হবিগঞ্জে পৌরসভাকে বিএনপির ঘাঁটি হিসেবেই ধরা হয়। ২০০৪ সাল থেকে পৌরসভাটি বিএনপির দখলে ছিল। ২০১৫ সালের নির্বাচনে কারাগারে থেকেও আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে পরাজিত করে মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন বিএনপির প্রার্থী জিকে গউছ।
কিন্তু এই পৌরসভাতেই এবার জামানত হারানোর লজ্জায় পড়েছে বিএনপি। এর আগে হবিগঞ্জ পৌরসভায় এমন ভরাডুবি দেখেনি দলটি। জেলা বিএনপির যুগ্ম-আহ্বায়ক এনামুল হক সেলিম ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে পেয়েছেন ৩ হাজার ২৪২ ভোট।
অবশ্য এই ভরাডুবির জন্য দলের শীর্ষ নেতাদের দুষছেন দলটির একাংশের নেতা-কর্মীরা। তারা বলছেন, দলীয় মনোনয়ন না পাওয়ার ক্ষোভ আর কোন্দলের কারণে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
নেতা-কর্মীদের ভোট কোথায় গেল?
জেলা বিএনপির নেতারা জানিয়েছেন, হবিগঞ্জ পৌরসভায় বিএনপির ৯টি ওয়ার্ড কমিটি রয়েছে। প্রতি কমিটি ৭১ সদস্যের। সেই হিসাবে ওয়ার্ড বিএনপির মোট সদস্যসংখ্যা ৬৩৯ জন। পরিবারের অন্যদের বাদ দিয়ে শুধু এসব কমিটির সদস্য ও তাদের স্ত্রীদের ভোট পড়লে ওয়ার্ড কমিটি থেকে তাদের ভোট আসত ১ হাজার ২৭৮টি। সেই সঙ্গে জেলা, উপজেলা ও পৌর কমিটি তো আছেই।
এদিকে ছাত্রদলের ৫১ সদস্যের ওয়ার্ড কমিটি অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। অর্থাৎ ৯টি ওয়ার্ড কমিটির সদস্যসংখ্যা হবে ৪৩৯ জন। একই অবস্থা যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দলসহ বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনেরও। প্রতিটিতে রয়েছে ৫ শতাধিক সদস্য। এর বাইরে কর্মী-সর্মথকরা তো রয়েছেনই।
হিসাব অনুযায়ী সব মিলিয়ে অন্তত ৫ হাজার সদস্য রয়েছেন দলটিতে। এ ছাড়া দলকে শক্তিশালী করতে প্রতিটি পাড়ায়ও আলাদা কমিটি রয়েছে তাদের। অথচ এখানে বিএনপি ভোট পেয়েছে মাত্র ৩ হাজার ২৪২টি।
শীর্ষ নেতাদের নিজ কেন্দ্রে লজ্জার হার
হবিগঞ্জ জেলা বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের নিজ এলাকার কেন্দ্রেও হেরেছেন বিএনপি প্রার্থী। ২০১৫ সালের নির্বাচনে যেখানে বিএনপির বাক্সে ভোট পড়ত হাজারের ওপর, সেখানে এবার ভোট পড়েছে ২০০/২৫০টি। কোনোটিতে আরও কম।
নাতিরাবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রটি জেলা ছাত্রদল সাধারণ সম্পাদক রুবেল আহমদের নিজ এলাকার কেন্দ্র (হোম সেন্টার)। ২০১৫ সালে বিএনপির প্রার্থী কারাগারে থেকে নির্বাচন করলেও এই কেন্দ্রে পেয়েছিলেন ১ হাজার ২১২ ভোট। অথচ এবার এই কেন্দ্রে বিএনপির প্রার্থী সেলিম পেয়েছেন মাত্র ১৯৬ ভোট।
হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রটি যুবদল সভাপতি মিয়া মোহাম্মদ ইলিয়াছের নিজের এলাকার। ২০১৫ সালের নির্বাচনে এই কেন্দ্রে বিএনপি ভোট পেয়েছিল ৫০৮টি। এবার এই কেন্দ্রে পড়েছে মাত্র ১৫৭টি।
২০১৫ সালের নির্বাচনে কারাগারে থেকেও মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও কেন্দ্রীয় বিএনপির সমবায় বিষয়ক সম্পাদক জিকে গউছ। তার এলাকার গাউছিয়া প্রি ক্যাডেট একাডেমি কেন্দ্রে ২০১৫ সালে তিনি ভোট পেয়েছিলেন ১ হাজার ১৮৭ ভোট। কিন্তু এবার শীর্ষ এই নেতার হোম সেন্টারে বিএনপির বাক্সে ভোট পড়েছে মাত্র ৪৫০টি। অথচ এই ওয়ার্ডে জিকে গউছের সবচেয়ে আস্থাভাজন (ডান হাত খ্যাত) হিসেবে পরিচিত শফিকুর রহমান সিতু কাউন্সিলর হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন।
১নং ওয়ার্ডটি জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবুল হাসিমের হোম সেন্টার। তিনি ওই ওয়ার্ডের টানা তিনবারের কাউন্সিলর। এবারও তিনি ১ হাজার ৪৭৯ ভোট পেয়ে কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন। অথচ জেলা বিএনপির অভিভাবকের এই ওয়ার্ডে দলের প্রার্থী ভোট পেয়েছেন মাত্র ১৭৬টি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির একাধিক নেতা অভিযোগ করেন, দলীয় কোন্দল থাকার কারণে অনেকেই বিএনপি প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেননি। আবার যারা দলীয় মনোনয়ন চেয়েছিলেন কিন্তু পাননি, তারাও বিএনপি প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেননি। যে কারণে তাদের হোম সেন্টারগুলোতেও বিএনপি প্রার্থী চরমভাবে পরাজিত হয়েছেন।
মনোনয়ন চেয়েও না পাওয়া জেলা যুবদল সভাপতি মিয়া মোহাম্মদ ইলিয়াছের হোম সেন্টারে নিজের দলীয় প্রার্থীর ভরাডুবির কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অন্য সময় জনগণ বিএনপিকে চেয়েছিল, এবার হয়তো চায়নি। যে কারণে বিএনপির ভোট কমেছে। এ ছাড়া নির্বাচনে ডিজিটাল কারচুপি হয়েছে। অনেকে অভিযোগ করেছেন, ভোট দিতে গিয়ে একটি মাত্র মার্কা পেয়েছেন। সব মিলিয়েই বিএনপি প্রার্থীর ভোট কম হয়েছে।’
জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবুল হাসিম বলেন, ‘এর আগে হবিগঞ্জ পৌরসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন জিকে গউছ। তিনি একজন জনপ্রিয় নেতা এবং জনগণের কাছে ঠিকভাবে পৌঁছাতে পেরেছেন। যে কারণে জনগণও তাকে ভোট দিয়েছেন। এবারের প্রার্থী হয়তো জনগণের কাছে খুব একটা পৌঁছাতে পারেননি। যে কারণে ভরাডুবি হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘এবার বিএনপি প্রার্থী ছিলেন এনামুল হক সেলিম। তিনি একটি গ্রুপের রাজনীতি করতেন। যে কারণে বিএনপির অনেক নেতা-কর্মী তার সাথে ছিল না।’
তবে দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই প্রার্থী এনামুল হক সেলিমের। তিনি দাবি করেন, সরকার, প্রশাসন ও ইভিএম মেশিন তার বিপক্ষে ছিল। যে কারণে তার ভরাডুবি হয়েছে।
২৮ ফেব্রুয়ারি হবিগঞ্জ পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জেলা যুবলীগ সভাপতি আতাউর রহমান সেলিম ১৩ হাজার ৩২২ ভোট পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী দলীয় বিদ্রোহী মিজানুর রহমান মিজান নারিকেল গাছ প্রতীক নিয়ে পেয়েছেন ১০ হাজার ৯৯০ ভোট।
নির্বাচনে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন ছয়জন। মোট ভোটার ৫০ হাজার ৯০৩ জন। তবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন ২৯ হাজার ৬ জন। এর মধ্যে বৈধ ভোটের সংখ্যা ২৮ হাজার ৯১৬টি। বাতিল ভোটের সংখ্যা ৯০টি। হবিগঞ্জ পৌরসভা নির্বাচনে ভোট পড়েছে ৫৬ দশমিক ৯৮ শতাংশ।