২৩২টি পৌরসভায় পাঁচ দফায় যে ভোট হয়েছে, তার মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নৌকা মার্কার প্রার্থীরা জয় পেয়েছেন ১৮৩টিতে। রাজনীতিতে তাদের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি জয় পেয়েছে ১১টিতে।
বাকি পৌরসভায় রাজনৈতিক দলের প্রার্থীদের মধ্যে জাতীয় পার্টি ও জাসদ একটি করে এলাকায় জয় পেয়েছে।
বাকি ৩৬টি পৌরসভায় জয় পেয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা, যাদের মধ্যে ৩৪ জনই আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়ে বিদ্রোহ করেছেন। বাকি দুইজনের একজন বিএনপির মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র হিসেবে লড়াই করেছেন। আর একজন কোনো দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন, যদিও তার ভাই আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য।
বেশির ভাগ পৌরসভাতেই বিজয়ী আওয়ামী লীগ ও পরাজিত বিএনপির মধ্যে ভোটের ব্যবধান ছিল অনেক। এর মধ্যে সিরাজগেঞ্জর তিনটি, ময়মনসিংহের গফরগাঁও, ফেনী পৌরসভাসহ বেশ কিছু এলাকায় ভোটের পার্থক্য ছিল অস্বাভাবিক। ফেনী পৌরসভায় ৯টি কেন্দ্রে ধানের শীষে কোনো ভোট পড়েনি।
এসব পৌরসভায় অর্ধেকের মতো এলাকায় ভোট হয়েছে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএমে। বাকিগুলোতে ভোট হয় ব্যালটে।
এই নির্বাচনেও বেশ কিছু এলাকায় উঠেছে কারচুপির অভিযোগ। বিএনপির কেন্দ্র থেকে নির্বাচনেকে পুরোপুরি অগ্রহণযোগ্য বলা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে ব্যর্থতার অভিযোগ এনে এপ্রিল থেকে হতে যাওয়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন আগাম বর্জনের ডাক দেয়া হয়েছে।
তবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দাবি করছে, ভোট হয়েছে সুষ্ঠু। নির্বাচন কমিশন কোথাও কোথাও সংঘাত-সহিংসতার বিষয়টি স্বীকার করলেও ভোটে কারচুপির অভিযোগ মেনে নেয়নি।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা বলেছেন, ‘ভোটে হারলে আওয়ামী লীগও কারচুপির অভিযোগ করত।’
এই ভোটকে ঘিরে দুই জন প্রার্থী, একজন প্রার্থীর ভাইসহ অন্তত ছয় জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে সিরাজগঞ্জে কাউন্সিলর পদে জয়ী এক বিএনপি নেতার মৃত্যু হয়েছে হামলায়।
জামালপুরের সরিষাবাড়ী পৌরসভায় ভোট দিতে আসা আছিয়া বেগম। ছবি: সাইমুম সাব্বির শোভন
ঝিনাইদহের শৈলকূপা পৌরসভায় সংঘর্ষে এক কাউন্সিলর প্রার্থীর ভাইয়ের মৃত্যুর দিন নদী থেকে উদ্ধার করা হয় আরেক কাউন্সিলর প্রার্থীর মরদেহ। তার মৃত্যুর কারণ এখনও নিশ্চিত করে জানায়নি পুলিশ।
ভোটার ফিরলেও প্রশ্নহীন ভোট হয়নি কোথাও
নির্বাচনে বেশ কিছু এলাকায় আওয়ামী লীগের নেতাদের বিরুদ্ধে ভোটারদের ভয় ভীতি দেখানোর অভিযোগ উঠেছে। এর মধ্যে চুয়াডাঙ্গায় আলমডাঙ্গায় এক আওয়ামী লীগ নেতার বক্তব্যের ভিডিও প্রকাশ হয়, যেখানে তিনি বলছিলেন ভোটের আগেই জয়ের প্রস্তুতি সেরে ফেলতে হবে। বিপক্ষের দলের ভোটারদেরকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বলে আসতে হবে যেন কেন্দ্রে না যায়।
আর ঠাকুরগাঁও পৌরসভায় মহিলা লীগের এক কেন্দ্রীয় নেত্রী সমাবেশ করে বলেছেন, যারা নৌকা মার্কায় ভোট দেবে না, তারা যেন এলাকায় না থাকেন। তবে এসব ঘটনায় কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
জামালপুর পৌরসভায় ভোট দিতে নারীদের দীর্ঘ লাইন
প্রতিটি পর্বেই বিএনপি এমনকি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র হিসেবে লড়াই করা একাধিক নেতা ভোট বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন কারচুপির অভিযোগ তুলে।
তবে অভিনব ঘটনার সাক্ষীও হয়েছে এবারের নির্বাচন। নোয়াখালীর বসুরহাট, কুষ্টিয়া, রাজশাহীর তানোরে বিএনপির প্রার্থী বলেছেন, ভোট বেশ ভালো হয়েছে। তবে কোথাও জিততে পারেনি বিএনপি। এর মধ্যে তানোরে তারা হেরেছে প্রথমবারের মতো।
ভোটার ফেরার নির্বাচন ২৮ ডিসেম্বর
গত ২৮ ডিসেম্বর ২৩টি পৌরসভা দিয়ে তৃণমূলে ভোটের এই লড়াই শুরু হয়। প্রথম দিনের ভোটের চিত্র ছিল চমক জাগানিয়া।
গত কয়েক বছর ধরে ভোটারের যে খরা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছিল, সেদিনের ভোট ছিল তার ব্যতিক্রম। প্রায় প্রতিটি পৌরসভায় কেন্দ্রে কেন্দ্রে ভোটারদের ভিড় ছিল উপচেপড়া। দিনাজপুর ও হবিগঞ্জের দুটি পৌরসভায় ভোট হয়েছে নির্ধারিত সময় চারটার পরেও। এর মধ্যে হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জে ভোট হয়েছে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা পর্যন্ত।
রোববারের নির্বাচনে নীলফামারির সৈয়দপুরে নির্বাচনি সহিংসতায় নিহত হয়েছেন একজন
প্রথম ধাপে সারা দেশে মোট ৬৫ শতাংশ ভোট পড়ে বলে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন। এর মধ্যে সবচেয়ে কম ভোট পড়ে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে ৪০ শতাংশের কিছু বেশি, আর সবচেয়ে বেশি পড়ে পটুয়াখালীর কুয়াকাটায় ৮৫ শতাংশ।
এই ধাপে বিএনপির পাঁচজন প্রার্থী ভোট বর্জন করেন কারচুপির অভিযোগ এনে। আর একজন নেতা ভোটের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেন।
ভোটের সকালে কেন্দ্রে ব্যালট
দ্বিতীয় ধাপে ৫৭টি পৌরসভাতেও ভোটারের ব্যাপক উপস্থিতি অব্যাহত থাকে। এই ধাপে অভিনব একটি ঘটনা ঘটে, যা বাংলাদেশে ইতিহাসে এর আগে কখনও হয়নি। সেবার যেসব কেন্দ্রে সনাতন পদ্ধতিতে ব্যালটে ভোট হয়, সেগুলোতে ব্যালটপেপার পাঠানো হয় ভোটের দিন ভোরে। তবে যেগুলোতে ইভিএমে ভোট হয়, সেগুলোতে আগের দিনই কেন্দ্রে পাঠানো হয় ভোটের যন্ত্র।
এই ধাপে ভোট পড়ে ৬২ শতাংশ। এর মধ্যে ইভিএমে ভোটের হার ছিল ৫৮ শতাংশ আর ব্যালটে ৬৭ শতাংশ।
সর্বোচ্চ ভোটের হার তৃতীয় ধাপে
তৃতীয় ধাপে ৬২ পৌরসভায় ভোট হয় ৩০ জানুয়ারি। সেদিনও সব কেন্দ্রে ব্যালটপেপার পাঠানো হয় ভোরে। এই পর্বে কোথাও ইভিএমে ভোট হয়নি।
এই ধাপে বেশ কিছু পৌরসভায় ভোটারদের মেয়র পদে নৌকা মার্কায় ভোট দিতে বাধ্য করার অভিযোগ উঠে। তবে আগের দুই ধাপের মতো সেদিনের ভোটেও একাধিক পৌরসভায় বিএনপির প্রার্থীরা বলেছেন, ভোট হয়েছে সুষ্ঠু।
চতুর্থ দফার নির্বাচনে লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জে হয়েছিল সহিংসতা
সেদিনের ভোটে ৪৫টি পৌরসভায় জয় পান নৌকা মার্কার প্রার্থীরা, বিএনপি জেতে তিনটিতে। আর স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয় পান ১৪টিতে।
তৃতীয় ধাপে কেবল ব্যালট পেপারে ভোটের হার আগের দুই ধাপের চেয়ে অনেক বেশি দেখিয়েছে নির্বাচন কমিশন। তারা জানিয়েছে সেদিন ভোট পড়েছে ৭০.৪২ শতাংশ।
ভোটারদের ভয় দেখানোর ভিডিও
চতুর্থ ধাপে ১৪ ফেব্রুয়ারি কিছু পৌরসভায় ভোট হয় ব্যালটে, কিছু পৌরসভায় ভোট হয় ব্যালটে। এবারও যেসব এলাকায় ব্যালটে ভোট নেয়া হয়, সেগুলোতে ব্যালট পেপার পাঠানো হয় ভোরে।
সেদিন ৫৩টি পৌরসভার মধ্যে ৪৮টিতে জয় পায় আওয়ামী লীগ, বিএনপি জেতে একটিতে। আর চারটিতে জয় পান স্বতন্ত্র প্রার্থীরা।
নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, সেদিন ভোটের হার ছিল ৬১ শতাংশ। অর্থাৎ প্রথম তিন ধাপের তুলনায় এদিন ভোটারের আগ্রহ ছিল কম।
ঝিনাইদহের মহেশপুরেও পাওয়া গেছে সহিংসতার খবর। নিয়ন্ত্রণ করতে বিজিবি মাঠে
এই ধাপেই চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা ও ঠাকুরগাঁও পৌরসভায় ভোটারদের বাধা দেয়ার বিষয়ে দুই আওয়ামী লীগ নেতার ভিডিও প্রকাশ হয়। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেয়া হয়নি। আর ভোটের দিন কারচুপির অভিযোগ এনে বিএনপির দুই প্রার্থী ভোট বর্জন করে।
প্রায় সবাই আওয়ামী লীগের
পঞ্চম দফার পৌর নির্বাচনে ২৯টি পৌরসভার সবগুলোতে ভোট হয় ইভিএমে। আগের চার ধাপের তুলনায় এদিন ভোটারের সংখ্যা কমই দেখা গেছে।
আগের চার ধাপের মতোই এবারও আওয়ামী লীগের জয়জয়কার দেখা গেছে। ২৭টি পৌরসভাতেই হয় পেয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা। বিএনপি জিতেছে কেবল একটিতে। আর একটি জিতে নিয়েছেন নৌকা মার্কার মনোনয়ন না পেয়ে ভোটের লড়াইয়ে নামা এক আওয়ামী লীগ নেতা।
এই ধাপে নির্বাচনি সহিংসতায় নীলফামারির সৈয়দপুর পৌরসভার একজন নিহত হয়েছেন।