরা ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল অবধি আফগান তালেবানদের কাছ থেকে সাহায্য পেয়ে পুষ্ট হয়। যে কারণে সিরিয়ায় যখন এইচটিএস ও আইএস এবং আল-কায়েদা শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল, সে সময়ে তারা কীভাবে নারীদের ওপর নির্যাতন করেছিল, নারীদের তারা যৌনদাসীতে পরিণত করেছিল, এর প্রমাণ ওই সময়ের বড় বড় প্রচারমাধ্যমের রিপোর্টগুলোতে যথেষ্ট রয়েছে। পাশাপাশি তখনকার প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিকদের লেখা বইগুলোতেও পাওয়া যায়।
এখন মিডলইস্টের রাজনৈতিক ও সামাজিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এতদিনে সিরিয়া, মিসর, ইরাক প্রভৃতি দেশে এই টেররিস্ট গ্রুপগুলোর কার্যক্রম যেভাবে কমেছিল তা আবার বাড়তে পারে। আর এই বাড়ার ফলে সব থেকে সংকটে পড়বে তাদের নারীরা। কারণ, এরা যেসব এলাকায় তাদের ঘাঁটি গাড়বে, সেখানে নারীদের জন্য আর কোনো স্বাভাবিক জীবন থাকবে না।
বিশ্লেষকরা আরও মনে করছেন এদের প্রভাব এখন ইরাক, সিরিয়া, নাইজেরিয়া, সোমালিয়া, ইয়েমেন, পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশেও বাড়বে। আর এদের প্রভাব বাড়ার অর্থই হলো, যেসব পরিবার থেকে এদের সদস্য হবে ওই সব পরিবারের নারীদের জীবন বদলে যাবে। তা ছাড়া এদের প্রভাবে অনেক বড় ক্ষতি হবে আফ্রিকার দেশ নাইজেরিয়ার নারীদের শিক্ষাক্ষেত্রে। নাইজেরিয়ার এই তালেবান মতানুসারী সংগঠন ‘বোকো হারাম’ ২০১০ থেকে সেখানকার নারীশিক্ষার বিরুদ্ধে সশস্ত্র অবস্থান নিয়ে বারবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নারী শিক্ষার্থীদের অপহরণ করছে। তাদের কারণে এ পর্যন্ত প্রায় ৩৭ হাজার মানুষ মারা গেছে। ২০ লাখ লোক স্থানান্তরিত হতে বাধ্য হয়েছে। এই বোকো হারাম এখন তালেবানদের কারণে আরও উজ্জীবিত হবে। এর ফলে নাইজেরিয়ার নারীরা তো সংকটে পড়বেই, পাশাপাশি ক্যামেরুন, সাদ ও নাইজেরিয়ার নারীরাও সংকটে পড়বে। তাদেরও শিক্ষা ও স্বাভাবিক জীবন থেমে যাবে অনেক ক্ষেত্রে।
এই তালেবানের ক্ষতিকর প্রভাবের মতো কোভিডের আঘাতও বেশি পড়বে দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় ও দক্ষিণ এশীয় নারীদের ওপর বলেই বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। যেমন দেখা যাচ্ছে, ইন্দোনেশিয়ায় মাত্র ৬৮ শতাংশ ছাত্রী কোভিডকালে অনলাইন শিক্ষার সুযোগ পেয়েছে। ৩০ শতাংশের কোনো সুযোগই ছিল না। সেভ দ্য চিলড্রেনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী পূর্ব এশীয় ও প্যাসিফিক এলাকায় ৬১ হাজার মেয়ে এবং দক্ষিণ এশিয়ায় ১ লাখ ৯১ হাজার ২০০ মেয়ে বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে। অপরদিকে ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়ে গর্ভবতী হয়েছে ১ লাখ ১৮ হাজার পূর্ব এশিয়ায় ও এশীয় প্যাসিফিক এলাকায়; এবং ১ লাখ ৩৮ হাজার গর্ভবতী হয়েছে দক্ষিণ এশিয়ায়।
কোভিডের কারণে বাল্যবিবাহের শিকার ও গর্ভবতী হওয়ার ফলে এসব মেয়ে তাদের শিক্ষাজীবনে ফিরতে পারবে খুব কমসংখ্যক। আবার কোভিড এখনও শেষ হয়ে যায়নি। তৃতীয় ঢেউ আসতে পারে। আর তাও যদি না আসে কোভিড-উত্তর যে অর্থনৈতিক কাঠামো দাঁড়াবে, সেখানে প্রথম ধাক্কা পড়বে নারীদের ওপর ও নারীশিক্ষার ওপর। ওই ধাক্কায় কতসংখ্যক মেয়ে এসব এলাকায় শিক্ষাজীবন থেকে বঞ্চিত হয় তা সত্যি অনেক বড় আশঙ্কার বিষয়। মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকায়ও কোভিডের ফলে পরিস্থিতি এর থেকে মোটেই ভালো নয়। বরং আফ্রিকার অনেক দেশে আরও বেশি খারাপ হবে।
এর পরে রয়েছে কোভিডের কারণে মানসিক স্বাস্থ্য। থাইল্যান্ডের একটি গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ছেলেদের মানসিক স্বাস্থ্য যেখানে ৬৯ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত, মেয়েদের সেখানে ৭৭ শতাংশ। আত্মহত্যা বেড়েছে মেয়েদের মালয়েশিয়া, জাপানের মতো অর্থনৈতিকভাবে উন্নত দেশেও এই কোভিডের কারণে। যেহেতু চাকরির ক্ষেত্রে আগেই বাদ পড়ছে মেয়েরা। আবার সংসারের অভাবের বড় অংশ টানতে হচ্ছে তাদের।
তালেবান ও কোভিডের ধাক্কা দুই-ই বাংলাদেশের মেয়েদের ওপর পড়বে। হয়তো আমাদের এখানে ওভাবে কোনো জরিপ হবে না। তাই প্রকৃত বাস্তবতা জানাও যাবে না। তবে এটা ঘটবেই এবং কোভিডের বিষয়টি এখনও ঘটে চলেছে। এ কারণে এখন থেকেই মেয়েদের অর্থনীতি, শিক্ষা ও মানসিক স্বাস্থ্যর জন্যে সরকারসহ বেসকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর এগিয়ে আসা প্রয়োজন। কারণ কোনো সমাজে যখন মেয়েদের শিক্ষা, অর্থনীতি ও মানসিক স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে, তখন স্বাভাবিকই ভবিষ্যৎ কয়েক জেনারেশনের ওপর তার প্রভাব পড়ে। সুস্থ জাতি গঠন-প্রক্রিয়া তখন বাস্তবে ভিন্নপথে চলে যায়।